সঙ্কোশের তীরে কুমারগ্রাম।
উত্তরবঙ্গের বহু নদী ও এলাকা নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও আমাদের রাজ্য ও অসমের সীমা নির্ধারণকারী অপরূপ সুন্দরী সঙ্কোশ ও তার আশেপাশের অঞ্চল কেন যেন একটু ব্রাত্য। অথচ ভুটানের পুনাখায় পাচু আর মাচুর মিলিত প্রবাহ স্বর্ণকোশ বা সঙ্কোশের যাত্রাপথে জড়িয়ে রয়েছে এই অঞ্চলের কত ইতিহাস! ভুটানের ভাষায় ‘চু’ মানে নদী। ‘পা’ অর্থে পিতা এবং ‘মা’ অর্থে মাতা। অর্থাৎ পিতা ও মাতা সদৃশ দুই নদী মিলে সৃষ্টি হয়েছে সঙ্কোশের।
কোচবিহার রাজবংশের আদি পুরুষ হরিদাস বা হাড়িয়া মণ্ডলের রাজ্যাভিষেকের বর্ণনায় যেমন সঙ্কোশের কথা পাওয়া যায় তেমনই মহারাজা নরনারায়ণের সময় এই নদীর গতিপথকে চিহ্নিত করে কামরূপ ও কোচবিহারের সীমানা নির্ধারণ করা হত। ১৫৮৬ সালে এই অঞ্চলে আসা ইংরেজ ব্যবসায়ী রালফ ফিচের বর্ণনাতেও সঙ্কোশের আভাস পাওয়া যায়। অতীতের সেই গতিপথ খানিকটা পরিবর্তন করলেও সঙ্কোশের গুরুত্ব আজও কমেনি। কালজানি ও রায়ডাকের মিলিত ধারা সঙ্কোশের সঙ্গে মিশে গদাধর নামে অসমে প্রবেশ করেছে।
আজকের সঙ্কোশ বলতে অবশ্য ডুয়ার্সের কুমারগ্রাম ব্লকের ছবি চোখে ভাসে। প্রাচীন এই জনপদের ইতিহাস আজ আমরা ভুলতে বসেছি। অথচ ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময় পোয়াতু দাস, দেবেন দাস, অবিনাশ দাস, সুনীল সরকার, দেওয়ান রায় প্রমুখের নেতৃত্বে এই কুমারগ্রাম থানা দখল করে স্বাধীন ভারতের পতাকা তোলা হয়েছিল। তারও আগে অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে কুমারগ্রামে মঘা দেওয়ানি, পশুপতি কোঙারের সরকারি হাট বয়কট করে কুলকুলির হাট স্থাপন নিঃসন্দেহে সাড়া জাগানো ঘটনা ছিল। দেশপ্রেমিক সতীন সেনকে বন্দি করা হয়েছিল এখানকার থানায়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালেও কুমারগ্রামের চা-বাগানগুলির শ্রমিক আন্দোলন উল্লেখযোগ্য।
অত্যন্ত প্রাচীন এই জনপদ আঠারো দুয়ারের অন্যতম এবং এখান থেকে খুব সহজে কালিখোলা হয়ে চলে যাওয়া যায় ভুটানে। ভোট-রাজা নিযুক্ত কাঠাম বা বিচারক ও জমিদার হংসদেব কোঙারের পরিবারের নাম থেকে সৃষ্ট কুমারগ্রাম ছবির মতো সুন্দর। রায়ডাক ও সঙ্কোশ নদীর মাঝের এই তরঙ্গায়িত ভূখণ্ড অসাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশ, সবুজ চা-বাগান এবং শাল-সেগুন-জারুল-চিকরাশির অরণ্যে সমৃদ্ধ।
রাজধানী কলকাতা থেকে দূরত্বের বিচারে কুমারগ্রাম হল রাজ্যের সব থেকে দূরের ব্লক বা থানা। কালিখোলার অদূরেই ছবির মতো সুন্দর ভুটানের গ্রাম লাহমোয়জিঙ্খা আর সেখানকার উচ্চভূমি থেকে নীচ দিয়ে বয়ে চলা সঙ্কোশ ক্যালেন্ডারের ছবির মতো সুন্দর। ওপারে অসম ও ভুটানের নিচুলার পার্বত্য অঞ্চল। লাহমোয়জিঙ্খা থেকে থিম্পুর দূরত্ব সড়ক পথে ঘন্টা ছয়-সাত, কিন্তু এপথে বিদেশিদের অনুমতি মেলে না। কালিখোলার এসএসবি ক্যাম্পে প্রয়োজনীয় অনুমতি নিয়ে শুকনো নদীখাত ও খানিকটা অরণ্য পার হয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় লাহমোয়জিঙ্খা। তবে ওপারের গ্রামে যেতেও লাগবে ভুটান সেনার প্রয়োজনীয় অনুমতি। ছোট্ট জনপদ লাহমোয়জিঙ্খা তার সুন্দর প্রকৃতি, বিদ্যালয়, বাড়িঘর, সামান্য কিছু দোকানপাট, দু-একটি হোম স্টে এবং সহজ-সরল মানুষজন নিয়ে ভীষণই আন্তরিক। এখন থেকে আর একটি পথ গেছে পুখুরিতে যেখানে হোলি উপলক্ষে সমবেত হন অসম, পশ্চিমবঙ্গ ও ভুটানের সাধারণ মানুষ, যদিও হোলি বাদে অন্য সময় পুখুরি যাওয়ার অনুমতি মেলে না।
নদীর নামেই চিহ্নিত ছোট্ট জনপদ সঙ্কোশ প্রসিদ্ধ তার চা-বাগানের জন্য। সঙ্কোশ চা-বাগান সহ কাছের কুমারগ্রাম, নিউল্যান্ড ইত্যাদি চা-বাগানগুলি উনিশ শতকের শেষ দিকে তৈরি হয়েছিল। সঙ্কোশ চা-বাগান ও চা-বাগান ঘিরে গড়ে ওঠা ছোট্ট জনপদ আক্ষরিক অর্থেই কসমোপলিটান। এই জনপদে রয়েছে ডুয়ার্সের বহু প্রাচীন বাড়ি যাদের বয়স শতাধিক। বেশ কিছু জনজাতির বাসও এই এলাকায়। সঙ্কোশ থেকে সামান্য দূরত্বে নিউল্যান্ড চা-বাগানের শেষ সীমায় ডুয়ার্সের আর এক বিখ্যাত নদী রায়ডাক। বাগানের উত্তরে বক্সার দুর্ভেদ্য অরণ্য। তবে পথ রয়েছে অরণ্যের ভেতর দিয়ে। এক সময় এই পথে পৌঁছে যাওয়া যেত জয়ন্তীতে। কিন্তু আজ সে পথ পরিত্যক্ত। কুমারগ্রাম চা-বাগানের এলাকা অনেকটা বিস্তৃত হলেও নিউল্যান্ড, সঙ্কোশ ও কুমারগ্রাম চা-বাগান এতটাই গায়ে গায়ে লাগোয়া যে তাদের সীমা নির্ধারণ মুশকিল হয়ে ওঠে। সঙ্কোশ তীরের কুমারগ্রাম ব্লক সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কিন্তু সে ভাবে বদলায়নি। অতীতের জয়ন্তী, নিউল্যান্ড হয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বলে কুমারগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগের অসুবিধা নিঃসন্দেহে এই এলাকার বড় সমস্যা। যে নিউল্যান্ড চা-বাগানে এয়ারস্ট্রিপ ছিল, সেই নিউল্যান্ড চা-বাগানকে আজ বহু দূরে থাকা এক বিচ্ছিন্ন এলাকা বলে মনে হয়।
একই কথা প্রযোজ্য সঙ্কোশের ক্ষেত্রেও। বক্সার অরণ্য অত্যন্ত কাছে হওয়ায় বনচরদের লোকালয়ে হঠাৎ আগমন এই অঞ্চলের আর একটি বড় সমস্যা। চা ব্যতীত সে ভাবে কোনও শিল্প না থাকায় কর্মসংস্থান বাড়েনি, ফলে অন্য রাজ্যে কাজ খুঁজতে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে কেবল। কুমারগ্রামে থাকা বাংলা ও হিন্দি মাধ্যম বিদ্যালয় থেকে প্রতি বছরই ভাল ভাবে উত্তীর্ণ হওয়া ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার জন্য এখনও বড় ভরসা কামাখ্যাগুড়ি বা আলিপুরদুয়ার। জাতীয় সড়ক ছাড়া আর কোনও বিকল্প না থাকায় কাছের শামুকতলা ঘুরপথে অনেকটা দূর। ফি বছর রায়ডাক, সঙ্কোশ-সহ অন্য নদীগুলির দুকূল ছাপিয়ে বন্যা ডেকে আনাটাও বিরাট সমস্যা। সঙ্কোশকে ঘিরে ইন্দো-ভুটান যৌথ সহায়তায় যে বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলছে তাতে অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে এই অঞ্চলের পরিবেশে বিরাট প্রভাব পড়তে চলেছে। এর ফল কী হবে তা অজানা হলেও আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে যে তা কখনোই পরিবেশের পক্ষে সদর্থক হবে না।
(লেখক কোচবিহার মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy