Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

পাশে বসিয়ে বলুন, ‘শিখিয়ে দে’

স্মার্টফোনের ব্যবহারগত কলাকৌশল বড়দের থেকে অনেক বেশি দ্রুততার সঙ্গে আয়ত্ত করে ফেলছে নবীন প্রজন্ম। অপেক্ষাকৃত কমবয়সী শহুরে বাবা-মায়েরা তাদের সঙ্গে সময়ের তাল মেলাতে পারলেও গ্রাম-মফস্সলের অধিকাংশ মাঝবয়সী অভিভাবকেরা পদেপদে পিছিয়ে পড়েছেন সন্তানদের তুলনায়। ফলে একটা ‘জেনারেশন গ্যাপ’ যেমন ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে, তেমনই ছোটদের মনস্তত্ত্বে একটা আধিপত্যের বোধ জন্ম নিচ্ছে সকলের অজান্তে। লিখছেন কাজী নুদরত হোসেন।প্রথম দৃশ্য ট্রেনের কামরার। মধ্যবয়সী ভদ্রলোক সপরিবার ট্রেনের যাত্রী। দশ-বারো বছরের ছেলেটা উপরের বাঙ্কে বসে। মোবাইল ফোন নিয়ে ‘গেম’ খেলছে

মোবাইল এখন শিশুদের হাতেও। ছোট থেকেই টেকনোলজি নির্ভর তারা। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম

মোবাইল এখন শিশুদের হাতেও। ছোট থেকেই টেকনোলজি নির্ভর তারা। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম

শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:৩২
Share: Save:

প্রথম দৃশ্য ট্রেনের কামরার। মধ্যবয়সী ভদ্রলোক সপরিবার ট্রেনের যাত্রী। দশ-বারো বছরের ছেলেটা উপরের বাঙ্কে বসে। মোবাইল ফোন নিয়ে ‘গেম’ খেলছে। সেই কামরারা যাত্রী ছিলাম আমিও। কাউকে ফোন করার তাগিদে ছেলের কাছে ফোনটা চেয়েছিলেন বাবা। কিশোর ছেলে কিছুটা সময় নিয়ে ফেরত দিল বটে, তবে ভদ্রলোক পড়লেন ফাঁপরে। হেঁকে বললেন, ‘কোথায় কী করে রেখেছিস, কনট্যাক্ট-লিস্ট বেরোচ্ছে না যে!’ উপরের অবস্থান থেকে খানিকটা বিরক্ত সুরেই ছেলে উত্তর দিল, ‘ ধুর্ আমাকে দাও ফোনটা। কিচ্ছু জানো

না তুমি…!’

পরের দৃশ্যটা, এক ছা-পোষা মধ্যবিত্ত পরিবারের অন্দরের। গৃহকর্তা পুরনো মোবাইলেই চালিয়ে এসেছেন এত দিন। কিন্তু আর চলছিল না। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে এবং কিছুটা পরিবারের চাপেও পুরনো ফোন বদলে নতুন স্মার্ট-ফোন কিনে আনতে হয়েছে। আনলেন তো বটে, সেটা চালাবেন কী করে! এর কায়দা-কানুন যে আলাদা রকমের। তবে, অজ্ঞতার পরোয়া করেন না মনে মনে। মেয়ে আছে যে! ক্লাস এইটে পড়লে হবে কী, এ সব ব্যাপারে চোস্ত! হাতে ধরে ধরে, দিন কয়েক দেখিয়ে দিলো বাবাকে। একটু একটু করে শিখলেনও সব। হরেক কিসিমের ‘অ্যাপ ডাউনলোড’, ‘ভিডিও শেয়ারিং’, ‘জিবি-এমবি ডেটা’-র হিসেব, ফেসবুক-এ ‘ফ্রেন্ড-আনফ্রেন্ড’ করা, হোয়াটসঅ্যাপ-এ ‘কমেন্ট’ লেখা, কত সব কাণ্ড-কারখানা। ‘‘মাঝে মাঝে আমি ভুল করে তালগোল পাকালে বিরক্তও হয় ছেলে। বলে, ‘তোমাকে আর শেখানো গেল না দেখছি!’— গল্পচ্ছলে এক দিন বলছিলেন সেই ভদ্রলোক।

একটা বিজ্ঞাপন এখন হামেশাই দেখায় টিভির পর্দায়। বাবা ছেলেকে বিরক্ত সুরে বলছেন, সে এখনও কেন বিদ্যুতের বিল দেয়নি। ‘ডিউ ডেট’ পেরিয়ে যাওয়ায় ছাড় মিলবে না। ছেলে তখন স্মার্টফোন নিয়ে খেলায় মগ্ন। ফোনের স্ক্রিন থেকে মুখ না তুলেই কিছুক্ষণের মধ্যে ছেলের জবাব বাবাকে, বিল দিয়ে দিয়েছি। কিছু ক্যাশব্যাকও পেয়েছি। বাবা শুনে থ!

উপরের তিনটি ঘটনাই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের টুকরো কিছু ছবি। এ রকম অজস্র ঘটনা ঘরে-বাইরে ঘটছে অহরহ। এগুলোতে গুরুত্ব দেওয়ার মতো আছেই বা কী! গুরুত্ব আছে কি নেই, সে পরের কথা। তবে, এই আপাত সাধারণ ঘটনাগুলো থেকে যে বার্তাটা ধ্বনিত হচ্ছে তা হল, এখন জীবনের জরুরি এই ক্ষেত্রটার বিষয়ে বড়রা জানেন কম, ছোটরা জানে বেশি। ছোটদের কাছ থেকেই বড়দের শিখে নিতে হচ্ছে এই প্রযুক্তি-নির্ভর জীবনের নানা জরুরি দিক। সময়ের অদ্ভূত এক ক্রান্তিকাল হয়তো এই ভাবে অতিক্রম করছি আমরা। এমনিতে ছোটদের থেকে বড়দের শেখার মধ্যে কোনও ‘ছোট’ ব্যাপার নেই। ‘শিক্ষা’ বস্তুটা যে কেউ যে কারও কাছ থেকেই নিতে পারেন। শিক্ষায় ‘ছোট-বড়’ হয় না। তবু একটা আশঙ্কা মাঝেমধ্যে মনের ভিতরে টোকা দিয়ে যায়। ছোট-বড়র এই জানা না-জানার দ্বন্দ্ব কি কোনও সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখে যাবে সমাজক্ষেত্রে? ছোটদের মনস্তাত্ত্বিক বিন্যাসে বড়দের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাগত আধিপত্যের ভিত্তিটা নড়বড়ে হতে হতে কি দুর্বল

হচ্ছে ক্রমেই?

স্মার্টফোনের ক্ষেত্র যদি সীমায়িত থাকত জীবনের নির্দিষ্ট কোনও গণ্ডীতে, নিদেনপক্ষে রেডিও বা টিভির মতো, তা হলে বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিলেও চলত। কিন্তু, জীবনযাপনের ক্ষেত্রে এর প্রসার যে ভাবে উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে, তাতে এই দুশ্চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলা যাচ্ছে না। যোগাযোগ আর বিনোদনের অপেক্ষাকৃত ছোট্ট পরিসরে আর বাঁধা নয় মোবাইল ফোনের ব্যবহার। শপিং, বুকিং, বিলিং, রিডিং, ব্যাঙ্কিং—নিত্যকার জীবনের প্রায় সব আবশ্যকীয়তার বিস্তৃত অঙ্গনে তার অবাধ প্রবেশ ঘটেই চলেছে। আর সে কারণেই আশঙ্কাটা দানা বাঁধছে বেশি।

মধ্যবিত্ত পরিবারবৃত্তে, যেখানে বাবা-মা ও তাদের সন্তান-সন্ততিদের সহাবস্থান, সেখানে পারস্পরিক সম্পর্কের একটা টানাপড়েন কিন্তু সকলের অজান্তেই চলে আসছে বা আসতে চলেছে। অন্তত ছোটদের মনোজগতে বড়দের প্রতি আনুগত্য-প্রদর্শনের শর্তটার সামনেই প্রশ্নচিহ্ন খাড়া হয়ে যাচ্ছে। আদর্শ পারিবারিক জীবনচর্চায় বড়দের খবরদারিত্বের একটা যুক্তিগ্রাহ্য ভিত্তি থাকে। এই খবরদারিত্ব শুধু বয়সের দাবিতেই প্রতিষ্ঠিত হয় না, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার দাবিও সেখানে সমান কার্যকর থাকে। ছোটদের মন সংশয়হীন সারল্যেই মেনে নেয় বাবা-কাকা, মা-মাসিদের জ্ঞানের আধিপত্য। সেই আধিপত্য নিয়েই নিজেদের জীবন-অভিজ্ঞতার আলোয় তারা ছোটদের রাস্তা দেখান। ‘আমাদের বাবা-কাকারা আমাদের থেকে বেশি জানেন’—মনে গেঁথে থাকা এই দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েই আমাদের পরিবারের শিশু-কিশোরেরা বড় হয়। তাঁদের অনুগত হয়। পরিবারের অনুশাসন মেনে চলে। বড়দের সম্মান দেয়। নিজের ভাল-মন্দের ভাবনার দায় অভিভাবকেরই হাতে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্তে বড় হতে থাকে ছোটরা। পরিবার-পরিসরে আবর্তিত এই শৃঙ্খলাই সমষ্টিগত ভাবে সমাজশৃঙ্খলার রূপ নেয়।

কিন্তু স্মার্টফোনের ব্যবহারগত কলাকৌশল বড়দের থেকে অনেক বেশি দ্রুততার সঙ্গে আয়ত্ত করে ফেলছে নবীন প্রজন্ম। অপেক্ষাকৃত কমবয়সী শহুরে বাবা-মায়েরা তাদের সঙ্গে সময়ের তাল মেলাতে পারলেও গ্রাম-মফস্সলের অধিকাংশ মাঝবয়সী অভিভাবকেরা পদেপদে পিছিয়ে পড়েছেন সন্তানদের তুলনায়। ফলে একটা ‘জেনারেশন গ্যাপ’ যেমন ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে, তেমনই ছোটদের মনস্তত্ত্বে একটা আধিপত্যের বোধ জন্ম নিচ্ছে সকলের অজান্তে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে, একজন শিক্ষার্থী ক্লাসে তার শিক্ষকের সম্পর্কে এই ধারণাকে মনে বদ্ধমূল রাখে যে, আমার ‘মাস্টারমশাই আমার থেকে বেশি জানেন। একক পরিবার তথা বৃহত্তর সমাজক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া কাজ করছে না। অনেক প্রবীণকেই আক্ষেপ করতে শুনেছি, ‘‘নাতি-নাতনিরা এখন আর পাত্তাই দেয় না। বলে, ধুর তোমরা কিছু বোঝ না। স্মার্টফোনের খুঁটিনাটি আমরা এত বুঝবই বা কী করে?’’ তাঁরাও মনে করেন, ছোটদের একাংশের মনে এই ধারণা ধীরে ধীরে গজিয়ে উঠছে যে, বড়রা আমাদের মতো অতটা জানেন না, আমরা জানি বেশি।

রেডিও বা সাধারণ টিভির ব্যবহারের ক্ষেত্রে এমন ভাবে ঘটতে দেখা যায়নি। অধিকাংশ পরিবারে টিভি দেখার ক্ষেত্রে বড়দের কর্তৃত্ব অনেকটাই কায়েম ছিল। কিছু ক্ষেত্রে না থাকলেও, তার পরিসর স্মার্টফোনের মতো এত ব্যাপক ছিল না। সবশেষে বলা যায়, অনেকেই মনে করছেন, এটি একটি বিশেষ সময়ের সামাজিক চালচিত্র। ছোটদের থেকে শিখে নেওয়ার মধ্যে নিজেকে ছোট ভাবার কোনও কারণ নেই। বরং তাদের পাশে বসিয়ে ‘আমাকে এটা দেখিয়ে তো’ বললে তাদের ভিতরেও কোথাও যেন অভিভাবকত্ব কাজ করবে। যা আখেরে ছোটকে বড় করে তুলবে।

ছোটদের বড় করে তোলা তো বড়দেরই কর্তব্য, তাই না!

লেখক কয়থা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক (মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Health Medical Health Hazards
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE