Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Supreme Court

রাজনীতির কাজ

সিদ্ধান্ত সর্বোচ্চ আদালতের, কিন্তু কংগ্রেস-সহ বিরোধীদের অভিযোগ, উত্তরাখণ্ডের বিজেপি শাসিত সরকার এই মামলায় সংরক্ষণের অধিকারকে অস্বীকার করিয়া সওয়াল করিয়াছিল।

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২৩:৪১
Share: Save:

সরকারি চাকরিতে তফসিলি জাতি বা জনজাতির মানুষের জন্য সংরক্ষণ দিতেই হইবে— আদালত এমন কোনও আদেশ (ম্যান্ডেমস) জারি করিতে পারে না; এবং (অনগ্রসর শ্রেণির) কোনও ব্যক্তি পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের কোনও মৌলিক অধিকার দাবি করিতে পারেন না— উত্তরাখণ্ডের একটি মামলার নিষ্পত্তি করিতে গিয়া সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি এই রায় দিয়াছে। এবং রাজনীতির দরিয়ায় তুফান উঠিয়াছে। সিদ্ধান্ত সর্বোচ্চ আদালতের, কিন্তু কংগ্রেস-সহ বিরোধীদের অভিযোগ, উত্তরাখণ্ডের বিজেপি শাসিত সরকার এই মামলায় সংরক্ষণের অধিকারকে অস্বীকার করিয়া সওয়াল করিয়াছিল। বিজেপির পাল্টা বক্তব্য: উত্তরাখণ্ড সরকারের ২০১২ সালের একটি বিজ্ঞপ্তির সূত্রেই সুপ্রিম কোর্টের এই রায়, এবং সেই রাজ্যে তখন কংগ্রেসের সরকার ছিল। কংগ্রেসের সাংসদ রাহুল গাঁধী অভিযোগে বৃহত্তর মাত্রা যোগ করিতে তৎপর হইয়া বলিয়াছেন: দলিত ও অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ সংরক্ষণের সুযোগ পাইবেন, ইহা আরএসএস এবং বিজেপি সহ্য করিতে পারে না, সংরক্ষণের ধারণাটিই বর্তমান শাসকদের দুই চক্ষের বিষ। কথাটি অসত্য নহে। অদূর অতীতেই আরএসএস-এর কর্ণধার মোহন ভাগবত সংরক্ষণের যৌক্তিকতা লইয়াই প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন।

কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়টিকে এই রাজনৈতিক বিবাদের আবর্তে বিসর্জন দিলে অন্যায় হইবে। সংরক্ষণের উদ্দেশ্য এবং সাংবিধানিক মর্যাদা ও অবস্থান লইয়া বিতর্ক চলিয়াছে কার্যত সংরক্ষণ ব্যবস্থার সূচনা হইতেই। ১৯৬০-এর দশকে সুপ্রিম কোর্ট একটি মামলায় যে রায় দেয়, তাহার অন্যতম মর্মার্থ ছিল ইহাই যে, সংরক্ষণকে কেহ অধিকার হিসাবে দাবি করিতে পারেন না। পরবর্তী কালেও নানা প্রসঙ্গে বারংবার এই কথাটি উঠিয়া আসিয়াছে যে, সরকার চাহিলে নির্ধারিত অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের জন্য— শ্রেণি হিসাবে নহে, শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তি হিসাবে— সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও চাকরিতে যুক্তিসঙ্গত সংরক্ষণের আয়োজন করিতে পারে, সংবিধান সরকারকে সেই ক্ষমতা দিয়াছে। অর্থাৎ সংবিধানে সংরক্ষণ বিষয়ক ধারা বা অনুচ্ছেদগুলি চরিত্রে ক্ষমতা-প্রদায়ী বন্দোবস্ত (এনেবলিং প্রভিশন)। কিন্তু কোনও সরকার তেমন সংরক্ষণের সুযোগ দিবে কি না, তাহা সেই সরকারের বিচার্য, আদালত তাহাকে সে জন্য আদেশ দিতে পারে না।

বিপরীত যুক্তিও তুচ্ছ করিবার নহে। সামাজিক কারণে যাঁহারা ঐতিহাসিক বঞ্চনার শিকার, তাঁহাদের যথার্থ সমানাধিকার দিবার উদ্দেশ্যেই সংরক্ষণের আয়োজন। অর্থাৎ, সংরক্ষণের ধারণাটি সাংবিধানিক সমানাধিকারের বিচ্যুতি বা ব্যতিক্রম নহে, তাহার অঙ্গ। তাহা হইলে সংরক্ষণ কেন মৌলিক অধিকারের বিষয় হইবে না? বিতর্ক চলিবেই। হয়তো ভবিষ্যতে মহামান্য আদালত আবারও তাহার নিরসনে ব্রতী হইবে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ার পরিণাম যেমনই হউক, সমান অধিকারের দাবিতে সুযোগবঞ্চিত ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী সরব, সক্রিয় ও সংগঠিত হইবেন, ইহা গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্বাভাবিক ধর্ম। প্রশ্ন কেবল অধিকারের (রাইটস) নহে, ন্যায্যতারও (জাস্টিস)। বস্তুত, সংবিধানে মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি সামাজিক ন্যায়ের গুরুত্বকেও মর্যাদা দেওয়া হইয়াছে ‘নির্দেশাত্মক সূত্রাবলি’র অধ্যায়ে। এবং লক্ষণীয়, কালক্রমে সর্বোচ্চ আদালতের মীমাংসায় সেই অধ্যায়ের বিভিন্ন সূত্র মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত হইয়াছে। এই উত্তরণ বৃহত্তর রাজনৈতিক বাস্তব হইতে বিচ্ছিন্ন নহে। অধিকারের ধারণা এবং সেই অধিকার অর্জনের প্রক্রিয়া, দুইই হাড়েমজ্জায় রাজনৈতিক প্রশ্ন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে ভীম আর্মির প্রধান চন্দ্রশেখর আজাদ যখন সংরক্ষণের অধিকারের দাবিতে রাজনৈতিক সংগ্রামের ডাক দেন, তাহা এই প্রশ্নের রাজনৈতিক চরিত্রটিকেই বুঝাইয়া দেয়। রাজনীতির কাজ রাজনীতিকেই করিতে হইবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Supreme Court Quota Reservation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE