—ফাইল চিত্র।
এগারো লক্ষ অরণ্যবাসীকে উচ্ছেদ করিতে হইবে, শীর্ষ আদালতের এই নির্দেশে ত্রস্ত হইয়াছিল দেশবাসী। স্বস্তির বিষয়, স্থগিতাদেশ আসিয়াছে। অরণ্যবাসীদের আবেদন যথাযথ ভাবে বিবেচনা হইয়াছে কি না, সেই বিষয়ে রাজ্যগুলিকে হলফনামা দাখিল করিতে বলিয়াছে সুপ্রিম কোর্ট। আশা করা যায়, অবশেষে রাজ্যগুলি সক্রিয় হইবে, এবং স্বাধীন ভারতের বৃহত্তম উচ্ছেদের আশঙ্কা দূর হইবে। এই সঙ্কটের পরিমাপ করিতে চাহিলে কেবল বিপর্যয়ের ব্যাপকতা দেখিলে হইবে না। অন্যায়ের তীব্রতাও বিবেচ্য। ‘অরণ্যবাসীর অধিকার আইন (২০০৬)’ বলিয়াছে, অরণ্যে বাস করিবার অধিকার ব্যক্তি কিংবা সমুদয়ের আছে, কিন্তু বৈধতা দিবে রাজ্য সরকার। আইনের দৃষ্টিতে ইহাতে ভুল নাই। কিন্তু প্রশাসনের নিকট প্রান্তবাসী কী প্রত্যাশা করিতে পারেন, তাহাও অজানা নহে। যাহা অবধারিত, তাহাই ঘটিয়াছে। এগারো লক্ষ মানুষের অরণ্যবাসের দাবি ‘অবৈধ’ প্রতিপন্ন হইয়াছে। কত জন আবেদন করেন নাই, কতগুলি আবেদনে অপূর্ণতা বা অসঙ্গতি আছে, কত জন বাস্তবিক অরণ্যবাসের অযোগ্য, বুঝিবে কে? আদিবাসী, অরণ্যবাসী মানুষ চিরকালই রাষ্ট্রের ব্রাত্য সন্তান। মূলস্রোতের বিধিবদ্ধ জীবনযাত্রার সহিত তাঁহাদের সংযোগ সামান্য। রাষ্ট্রব্যবস্থার উপান্তে তাঁহাদের জীবন কাটিয়া যায়। আইন তাঁহাদের অধিকার প্রদানের পরেও অধিকাংশ প্রান্তবাসীই সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করিতে পারেন নাই, ইহা আশ্চর্য নহে।
এতগুলি মানুষের চরম বিপর্যয়ের সম্ভাবনা দেশবাসীকে বিচলিত করিয়াছিল। ইহা সামাজিক অন্যায়ও বটে। অরণ্যে বসবাসের অধিকারের জন্য আবেদনের প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও জটিল, অনেক অরণ্যবাসীর ক্ষেত্রেই সেই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয় নাই, তাই স্বাভাবিক বুদ্ধিতেই বলা যায়, তাঁহাদের উচ্ছেদ ন্যায্য নহে। কিন্তু সেই বিষয়ে শীর্ষ আদালতে আদিবাসী কল্যাণ মন্ত্রক কার্যত নীরব ছিল। কেন এই নীরবতা? বহুমূল্য বিবিধ খনিজে পূর্ণ অরণ্যভূমি দখল করিতে বৃহৎ বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি আগ্রহী, তাহা অজানা নহে। প্রশ্ন উঠিয়াছে, তাহাদের হাতে বনভূমি দিতে আগ্রহী বলিয়াই কি সরকার আদিবাসীদের অধিকার খর্ব করিতেছে? অরণ্যের উপর আদিবাসীদের সামুদায়িক মালিকানা স্বীকার করিলে তাহার পরিচালনা গ্রামসভার উপরেই ন্যস্ত হয়। ওড়িশায় নিয়মগিরি পর্বতে ও সন্নিহিত অঞ্চলে গ্রামসভাগুলি সামুদায়িক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল, প্রতিহত হইয়াছিল জমি অধিগ্রহণের চেষ্টা। ফলে সামুদায়িক মালিকানা স্বীকার করিতে সরকার নিরুৎসাহ হইবে, তাহার সম্ভাবনা যথেষ্ট। বাস্তবেও মাত্র তিন শতাংশ অরণ্যভূমিতে সামুদায়িক কর্তৃত্ব স্বীকৃত হইয়াছে। নির্বাচনের বৎসরে হয়তো সরকার এখনই আদিবাসীদের উৎখাত করিতে উদ্যোগী হইবে না। কিন্তু অরণ্যবাসের বৈধতা না থাকিলে ভবিষ্যতে অরণ্যভূমি লইয়া সিদ্ধান্তে অরণ্যবাসীদের কোনও ভূমিকাও থাকিবে না।
প্রশ্নটি কিন্তু কেবল বাস্তু হইতে উৎখাতের নহে। রাষ্ট্র যখনই বৈধতার পরীক্ষক রূপে অবতীর্ণ হয়, এবং মান্যতা পাইবার জন্য তাহার নিকট আবেদন করিতে হয় নাগরিককে, তখনই বিপন্নতা দেখা দেয়। সম্প্রতি পরিচয়পত্র হিসাবে আধার কার্ডের প্রাধান্য এবং নাগরিক তালিকা প্রণয়ন, এই দুইটিই অগণিত নাগরিকের জীবনে নানা প্রকারে বিপর্যয় আনিয়াছে। এখন দ্রুত লয়ে চলিতেছে জমির ডিজিটাল নথির প্রস্তুতি। ইহাও যে কত মানুষ, বিশেষত দরিদ্র এবং স্বল্পশিক্ষিত ভারতীয়ের জীবনের বিপর্যয় আনিবে, কে বলিতে পারে? প্রশাসন উদাসীন, অবিবেচক, দুর্নীতিগ্রস্ত হইলে দরিদ্র, অসহায় নাগরিকের কী বিপর্যয় হইতে পারে, তাহার একটি ইঙ্গিত মিলিল এগারো লক্ষ মানুষকে ছিন্নমূল করিবার আইনি নির্দেশে। প্রশাসনযন্ত্র নাগরিকের অধিকারের মর্যাদা দিবে, এমন প্রত্যাশা করাও কি তবে নির্বুদ্ধিতা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy