Advertisement
E-Paper

বারবার মনে হল, এই মানুষটি কবিকে নিকট থেকে দেখেছেন

ঠাকুর্দা কাঁধে বহন করেছিলেন কবিকে। বাবাও তাঁকে দেখেছেন। শিশির রবীন্দ্রনাথকে অনুভব করেন। লিখলেন অমিতকুমার দেশিশির দেখাচ্ছিলেন– আধুনিকতার প্রলেপ লেগেছে ঘরের দেওয়ালে, কিন্তু মূল্যবান ফটোগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঐতিহ্যের লাল রং মুছে নীল সাদা করা হয়েছে! কোথাও কোথাও নতুন রং চটে পুরনো লাল একটু একটু উঁকি দিচ্ছে। 

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:৪৬

শিশিরের পিতামহ ভীমলাল রাহুত কুইনাইন ফ্যাক্টরির কর্মী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রথম যখন মংপুতে আসছেন, রম্ভী থেকে ১২ কিলোমিটার রাস্তা তাঁকে পালকিতে করে নিয়ে আসা হয়। ভীমলাল সেই পালকি-বাহকদের একজন ছিলেন। শিশির এক অদ্ভুত উত্তরাধিকার নিজে নিজে অর্জন করেছেন! ঠাকুর্দা কাঁধে বহন করেছিলেন বিশ্বকবিকে, আর শিশির রাহুত বহন করছেন অন্তরে। তিনি রবীন্দ্রনাথকে চাক্ষুষ দেখেননি, তাঁর বাবা দেবীরাম রাহুত দেখেছিলেন। কিন্তু মংপুর রবীন্দ্রভবনে দাঁড়িয়ে আমার বারবার মনে হতে লাগল এই মানুষটি রবীন্দ্রনাথকে অনেক বেশি নিকট থেকে দেখে ফেলেছেন। দেয়ালে টাঙানো ফটোগুলো কী যত্নে দেখাতে দেখাতে যে ভাবে ফটোর মানুষগুলোর পরিচয় জানাচ্ছিলেন, একবারও মনে হচ্ছিল না, তাঁরা কেউ তাঁর অচেনা, অদেখা! তারই ফাঁকে খোলা গলায় গেয়ে উঠলেন —‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে।’

এক সময়ের জমজমাট সরকারি কুইনাইন ফ্যাক্টরি এখন বন্ধ। চারিদিকে একটা অদ্ভুত শূন্যতা। শিশির জানালেন—২০১৬ সাল থেকে এই বাসভবনের বিদ্যুৎ -সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে। দিনের আলো ডুবলেই মিশকালো অন্ধকারে ডুবে যায় রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি। শিশির দেখাচ্ছিলেন– আধুনিকতার প্রলেপ লেগেছে ঘরের দেওয়ালে, কিন্তু মূল্যবান ফটোগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঐতিহ্যের লাল রং মুছে নীল সাদা করা হয়েছে! কোথাও কোথাও নতুন রং চটে পুরনো লাল একটু একটু উঁকি দিচ্ছে।

এ লালে তো কোনও রাজনীতি ছিল না, তবু নীল সাদা করতেই হল? শিশির চুপ করে থাকলেন। ইশারায় ডাকলেন একটি ছোট্ট ঘরে। রংমিস্ত্রিদের বোধহয় নজর এড়িয়ে গেছে ঘরটি! রবীন্দ্রনাথের স্নানঘর। এখনও পুরনো টকটকে লাল। মানুষটা ছ’ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা ছিলেন। শিশির বলছিলেন—‘‘দেখুন তাঁকে ভেবেই কত ভাবনা দিয়ে তাঁরই শরীরের মাপে বাথটাবটা বানানো হয়েছিল। এমনকি মাথা রাখবারও পোক্ত জায়গা।’’

শিশির কথা বলতে বলতে অনায়াসে ফিরে যান রবীন্দ্রসঙ্গীতে, রবীন্দ্রকবিতায়। তাঁর কথা বলবার, গান গাইবার একটা নিজস্ব ভঙ্গিমা রয়েছে। তিনি মাথা কাত করে, চোখ বুজে আবার গাইতে লাগলেন—‘ছিল না প্রেমের আলো, চিনিতে পারনি ভালো / এখন বিরহানলে প্রেমানল জ্বলিয়াছে’, মংপুর ঘর জুড়ে কেমন যেন একটা কষ্ট ছড়িয়ে গেল। তারপর শিশির কি ভাবলেন পরিবেশ ভারি হয়ে যাচ্ছে? তাই কবিতায় ফিরে গেলেন—‘কুজ্ঝটি জাল যেই সরে গেল মংপুর / নীল শৈলের গায়ে দেখা দিল রংপুর/ বহুকেলে জাদুকর খেলা বহুদিন তার/ আর কোন দায় নেই লেশ নেই চিন্তার/ দূর বৎসর পানে ধ্যানে চাই যদ্দূর/ দেখি লুকোচুরি খেলে মেঘ আর রোদ্দুর।’

সামান্য ক’টি টাকা পান শিশির। সকাল সকাল চলে আসেন রবীন্দ্রনাথের টানে। ঘর প্রাঙ্গণ পরিষ্কার করেন, পর্যটকদের কাছে তুলে ধরেন মংপুর রবীন্দ্রনাথকে। ঘরে স্টোন সার্জারির পর রুগ্ণ স্ত্রী, ছেলে ক্লাস এইট-এ, মেয়ে কলেজে। সামান্য আয়ে জর্জরিত হলেও রবীন্দ্রনাথকে স্পর্শ করে তাঁর চোখে মুখে সব সময় এক অসামান্য প্রশান্তি। এখনও কী সুন্দর করে হাসতে জানেন মানুষটি। তাঁর টানেই অনেক পর্যটক বারবার এখানে আসেন। তাদের কেউ কেউ অনুরোধ করছেন—‘‘ওই গানটা করুন না শিশিরদা।’’

‘না’ নেই মানুষটার মুখে। যেন রবীন্দ্রনাথই তাঁকে বলে গিয়েছেন এ ভাবেই বাঁচতে হয়, শিশির এ গান গাইবার যোগ্যতর মানুষ—‘আমার চোখের চেয়ে দেখা, আমার কানের শোনা / আমার হাতের নিপুণ সেবা, আমার আনাগোনা / সব দিতে হবে। / আমার প্রভাত, আমার সন্ধ্যা হৃদয় পত্রপুটে/ গোপন থেকে তোমার পানে উঠবে ফুটে ফুটে। / তোমারি আনন্দ আমার দুঃখে সুখে ভরে/ আমার করে নিয়ে তবে নাও যে তোমার করে।/ আমার বলে যা পেয়েছি শুভক্ষণে যবে/ তোমার করে দেব তখন তারা আমার হবে—/ সব দিতে হবে।’

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

House Rabindra Nath Tagore
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy