সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে আদালতের (ভূতপূর্ব) মহিলা-কর্মীর আনীত অভিযোগের যাচাই প্রক্রিয়ার শেষে সিদ্ধান্ত ঘোষিত: অভিযোগের কোনও সারবত্তা নাই। আইন মোতাবেক হয়তো এই বিষয়ে ইহাই শেষ কথা। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের সামগ্রিক বিচারব্যবস্থার প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রাখিয়াও বলিবার অবকাশ আছে— এই সিদ্ধান্তে সমস্ত প্রশ্নের অবসান হইল কি? শুরু হইতেই সমগ্র প্রক্রিয়াটি লইয়া ক্রমাগত নূতন নূতন প্রশ্ন মাথা তুলিয়াছে। যেমন, অভিযোগের কথা প্রকাশ পাইবার পরেই প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত একটি বেঞ্চ এই অভিযোগকে অসত্য বলিয়া ঘোষণা করে। সংশ্লিষ্ট নির্দেশে স্বাক্ষর না করিয়া প্রধান বিচারপতি অবশ্যই সুবিবেচনার নজির রাখিয়াছেন, কিন্তু আগাম এমন বিবৃতি প্রকাশিত না হইলেই হয়তো আরও ভাল হইত। আবার, অভিযোগ সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্য গঠিত অভ্যন্তরীণ কমিটিতে (অভিযোগকারিণীর আপত্তিতে) পরিবর্তন সাধনের পরেও এই কমিটির গঠন লইয়া একাধিক প্রশ্ন থাকিয়া গিয়াছে। যেমন, অভিযোগ যাঁহার আচরণ লইয়া, বর্তমান বিচারপতিরা কর্মসূত্রে তাঁহার অনুবর্তী— এই পরিস্থিতি এড়াইবার জন্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের এই অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়াই সঙ্গত হইত না কি? অন্য একটি বিষয়ও প্রাসঙ্গিক। প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ উঠিলে কী করণীয় সেই বিষয়ে আইন নীরব, কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে অনুরূপ অভিযোগের মোকাবিলায়, সুপ্রিম কোর্টেরই ‘বিশাখা নির্দেশিকা’ অনুসারে, যে পদ্ধতি অনুসৃত হয়, এ ক্ষেত্রেও তাহা অনুসরণের পক্ষে নীতিগত যুক্তি ছিল জোরদার। সেই যুক্তিতে অনুসন্ধান কমিটিতে অন্তত এক জন ‘প্রতিষ্ঠান-বহির্ভূত’ সদস্য থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরা সেই প্রয়োজনও মিটাইতে পারিতেন। একই যুক্তিতে কমিটির নেতৃত্বে এক জন মহিলা অধিষ্ঠিত থাকিলেই শ্রেয় হইত। প্রশ্ন উঠিয়াছে কমিটির কর্মপ্রক্রিয়া লইয়াও। সেই প্রক্রিয়ায় ভরসা রাখিতে না পারিবার অনুযোগ জানাইয়া অভিযোগকারিণী মধ্যপথে সরিয়া দাঁড়ান। এই ঘটনাপরম্পরাকে অনুসন্ধান প্রক্রিয়া তথা বিচারব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতার অনুকূল বলা চলে কি?
প্রধান বিচারপতির সম্পর্কে উত্থাপিত অভিযোগের সত্যতা লইয়া প্রশ্ন থাকিতেই পারে, ইহার পিছনে কাহারও কোনও দুরভিসন্ধি থাকাও অ-সম্ভব বলা চলে না। কিন্তু সেই কারণেই তো যথাযথ অনুসন্ধান দ্বিগুণ জরুরি। অভিযোগ অসত্য বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলিয়া প্রমাণিত হইলে অপরাধীর উচিত শাস্তিও সুবিচারের আবশ্যিক শর্ত। মহামান্য আদালত ও বিচারপতিদের নিরপেক্ষতা ও বিবেচনাবোধ সম্পর্কে সংশয়ের কোনও অহেতুক সংশয়ের প্রশ্নই উঠিতে পারে না, প্রশ্ন এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণত পদ্ধতিগত। বস্তুত, ভারতীয় গণতন্ত্রের মর্যাদা ও সুস্বাস্থ্য এত দিক হইতে ক্রমাগত বিপন্ন হইয়া চলিয়াছে যে, জনসাধারণের চোখে আদালত সেই বিপদের মোকাবিলায় সর্বাপেক্ষা, অনেক ক্ষেত্রে একমাত্র নির্ভরযোগ্য শক্তি হিসাবে গণ্য। সেই কারণেই বিচারবিভাগের সম্পর্কে সমাজের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসে যেন সামান্যতম আঘাতও না লাগিতে পারে, তাহা নিশ্চিত করা গণতন্ত্রের স্বার্থেই অত্যাবশ্যক। সেখানেই নীতি ও পদ্ধতির গুরুত্ব। সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগের বিচারে সংশ্লিষ্ট নীতি ও পদ্ধতিকে শতকরা একশো ভাগ গুরুত্ব দেওয়া হইলে বিচারবিভাগ তথা গণতন্ত্রের উপর নাগরিকদের আস্থা কতখানি জোরদার হইতে পারে, মহামান্য বিচারপতিদের তাহা বুঝাইয়া বলিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। আইনের চোখে সকলেই সমান, এই আপ্তবাক্যটি যে ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় অক্ষরে অক্ষরে মানিয়া চলা হইতেছে, তাহা দেশ ও দুনিয়ার সমক্ষে সুস্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত হইবে, ইহাই গণতান্ত্রিক ভারতের প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা থাকিয়া গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy