Advertisement
E-Paper

সমাজতন্ত্র আর ফ্যাসিবাদই দুই জমানার মধ্যে ফারাক

ভারতের গরিব চিরকালই মরিয়া প্রমাণ করে যে রাজনীতির ময়দানে সে মরে নাই। না হলে, প্রায় অর্ধশতকের ব্যবধানে, পরমাণু বিস্ফোরণ-মঙ্গলযান-চন্দ্র অভিযান-শাইনিং ইন্ডিয়া-ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৭ ০০:৪০
কাছে: শরণার্থী পরিবারের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী। কোচবিহার, ৩১ অগস্ট ১৯৭১।

কাছে: শরণার্থী পরিবারের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী। কোচবিহার, ৩১ অগস্ট ১৯৭১।

ভারতের গরিব চিরকালই মরিয়া প্রমাণ করে যে রাজনীতির ময়দানে সে মরে নাই। না হলে, প্রায় অর্ধশতকের ব্যবধানে, পরমাণু বিস্ফোরণ-মঙ্গলযান-চন্দ্র অভিযান-শাইনিং ইন্ডিয়া-ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি পেরিয়ে এসেও কি ‘গরিবি হটাও’-এর স্লোগান এতখানি রাজনৈতিক তাৎপর্য ধরে রাখতে পারে যে নরেন্দ্র মোদী অবধি গরিবের মসিহা হয়ে উঠতে আকুল হবেন? ভারতে গরিব অবিনশ্বর, তার গরিবিও— অতএব, রাজনীতিতে ‘গরিবি হটাও’-এর রেটরিকও অমলিন।

তবে, ‘গরিবি হটাও’ কী ছিলেন আর কী হইয়াছেন, সেই খোঁজ করলে ইন্দিরা গাঁধীর ভাষ্যের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর ভাষ্যের একটা মস্ত ফারাক চোখে পড়বে। সত্যি বলতে, মোদী তাঁর ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতি ফুলিয়ে স্লোগানটি আওড়াতে আরম্ভ করেছেন বটে, কিন্তু তার জন্য ঠিক কী কী নীতি গ্রহণ করছেন, বলেননি। তাঁর অবশ্য বিস্তারিত বলার প্রয়োজনও নেই, তাঁর মুখের কথাই যথেষ্ট। শুধু তাঁর মুখের কথাতেই ভারতের গরিবগুর্বোরা বিশ্বাস করে ফেলতে পারে যে ডিমনিটাইজেশনে আসলে গরিবের স্বার্থরক্ষা হয়েছে। তবে ধরে নেওয়া যায়, শুধু নোটবদল নয়, গরিবি হটানোর জন্য তাঁর তূণে অন্য অস্ত্রও রয়েছে— জনধন-আধার-মোবাইলের জ্যাম ট্রিনিটি, মেক ইন ইন্ডিয়া, স্কিল ইন্ডিয়া। স্টার্ট আপ ইন্ডিয়ার সমাবেশে গিয়ে তিনি নতুন ব্যবসায়িক উদ্যোগের মাধ্যমে আরও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার কথা বলেন, আর কাশ্মীরে তরুণদের বলেন টেররিজম ছেড়ে ট্যুরিজমের দিকে মন দিতে। উত্তরপ্রদেশে অবশ্য শ্মশান আর কবরস্থানের তুলনা করলেই কাজ চলে যায়।

ইন্দিরার অস্ত্র আলাদা ছিল। তাঁর রাজনৈতিক ভাষ্যে গরিবি দূর করার যে পন্থাগুলোর কথা ফিরে ফিরে আসত, সেগুলোকে কয়েকটা বড় ভাগে ভাগ করে ফেলা যায়— কর্মসংস্থান বৃদ্ধি; গরিবের ব্যবহার্য ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি; জিনিসপত্রের দাম গরিব মানুষের আওতার মধ্যে রাখা; শিক্ষা স্বাস্থ্য, পুষ্টির মতো সামাজিক পণ্যকে মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা। শুধু আর্থিক বৃদ্ধিই যে যথেষ্ট নয়, সেই বৃদ্ধির সুফল যাতে সব মানুষের কাছে পৌঁছয় তা নিশ্চিত করতে হবে— ইন্দিরা গাঁধীর রাজনৈতিক ভাষ্যের একেবারে কেন্দ্রস্থলে ছিল এই কথাটি। তার ক’আনা বাস্তবায়িত হয়েছিল, সেই প্রশ্নে ঢোকার প্রয়োজন নেই, তবে এটুকু বলে রাখা যায়, যে জিনি কো-এফিশিয়েন্ট দিয়ে অসাম্য মাপা হয়, ইন্দিরা গাঁধীর আমলে তা আজকের তুলনায় ঢের কম ছিল। উন্নয়নের সূচকেও সমতুল দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের ফারাক ছিল আজকের চেয়ে বেশ খানিকটা কম।

ইন্দিরার সঙ্গে মোদীর ভাষ্যের মূল ফারাক হল গরিবি হটানোর কাজে রাষ্ট্রের ভূমিকায়। ইন্দিরা গাঁধীর ভাষ্যে যেখানে রাষ্ট্র সর্বময়— গরিবের জন্য কর্মসংস্থান থেকে তার নিত্যব্যবহারের পণ্য উৎপাদনের দিকে, এবং সেই পণ্য সস্তায় জোগান দেওয়ার দিকে নজর দেওয়া, সব দায়িত্বই রাষ্ট্রের চওড়া কাঁধে— সেখানে নরেন্দ্র মোদীর ভাষ্যে রাষ্ট্র আশ্চর্য রকম অনুপস্থিত। নোটবদলের মতো কাজে তার যদিও বা দেখা মেলে, কিন্তু সে কাজ মূলত নিয়ন্ত্রণের। যেখানে এগিয়ে গিয়ে গরিবদের জন্য কাজ করার কথা, মোদীর দুনিয়ায় সেখানে রাষ্ট্র বেমালুম গরহাজির। তাঁর ভাষ্য আসলে কতকগুলো যন্ত্রের কথা বলে, যার মাধ্যমে বাজার অর্থনীতির পথেই গরিবের কাছে উন্নয়ন পৌঁছবে। তাতে রাষ্ট্রের কোনও ভূমিকা নেই।

এক অর্থে এটাই স্বাভাবিক। ১৯৭১ থেকে ২০১৭-এ পৌঁছনোর পথে ভারত ১৯৯১ সালকে পেরিয়ে এসেছে। উদার অর্থনীতির আনন্দযজ্ঞে আজ রাষ্ট্রের নিমন্ত্রণ না থাকারই কথা। মিলটন ফ্রিডম্যানের দুনিয়ায় যতটুকু না করলেই নয়, রাষ্ট্র তার বাইরে কিচ্ছুটি করে না। কিন্তু, নরেন্দ্র মোদী তো সেই দুনিয়ার বাসিন্দা নন। বরং, গত তিন বছর সাক্ষী দেবে, তিনি মনেপ্রাণে রাষ্ট্রবাদী, নিয়ন্ত্রণবাদী। তা হলে, তাঁর ‘গরিবি হটাও’ ভাষ্যের সঙ্গে ইন্দিরা গাঁধীর এমন অসেতুসম্ভব দূরত্ব কেন?

এই দূরত্ব আসলে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের। দোহাই, ফ্যাসিবাদকে গালি ভাববেন না। এটা নিছকই একটা রাজনৈতিক মতবাদ। ফ্যাসিবাদও রাষ্ট্রের আধিপত্যে বিশ্বাসী। বস্তুত, রাষ্ট্রনায়কের আধিপত্য— একা তিনিই পারেন গোটা দেশের, জাতির অবস্থা বদলে দিতে, এই কথাটা যে নায়ক বিশ্বাস করেন এবং করান। মোদী সেই আধিপত্যকামী রাষ্ট্রনায়ক। ফ্যাসিবাদের যে কোনও সংজ্ঞায় তিনি প্রায় খাপে খাপে মিলে যান। কাজেই, তাঁকে পড়তে হলে ফ্যাসিবাদের পরিসরে পড়াই বিধেয়। সমাজতন্ত্রের মতো ফ্যাসিবাদও বিশ্বাস করে, রাশ থাকা উচিত রাষ্ট্রের হাতেই। কিন্তু, সে রাশ সামাজিক নিয়ন্ত্রণের। কে কী খাবার খাবে, স্কুলে কোন মন্ত্রপাঠ হবে, রেস্তোরাঁর মেনুতে ডিশের খাবারের পরিমাণ লিখে দিতে হবে কি না, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে এই প্রশ্নগুলোকে। হিটলারের জার্মানিতে রাষ্ট্র বলে দিত, ইহুদিরা আসলে সম-মানুষ নয়। মুসোলিনির ইতালিতে রাষ্ট্র ঠিক করে দিত, সাধারণ মানুষ পাস্তা খাবে কি না। অর্থনীতির রাশ কিন্তু থাকত বাজারের হাতেই। অর্থনীতির লাগাম ধরার তাড়না সমাজতন্ত্রের। অতএব, ইন্দিরা গাঁধীর ভারতে ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রায়ত্ত হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদীর ভারতে বিলগ্নিকরণের রেকর্ড স্থাপিত হয়। কাজেই, ইন্দিরা গাঁধী গরিবি হটানোর দায়িত্বখানা যে ভাবে রাষ্ট্রের কাঁধে তুলে দিতে পারতেন, নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে তা অসম্ভব।

অর্থনীতির লাগাম বাজারের বদলে রাষ্ট্রের হাতে থাকলেই গরিবের ভোল বদলে যায়, ইতিহাস তেমন দাবি করার উপায় রাখেনি। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ভরাডুবির উদাহরণ না খুঁজতেই মেলে। তার পক্ষে একটাই কথা বলার— অর্থনীতির ভারও যেহেতু রাষ্ট্রেরই হাতে, ফলে গরিবের জন্য কিছু করার, অন্তত সেই চেষ্টাটা যাতে দৃশ্যমান হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রনায়কের থেকেই যায়। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে সেই ঝামেলা নেই। সেখানে অর্থনীতির দায়িত্ব বাজারের। গরিবের ভাল হবে ট্রিকল ডাউন তত্ত্বের চুঁইয়ে পড়া উন্নয়নে। অতএব, রাষ্ট্রনায়ক বিন্দুমাত্র দায়িত্ব স্বীকার না করেই গরিবের মঙ্গলের কথা বলে চলতে পারেন। নরেন্দ্র মোদীও যেমন বলছেন। বাজারের বাইরেও যেটুকু করার ছিল, সেই দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলেছেন সন্তর্পণে— কর্মসংস্থান যোজনা গতি হারিয়েছে, খাদ্যের অধিকার আইন নিয়ে উচ্চবাচ্য নেই, শিক্ষা-স্বাস্থ্যে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ কহতব্য নয়।

যেহেতু কোনও দায়িত্ব না নিয়েই আর্থিক উন্নতির কথা বলা চলে, সেই কারণেই ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রনায়কের মুখে এই স্লোগান আরও বেশি বিপজ্জনক। ‘অচ্ছে দিন’ নিয়ে আসার খুড়োর কলের টানে আরও অনেক নিয়ন্ত্রণ, রাষ্ট্রের অনেক অযথা খবরদারি আমরা মেনে নিতে থাকি। রাষ্ট্রের তৈরি করে দেওয়া বিভাজিকাগুলোকে শিরোধার্য করে নিতে থাকি। তার ফল কী হয়, ইতিহাস জানে।

হয়তো আমরাও শিখব। বহু মূল্যে।

Socialism fascism regimes
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy