Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Sister Nivedita

কেদার-বদ্রীনাথের পথে নিবেদিতা

১৯১০ সালের নিবেদিতার কেদারনাথ-বদ্রীনাথ ভ্রমণের কথা প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণাজির গ্রন্থেও সুন্দর ভাবে লিখিত। যাত্রাপথের সেই সুন্দর কাহিনি।

স্বামী দেবেন্দ্রানন্দ
শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৭ ১৬:৫৯
Share: Save:

২০১৩ বিপর্যয়ের পটভূমিকার কথা চিন্তা করে ভাবতে অবাক লাগে, ১০০ বছর আগে স্বামীজির মানসকন্যা আমাদের ভগিনী নিবেদিতাও বারবার এসেছিলেন হিমালয়ের টানে কেদারনাথ-বদ্রীনাথের দুর্গম তীর্থে। শেষবার যখন তিনি আসেন তাঁর আরাধ্য দেবতার টানে সে বার তাঁর সঙ্গী ছিলেন বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র ও তাঁর আত্মীয় অরবিন্দ বসু। এই হিমালয় ভ্রমণকে কেন্দ্র করেই জগদীশচন্দ্র হয়তো তাঁর ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থে লিখিত ‘ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে গিয়ে’ চিরজাগ্রত দেবতাকে খুঁজে পেয়েছিলেন ‘মহাদেবের জটায়।’

১৯১০ সালে কেদারনাথ-বদ্রীনাথ খুবই দুর্গম তীর্থ ছিল, চড়াই-উৎরাই বেশিটাই ছিল হাঁটাপথে। এখনকার মতো যানবাহন বা যাত্রীনিবাস ছিল না। নিবেদিতার চিঠিপত্রে ও রচনায় তীর্থপথের এই দুর্গমতার উল্লেখ পাওয়া যায়। এখানে উল্লেখযোগ্য, ১৮৯৮-তে নিবেদিতা যে বার স্বামীজীর সঙ্গে উত্তুঙ্গ অমরনাথ তীর্থে যান, তখনও তীর্যযাত্রার সেই দুর্গমতার কথা লিখেছিলেন। তুলনায় আধুনিককালে হিমালয়ের এই সব তীর্থস্থান অনেক সহজগম্য সড়কপথে।

যাই হোক, ১৯১০ সালের নিবেদিতার কেদারনাথ-বদ্রীনাথ ভ্রমণের কথা প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণাজির গ্রন্থেও সুন্দর ভাবে লিখিত। যাত্রাপথের সেই সুন্দর কাহিনি—

‘১৯১০ খ্রিস্টাব্দ। গ্রীষ্মের ছুটিতে যাত্রীগণ রওনা হইলেন। প্রথমে হরিদ্বার। কনখল রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রমে স্বামী কল্যাণানন্দের সহিত সাক্ষাৎ হইল। তিনি যথাসম্ভব সাহায্য করিলেন। কনখলের দর্শনীয় স্থানগুলি দেখা হইল। সন্ধ্যাবেলা ব্রহ্মকুণ্ডের ঘাটে বসিয়া তাঁহারা গঙ্গার আরতি দেখিয়া মুগ্ধ হইলেন। হরিদ্বার যেন বারাণসীর ক্ষুদ্র সংস্করণ। একজন কথায় কথায় বলিলেন, হরিদ্বার ও কাশীধামের মধ্যে পার্থক্য এই যে, কাশীতে লোকে যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিবার জন্য, আর হরিদ্বারে আসে তপস্যা করিবার উদ্দেশ্যে।

হরিদ্বার হইতে ১৭ মে তাঁহারা হৃষীকেশ পৌঁছিলেন। হৃষীকেশের প্রাকৃতিক শোভার তুলনা নাই। খরস্রোতা জাহ্নবী, সাধু-সন্ন্যাসীগণের শত শত কুটীর আর অদূরে হিমালয় পর্বত। আরও কিছুদর গিয়া কুলী, ডাণ্ডী প্রভৃতি সংগ্রহ করিবার স্থান। হরিদ্বারেই একজন ভাল পাণ্ডা পাওয়া গিয়াছিল। প্রকৃতপক্ষে এখান হইতেই কেদার-বদরীর যাত্রা আরম্ভ। লছমনঝোলা সেতু পার হইয়া গঙ্গার ধার দিয়া উত্তর দিকে পথ চলিয়া গিয়াছে। যাত্রীরা আপনমনে মালা জপ করিতে করিতে দলে দলে চলিয়াছে। কাহারও মুখে বিশেষ কথা নাই। পরস্পর দেখা হইলে অভিবাদন করিয়া বলে ‘‘জয়, কেদারনাথকী জয়! জয়, বদরীবিশালকী জয়!’’ নিবেদিতা দেখেন মেয়েরা কেমন স্বচ্ছন্দে পথ চলিতেছে! শহরের সে আড়ষ্ট ভাব নাই, চাল-চলন সঙ্কোচদ্বিধাহীন।

পথে সাধারণত তাঁহারা ডাকবাংলায় আশ্রয় লইতেন। যেখানে তাহার অভাব, সেখানে চটি অথবা ধর্মশালাতেই সাধারণ যাত্রীদের সহিত অবস্থান করিতে হইত। নিবেদিতা সেই অবসরে যাত্রীদের সহিত আলাপ জুড়িয়া দিতেন। বেদনার সহিত তাঁহার মনে হইত, সভ্যতার কৃত্রিমতা তাঁহাদিগকে সাধারণ যাত্রী হইতে পৃথক করিয়াছে। নিবেদিতা সকলের নিকটই একটি বিস্ময়; সুতরাং তাঁহার সহিত আলাপে সকলেরই আগ্রহ দেখা যাইত। কখনও পদব্রজে, কখনও ডাণ্ডীতে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিরীক্ষণ করিতে করিতে কেদারের পথে শেষ চটিতে তাঁহারা পৌঁছিলেন। শেষের চার মাইল খাড়া চড়াই, দুর্গম পথ। ৩০ মে, সোমবার, দ্বিপ্রহরে তাঁহারা কেদারনাথের মন্দিরের নিকট উপস্থিত হইলেন। মন্দির বন্ধ হইয়া গিয়াছে, আরতির সময় খুলিবে। সন্ধ্যার পূর্ব হইতে ঘন কুয়াশায় চারিদিক আচ্ছন্ন হইয়া গেল; প্রচণ্ড শীত পড়িয়াছে। বিশ্রামের পর নিবেদিতা চলিলেন মন্দিরের দিকে। যাত্রীরা দ্রুতপদে চলিয়াছে। ততক্ষণে বেশ অন্ধকার হইয়া গিয়াছে, কিন্তু কুয়াশা সরিয়া যাওয়ায় মাথার উপর নক্ষত্র এবং চারিদিকে বরফ বেশ পরিষ্কার দেখা যাইতেছে। আরতি শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীদের মধ্যে কোলাহল আরম্ভ হইল। আর কোনও দিকে দৃষ্টি নাই, উন্মত্তের মতো সকলে সিঁড়ি দিয়া উঠিতেছে, কতক্ষণে মন্দিরে প্রবেশ করিয়া দেবতাকে স্পর্শ করিবে। সিঁড়ির শেষ ধাপে উঠিয়া নিবেদিতা জনতার দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন। জীবনে তিনি যত সুন্দর দৃশ্য দেখিয়াছেন, এ দৃশ্য তাহার অন্যতম। ঊর্ধ্বে তুষারমৌল কেদারশৃঙ্গ, পাদদেশে প্রসারিত সমগ্র ভারত। ভারতের সকল প্রান্ত হইতে বিভিন্ন পথ দিয়া জলস্রোত আসিতেছে, সকল বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিয়া ঊর্ধে উঠিতেছে; হৃদয়ে একমাত্র আকাঙ্ক্ষা, দেবতার চরণ স্পর্শ করিবে। জ্ঞানী, সাধক, যোগী-ঋষির চিরআবাসভূমি কেদার-বদরী। করজোড়ে নিবেদিতা কেদারনাথের উদ্দেশে প্রণাম জানাইলেন। শান্তিতে মনঃপ্রাণ ভরিয়া উঠিল। শিব! শিব!

পরদিন তাঁহারা বেড়াইতে বেড়াইতে বহুদূর গেলেন। বিস্তীর্ণ প্রান্তরে গলিত তুষারধারা ধীরে ধীরে নামিয়া আসিতেছে। দূর হইতে কেদারনাথের মন্দিরটি মনে হইতেছে যেন পল্লীর এক ক্ষুদ্র দেবালয়। নিবেদিতা অনেকক্ষণ পর্বতের ধারে নিঃশব্দে বসিয়া রহিলেন। উপরে অবিরাম হিমানীপ্রপাত হইতেছে, তাহার ক্ষীণ শব্দ শুনিতে পাইলেন। এই স্থান হইতে পাণ্ডবগণ মহাপ্রস্থান করিয়াছিলেন। তুষারাবৃত পথ ধরিয়া তাঁহার কিছুদূর গেলেন। মহাভারত-কাহিনির এখানেই পরিসমাপ্তি। জাগতিক সকল সুখ, দুঃখ, আশা, আকাঙ্ক্ষা বাসনার নির্বাপণ। অতঃপর যাত্রা ঊর্ধে, অনন্তলোকে; পৃথিবীর সহিত তাহার সম্পর্ক নাই। ইহাই ভারতবর্ষের চিরন্তন ইতিহাস। নিবেদিতা মনে মনে বলিলেন, ‘‘ধন্য ভারতবর্ষ!’’

যেমন সর্বতোমুখী ভারতপ্রেম ও তার ধ্যান-ধারণায় নিবেদিতা আজও অতুলনীয়া, তেমনই পাগলের মতোই তিনি বারবার ছুটে গেছেন হিমালয়ে অন্তরের তাগিদেই, হিমালয়ে নৈঃশব্দ্যের মধ্যে শুনেছেন ভারতাত্মার চিরন্তন বাণী, হিমালয়ের পবিত্র ধূলি ললাটে ধারণ করে অনুভব করেছেন হিমালয়-অধীশ্বর সর্বত্যাগী মহেশ্বরের কৃপাস্পর্শ। নিবেদিতার এই হিমালয়-প্রেম ও উন্মাদনাও অনেকের দুর্বোধ্য মনে হত। দেহত্যাগের আগে শেষবার বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র ও তাঁর ভাইপো অরবিন্দ বসুকে নিয়ে হিমালয়ে গেছেন কেদারনাথ-বদরীনাথ দর্শনমানসে। সারা পথই নিবেদিতা ভাব ও আবেগে তন্ময়! সঙ্গী দু’জন বিজ্ঞানমনস্ক, যদিও জগদীশচন্দ্র নিবেদিতার অন্তর্জগতের খবর রাখতেন, কিন্তু অরবিন্দ বসু নিবেদিতার এই ধরনের ভাবাবেগকে কুসংস্কার বলেই মনে করতেন এবং নিবেদিতার মতো তেজস্বিনী মেয়ের এই ধরনের কুসংস্কার দেখে তিনি কম বিস্মিত হতেন না। শেষে একদিন সকালে নিবেদিতার ললাটে বিভূতির তিলক-কাটা দেখে অরবিন্দ আর থাকতে না পেরে এমন কুসংস্কারের কারণ সরাসরি জিজ্ঞেস করে ফেললেন তাঁকে। নিবেদিতা কিন্তু সহজভাবে উত্তর দিলেন—‘সকালে আমার সঙ্গে একদিন পথ চলো দেখি, কিন্তু কোনও প্রশ্ন কোরো না। প্রশ্ন নিরর্থক। শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রীতির দৃষ্টিতে আশপাশের সবকিছু দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। কারণ পথে যা কিছু দেখবে সবই আত্মনিবেদনের এক-একটি মুদ্রামাত্র। দেখছ না, অখণ্ড মণ্ডলাকারে পরমগুরু শিবই এখানকার অধীশ্বর? তাঁকে এখনও চেনোনি তুমি। এখন চিনতে চেয়ো না। আগে গুরু খুঁজে নাও, দিশারী হয়ে তিনিই জীবনের পথে ধাপে ধাপে তোমায় এগিয়ে নিয়ে যাবেন।...’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE