Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
North Bengal

কখনও উৎসব, কখনও চড়ুইভাতি, উত্তর কাঁপছে প্রাণান্তকর শব্দদূষণে

নির্দিষ্ট আইন রয়েছে, নিয়মনীতি রয়েছে। সে সব অগ্রাহ্য করে চলছে ধারাবাহিক শব্দদূষণ। লিখছেন দীপায়ন পাঠকবিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব বা শোভাযাত্রায় শীতের এই মরসুমে পিকনিকে মাইকের অত্যাচারে জেরবার হন মানুষ। রেহাই নেই বিভিন্ন জীবজন্তু, পশুপাখিদেরও।

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২০ ০২:০৪
Share: Save:

পশ্চিমবঙ্গে ৯০ ডেসিবেলের বেশি শব্দ নিষিদ্ধ এবং তা সৃষ্টি করা দণ্ডনীয় অপরাধ। পটকা ফাটানোর কারণে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু পটকা ছাড়াও চারদিকে যে এত শব্দদূষণ, তার বিরুদ্ধে কোনও আওয়াজ শোনা যায় না কেন!

বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব বা শোভাযাত্রায় শীতের এই মরসুমে পিকনিকে মাইকের অত্যাচারে জেরবার হন মানুষ। রেহাই নেই বিভিন্ন জীবজন্তু, পশুপাখিদেরও। এক কথায় সমগ্র প্রাণিকুল আক্রান্ত এই শব্দদানবদের হাতে। ডিজে নামের নতুন এক অসুরের হাতে উৎপীড়িত জনগণ। শুধু মানুষই নয়, কুকুর-বেড়াল, বিভিন্ন পশুপাখি অত্যাচারিত হচ্ছে এই ডিজে নামের অসুরের হাতে। বহু বৈজ্ঞানিক সৃষ্টি মানুষের হিতের জন্য হলেও তার অপপ্রয়োগের নমুনাও দেখা যায়। ডিনামাইট আবিষ্কারের পর ব্যবহৃত হয়েছিল পাথর ভেঙে রাস্তা তৈরি করার জন্য। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, মানুষ মানুষকে মারার জন্য সেই অস্ত্র ব্যবহার করে চলেছে। ঠিক তেমনই ডিজে তৈরি করা হয়েছে উন্নত মানের শব্দ প্রক্ষেপণের জন্য। আর এখন সেটা হিতে-বিপরীত হয়ে উঠেছে।

সম্প্রতি কোচবিহারের পুলিশ প্রশাসন পিকনিকের উপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। যার মধ্যে রয়েছে ডিজে বন্ধ করার বিষয়টিও। কিন্তু বাস্তবে ছবিটা সম্পূর্ণ বিপরীত। কেউ কোনও নিয়ম মানছেন না। যথেচ্ছ ভাবে চলছে ডিজের ব্যবহার। পিকনিক শুধু বাড়িতে হয় না। পিকনিক পার্টি পৌঁছে যাচ্ছে বিভিন্ন নদীর ধারে, জঙ্গলে বা সংরক্ষিত এলাকায়। ফলে, সেখানকার জীববৈচিত্রে এর ক্ষতিকর প্রভাব ভীষণ ভাবেই পড়ছে। স্থিতি হারাচ্ছে সেখানকার পশুপ্রাণীরা। পাখিরা হয়ে যাচ্ছে আশ্রয়হীন। এর বাইরেও রয়েছে আরও সমস্যা।

চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে চলছে। ফলে, ভারতে বাড়ছে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা। বেশির ভাগ বাড়িতেই বয়স্ক মানুষ আছেন। আবার আনেক বাড়িতেই রয়েছে শিশুরা। বর্তমানে বিয়েবাড়ি এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে ডিজের ব্যবহার। এর ফলে শহর বা গ্রামের মানুষজনের ভীষণ অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সারারাত ধরে চলছে ডিজে বাজিয়ে নাচগান। একজনের আনন্দ অন্য জনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সাধারণ মানুষ তো বটেই, শিশু , বৃদ্ধ এবং অসুস্থদের উপর এর প্রভাব ভয়ঙ্কর।

কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। প্রতিদিন কোনও না কোনও উৎসব লেগেই আছে। শীত এলেই বেড়ে যায় এই উৎসবের মাত্রা। কীর্তন থেকে শুরু করে জলসা। সার্কাস থেকে ম্যাজিক এবং পিকনিক। শীত এলেই এদের রমরমা। এতদিন এইসব অনুষ্ঠানে মুলত লাউডস্পিকারের চল থাকলেও ইদানীং প্রায় সব ক্ষেত্রেই চলছে ডিজে বক্সের ব্যবহার। এই সময়টাতেই সমস্ত স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা। ফলে, ভীষণ অসুবিধার সন্মুখীন হতে হয় পড়ুয়াদের। বড়রা কোনও ভাবে অবস্থা সামাল দিতে পারলেও ছোটদের পক্ষে তা ভীষণ বিড়ম্বনার।

মানুষের কান শব্দের ব্যাপারে যথেষ্ট সংবেদনশীল। তীব্র শব্দ কানের পর্দায় বেশ জোরে ধাক্কা দেয়, যা কানের পর্দাকে নষ্টও করে দিতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে এর ক্ষতিকর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে। শিশু বয়সে শব্দের অধিক তারতম্যের জন্য বৃদ্ধ বয়সে কানের বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়। বিভিন্ন অঞ্চলে শব্দদূষণের কারণ অনুসন্ধান করা হয়েছে এবং দেখা গিয়েছে যে, যে সমস্ত অঞ্চলে দূষণের মাত্রা বেশি, সেখানে নানা ক্ষতিকর প্রভাব মানুষের মধ্যে পড়ছে। যেমন, দূষণ-প্রভাবিত এলাকার মানুষের মেজাজ খিটখিটে হচ্ছে। আচরণে অস্বাভাবিকতা তৈরি হচ্ছে এবং মানসিক উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে। মানুষ ক্লান্ত, মানসিক অবসাদগ্রস্ত ও কাজে অমনোযোগী হয়ে উঠছেন। বয়স্ক মানুষের স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। বধির হওয়ার মতো খবরও পাওয়া যাচ্ছে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, শব্দবাজি এবং ডিজের আওয়াজে মানুষের শরীরে মারাত্মক প্রভাব পড়ে এবং শ্রবণশক্তি নষ্ট হতে পারে। হৃদ্‌রোগীদের পক্ষেও জোর শব্দ ভীষণ ভাবে ক্ষতিকর।

শব্দদূষণ এ যুগের এক জলজ্যান্ত সমস্যা। দিনদিন এ সমস্যা আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছে। শব্দদূষণের সমস্যা আমাদের জীবনের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর থেকে মুক্তি পেতে অতিরিক্ত শব্দের উৎসগুলো কমানো দরকার। রাস্তায় যত যানবাহন আছে, সেগুলো যদি অকারণ হর্ন বাজানো বন্ধ করে, তবে শব্দদূষণের মাত্রা কমবে। শব্দদূষণ বন্ধ করতে মিউজিক সিস্টেমের আওয়াজ আস্তে করা উচিত। ডিজে এবং লাউডস্পিকারের ব্যবহার সম্পূর্ণ রূপে বর্জন করতে হবে। বিয়েবাড়ির শোভাযাত্রায় বা উৎসবের শোভাযাত্রায় ব্যান্ড বাজানো, পটকা ফাটানো, ডিজে বক্সের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পিকনিকে শব্দদূষণ বন্ধ করতে হবে। সবাইকে শব্দদূষণ সংক্রান্ত আইন মেনে চলতে হবে এবং এই গোটা বিষয়টি নিয়ে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। শব্দদূষণ উত্তরবঙ্গে এক অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছেছে। নানা ভাবে আমাদের উচিত এ বিষয়ে আরও তৎপর হওয়া এবং সাধারণ মানুষকে এই শব্দাসুরের অত্যাচার থেকে রক্ষা করা। তা না হলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

North Bengal Sound Pollution
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE