অবশেষে ভারত সেই স্বর্গে জাগরিত হইল, যেখানে ‘অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান’ও রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের ভাষা রপ্ত করিয়া ফেলিয়াছে। স্কুল শিক্ষক ছাঁটাই করিতেছে, বিমা সংস্থা কর্মীকে বরখাস্ত করিতেছে, এমনকি সংবাদ প্রতিষ্ঠানও কর্মীকে বসাইয়া দিয়া সেই কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোষণা করিয়া দিতেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাত্রকে ক্ষমা চাহিতে বাধ্য করিতেছে। প্রত্যেক অভিযুক্তই ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’, দেশবিরোধী। অস্বীকার করিবার উপায় নাই, নরেন্দ্র মোদীর সরকারের সৌজন্যে ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’-এর তকমাটি কার্যত গৌরবের অভিজ্ঞান হইয়া উঠিয়াছে। হিন্দুত্ববাদীরা যাঁহাকে অ্যান্টি-ন্যাশনাল হিসাবে দাগিয়া দিবে, প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি যে সহিষ্ণুতার, বহুত্বের, উদারবাদের সমর্থক, তাহা বুঝিয়া লওয়া সম্ভব। কিন্তু, পুলওয়ামার ঘটনার প্রেক্ষাপটে আপাতদৃষ্টিতে অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলিও যদি এই তকমা সাঁটিতে আরম্ভ করে, তখন থমকাইয়া দাঁড়ানো প্রয়োজন। স্যোশাল মিডিয়ায় ‘দেশবিরোধী’ পোস্ট করিবার দায়ে যাঁহারা অভিযুক্ত হইয়াছেন, তাঁহাদের অধিকাংশই উগ্রতার বিরুদ্ধে কথা বলিয়াছিলেন। ‘রক্তের বদলে রক্ত চাই’ গোত্রের দাবির বিপ্রতীপে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করিয়াছিলেন। প্রথমত, এই অবস্থানকে কোন অর্থে দেশবিরোধী বলা যাইতে পারে, তাহার কোনও যুক্তি কেহ পেশ করেন নাই। ব্যক্তির মতপ্রকাশের স্বাধীনতা তাঁহার গণতান্ত্রিক অধিকারের অঙ্গ। সেই মত কাহারও নিকট অগ্রহণযোগ্য হইতে পারে, কিন্তু সেই কারণে তাঁহার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অধিকার গণতন্ত্র দেয় না। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: কাহারও ব্যক্তিগত মতামত কি পেশার ক্ষেত্রে আদৌ বিচার্য হইতে পারে? অন্তত যত ক্ষণ না দেশের আইন-আদালত সেই মতকে দূষণীয় সাব্যস্ত করিতেছে? স্বভাবতই এই প্রশ্নের কোনও উত্তর মিলে নাই। অ্যান্টি-ন্যাশনালের গন্ধবিচার যে নূতন চৌকাঠটি অতিক্রম করিল, অতঃপর তাহাই ‘স্বাভাবিক’ গণ্ডি হিসাবে বিবেচিত হইবে, এমন আশঙ্কা প্রবলতর হইতেছে।
কেন সংস্থাগুলি কর্মীদের রাজনৈতিক অবস্থান সম্বন্ধে নিরপেক্ষ থাকিতে পারিল না? কেন বলিতে পারিল না যে প্রতিষ্ঠানের নিকট ব্যক্তিগত মতামত গুরুত্বহীন? সামগ্রিক পরিস্থিতি দেখিলে সেই কারণটি আঁচ করা চলে। গোটা দেশেই জাতীয়তাবাদী সুনামি আছড়াইয়া পড়িয়াছে। বিরুদ্ধ মতের, সহনশীল উদার স্বরের চিহ্নমাত্র দেখিলেই দেশভক্ত জনতা ঝাঁপাইয়া পড়িতেছে। ঘাড় ধরিয়া দেশপ্রেমের পাঠ পড়াইয়া আসিতেছে। অনুমান করা চলে, প্রতিষ্ঠানগুলি এই রোষের শিকার হইতে চাহে নাই। তাহারা জানে, মারের সাবধান নাই— ফলে, যে ব্যক্তিকে কেন্দ্র করিয়া অশান্তি হইবার সম্ভাবনা, তাঁহাকেই সমূল উচ্ছেদ করিয়া ফেলা শ্রেয়। একটি গণতান্ত্রিক দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কতখানি মারাত্মক ভাবে ক্ষুণ্ণ হইলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হইতে পারে, তাহা ভাবিলে শিরদাঁড়া বহিয়া শীতল স্রোত নামিয়া যায়। প্রতিষ্ঠানগুলি জানে, এই গণ-হিস্টিরিয়ার বিপ্রতীপে দাঁড়াইলে রাষ্ট্রকে, প্রশাসনকে পার্শ্বে পাওয়া যাইবে না। প্রসঙ্গত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশকে নিজের কর্তব্যের কথা স্মরণ করাইয়া দিয়া এই ভীতি কাটাইবার চেষ্টা করিতেছেন। কিন্তু, তাহা ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টা। মোদী-জমানার অসহিষ্ণুতার সিন্ধুতে বিন্দুমাত্র। এই অসহিষ্ণু পরিবেশ এক দিনে তৈরি হয় নাই। তাই মেঘালয়ের রাজ্যপাল তথাগত রায় কাশ্মীরিদের বয়কট করিবার ডাক দিতে পারেন। ব্যক্তি তথাগত রায়ের মত যাহাই হউক না কেন, ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানের মুখে যে আর একটি অঙ্গরাজ্যকে বয়কট করিবার কথা অনৈতিক, তিনি তাহা মনে রাখেন নাই। মনে না রাখিলে বিপদ নাই জানেন বলিয়াই। উগ্র জাতীয়তাবাদীদের এই নিরাপত্তার বোধটি আপাতত গোটা ভারত জুড়িয়া বিরাজমান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy