চলছে ইফতারের প্রস্তুতি। ফাইল ছবি
‘রোজা’ শব্দটি ফারসি। আরবিতে এটি ‘সাওম’ বা ‘সিয়াম’। হিজরি সালের নবম মাস ‘রমজান’-এ সারা বিশ্বজুড়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন টানা এক মাস সূর্যোদয়ের বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত সব ধরনের পানাহার থেকে বিরত থেকে রোজা পালন করে থাকেন। এই রোজা রাখার ‘নিয়ত’ অর্থাৎ ‘উদ্দেশ্য’ নিয়ে ভোরে কিছু খাওয়া হয়, একে বলে ‘সেহেরি’; তার পর সারা দিন উপবাস থেকে সূর্যাস্তের পরে আজানের সঙ্গে সঙ্গে আহার গ্রহণের মাধ্যমে রোজা খোলা হয়ে থাকে, একে বলে ‘ইফতার’।
রোজা ব্রত রেখেছেন এমন মানুষের কাছে ‘ইফতার’ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক সময়ের কিছু আগে ইফতারের থালি সাজিয়ে আজানের অপেক্ষা, যেন আদেশ ছাড়া সে খাবার মুখে তোলা নিষেধ। ব্রত পালনকারী সারাদিন রোজা রাখার পরে সে মুহূর্তে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় জল ও খাদ্যের অপরিহার্যতা, অনুভূত হয় পৃথিবীর ক্ষুধাতুর মানুষদের যন্ত্রণা। ইফতারে প্রথম যে ফলটি মুখে দেওয়ার রীতি প্রচলিত রয়েছে তা হল খেজুর। এ ছাড়াও, থাকে ঠান্ডা সরবত, অন্য ফল, আবার একটু ভাজা ও ঝাল জাতীয় খাবার না হলে মুখ ছাড়ে না, এখানে সেই বাংলার নিজস্ব খাদ্যাভাসের প্রবেশ। বেগুনি-সহ কয়েক ধরনের তেলেভাজা, ছোলা-মুড়ি তাই খুবই জনপ্রিয়।
রমজান মাসের রোজা প্রত্যেক সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নর-নারীর জন্য ‘ফরজ’ অর্থাৎ ‘অবশ্য পালনীয় কর্তব্য’। এই রমজান মাস মুসলিমদের কাছে খুবই মর্যাদাপূর্ণ, কারণ, এই মাসে পবিত্র গ্রন্থ কোরাণ ‘নাজিল’ অর্থাৎ অবতীর্ণ হয়েছিল, তা ছাড়া, এই মাসে রয়েছে বিশেষ এক রাত, যাকে বলে ‘শবে কদর’ বা ‘লাইলাতুল কদর’, যার অর্থ ‘সম্মানীয় রজনী’। এই রাতের ‘ইবাদত’ বা ‘উপাসনা’ হাজার রাতের ইবাদতের চেয়ে উত্তম বলে পরিগণিত হয়। বিশ্বাস অনুযায়ী, এমনই এক শবে কদরের রাতে মক্কার হেরা গুহায় পরম প্রভুর সাধনায় ধ্যানমগ্ন থাকা অবস্থায় শেষ নবি হজরত মুহম্মদ (সাঃ) নিকট ফেরেস্তা বা স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের মাধ্যমে পবিত্র গ্রন্থ কোরান ‘নাজিল’ অর্থাৎ অবতীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু রমজান মাসের কোন রাতটি ‘শবে কদর’-এর রাত তা নির্দিষ্ট করে উল্লেখ নেই, কিছু বর্ণনায় জানা যায় এই রাতে আকাশ থাকবে পরিষ্কার, ‘নূরের আলো’ অর্থাৎ স্বর্গীয় জ্যোতিতে চাঁদ হবে জ্যোৎস্নাময়। অনুমান করা হয়, রমজান মাসের ২৭ তারিখের রাত শবে কদরের রাত। প্রচলিত আখ্যান অনুসারে, এই রাতে ফেরেস্তারা পৃথিবীতে নেমে আসেন এবং ‘ইবাদত’ অর্থাৎ উপাসনারত ব্যক্তিদের উপরে ঈশ্বরের দোয়া বা আশীর্বাদ বর্ষণ করেন। এই রাতে গাছপালা, পশুপাখি, সব প্রকৃতি ও জীবজগত আল্লাহতালার ইবাদত করতে থাকে বলে বিশ্বাস।
রমজান ছাড়া অন্য মাসেও রোজা রাখা যায়, তবে তা আবশ্যিক নয়। যদি কোনও কারণে রমজান মাসে কোনও ব্যক্তি রোজা রাখতে অক্ষম হন, তা হলে অন্য সময় সেই রোজা রাখা যায়, আবার কেউ রোজা রাখার ‘মান্নত’ করলে যে কোনও মাসে ‘রোজা’ রাখতে পারেন, মহরম মাসের নয় এবং দশ তারিখে অনেকে রোজা রাখেন আবার প্রত্যেক আরবি মাসের ১৩, ১৪ এবং ১৫ তারিখে রোজা রাখার প্রচলন আছে।
বাহ্যিক দিক থেকে সাধারণ অর্থে ‘রোজা’ বা ‘সিয়াম’ বলতে সর্ব প্রকার পানাহার থেকে বিরত থাকা বোঝালেও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এর অর্থ ব্যাপক। রোজা রাখা অবস্থায় প্রত্যেক ইন্দ্রিয়কে রাখতে হবে অতি সাবধানে। অশ্লীল কথা বা তর্ক বিবাদ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে হয়ে উঠতে হবে বাকসংযমী, চোখের দৃষ্টি সংযত হবে, লোভ, লালসা, কাম, ক্রোধ, পরশ্রীকাতরতা, পরনিন্দা, পরচর্চা, হিংসা, দ্বেষ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে। এই কারণে ‘রোজা’কে ‘আত্মার শুদ্ধকরণ’ বলা হয়ে থাকে। প্রকৃত পক্ষে দীর্ঘ সময় ধরে এই উপবাস বাহ্যিক দিক থেকে শরীরকে এক দিকে যেমন নিস্তেজ করে তোলে, অন্য দিকে, রিপুর তাড়নার ঊর্ধ্বে উঠে মানব চেতনাকে দৃপ্ত করে তোলে।
বস্তুত পক্ষে শুধু ইসলামই নয়, উপবাসের মাধ্যমে আত্মার শুদ্ধকরণের পদ্ধতিকে প্রায় সব ধর্মেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রথম মানব হরজত আদম থেকে নূহ নবি, হজরত ইব্রাহিম থেকে দাউদ নবির যুগেও রোজার প্রচলন ছিল। ইহুদিদের মধ্যেও উপবাসের প্রচলন রয়েছে, আবার বাইবেল থেকে জানা যায়, যিশুও উপবাস রেখেছিলেন। বৌদ্ধধর্মের অষ্টবিধানেও সপ্তাহের এক দিন থেকে পরের দিন দুপুর পর্যন্ত উপবাসের নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। হিন্দুধর্মে নানা উপলক্ষে উপবাসের প্রচলন রয়েছে। আসলে সব ধর্মেই, সবার উপরে মানবিকতা ও অপরের দুঃখের সহমর্মী হয়ে ওঠাকেই ধর্মের মূল সার বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি আজ ধর্মে-ধর্মে ব্যবধান রচিত হয়েছে।
মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ টানা এক মাস রোজা রাখার পরে ‘ইদ-উল-ফিতর’ এ মেতে ওঠেন। ‘ইদ’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘খুশি’, আর ‘ফিতর’ শব্দের অর্থ ‘দান’। এ দিক থেকে ইদ শুধু খুশির উৎসব নয়, এই আনন্দমেলায় গরিব, অসহায়, আত্মীয়, পরিজন,পাড়া-প্রতিবেশীদের দান, খয়রাত করাটাও বাধ্যতামূলক। সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ যাতে ইদের আনন্দে শামিল হতে পারেন, সে জন্য, প্রত্যেক পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে মাথাপিছু নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল বা গম জাতীয় শস্যদানা অথবা সমমূল্যের অর্থ দান করতে হয়। একে ‘ফেতরা’ বলে। ইসলাম ধর্মে প্রথম ইদ-উল-ফিতর বা খুশির ইদের সূচনা হয় নবির মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পরের বছর অর্থাৎ দ্বিতীয় হিজরি সালে।
ইদের নতুন চাঁদকে সালাম জানিয়ে নতুন পাজামা, পাঞ্জাবি আর ওড়নায় সুসজ্জিত হয়ে আতরের সুবাস গায়ে মেখে নামাজ আদায়ের পরে কোলাকুলির মাধ্যমে চলে শুভেচ্ছা বিনিময়। লাচ্ছা, সিমুই, পায়েসের গন্ধে চারপাশে খুশির হাওয়া বইতে শুরু করে। এই উৎসবে বাড়ির মহিলাদের মেহেন্দি পরা, বন্ধুদের আমন্ত্রণ করার রীতি প্রচলিত রয়েছে। ধর্মের বেড়া ভেঙে সকলেই উদ্যাপন মেতে ওঠেন।
লেখক গলসির সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy