Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই নাগরিকত্ব আইন!

ভারতের মতো বহু মত বহু পথের দেশে মুখে বলব এক দেশ এক আইনের কথা, শ্বাস নেব ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’-এর, অথচ, সংখ্যার জোরে নস্যাৎ করব ধর্মনিরপেক্ষতাকে! তা হলে তার প্রতিক্রিয়ার দায়টা নেব না কেন? লিখলেন সাহাবুদ্দিন।অস্কার-জয়ী সাউন্ড ডিজাইনার রসুল পুকুট্টির চোখে, এটাই আমার কাছে বদলে যাওয়া ভারতের ছবি।

ছবি পিটিআই।

ছবি পিটিআই।

শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:২৩
Share: Save:

প্রশ্ন যখন আইনের তখন ধর্মীয় উৎপীড়নের আইনগ্রাহ্য প্রমাণ কেউ দাখিল করতে পারবে?স্বভাবতই, শুধু মুসলমান নয়, আজ তাই পথে নেমেছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ মানুষ, যাঁরা বিশ্বাস করেন ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতীয় সংবিধান তথা 'ভারত-আত্মা'র অহংকার, ভারতীয় গণতন্ত্রের চালিকাশক্তি। এ লড়াই তাই নিছক হিন্দু আর মুসলমানের লড়াই নয়, এ হল নিরপেক্ষ ভারত বনাম অবশিষ্ট ভারতের লড়াই।

সেকুলার ভারতের জন্য লড়াইয়ে এমন অনেক রূপোলি রেখা চোখে পড়ছে, যা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবাসীর মহার্ঘ আশ্বাস। দিল্লির ঐতিহাসিক জামা মসজিদের মূল ফটক থেকে বেরিয়ে আসছেন কোনও ইমাম নন, বেরিয়ে আসছেন অম্বেডকরপন্থী দলিত নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ। সিএএ-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে তাঁর হাতে গীতা কিংবা কোরান নয়, রয়েছে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান।

অস্কার-জয়ী সাউন্ড ডিজাইনার রসুল পুকুট্টির চোখে, "এটাই আমার কাছে বদলে যাওয়া ভারতের ছবি।" আর এই বদলে যাওয়া ভারতের ছবি সত্যি করতে মুসলমানদেরও বেরিয়ে আসতে হবে কট্টরপন্থা ছেড়ে। আধুনিক প্রগতিশীল মন নিয়ে আরও বেশি করে সম্পৃক্ত হতে হবে এ দেশের মাটি ও কৃষ্টির সঙ্গে। হতে হবে প্রকৃত ভারতীয় মুসলমান।

এর পরেও কথা থেকে যায়। উত্তর-পূর্ব ভারতের অহমিয়া ও অন্য জনজাতির সিএএ-বিরোধিতাকে কোন ক্যাটেগরিতে ফেলা যাবে? যে নাগরিকত্ত্ব সংশোধনী আইন উত্তর-পূর্ব ভারতে মুসলমান বাদে বাংলাদেশি তথা বাঙালি হিন্দু-সহ অন্যদের নাগরিকত্ব সুনিশ্চিত করবে বলা হচ্ছে, তা ১৯৮৫-র অসম চুক্তি-বিরোধী। কারণ, সেখানে ভিত্তিবর্ষ ছিল ১৯৭১, ২০১৪ নয়। উত্তর-পূর্বের বিক্ষোভ আন্দোলন তাই জাতীয় নাগরিক পঞ্জি-বিরোধী নয়, নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী। অসম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, অরুণাচল-সহ উত্তর-পূর্বের সিএএ-বিরোধিতা তাই অবশিষ্ট সেকুলার ভারতের লড়াই থেকে চরিত্রগত ভাবে আলাদা। উত্তর-পূর্বের আশঙ্কা, অন্য ভারতীয়, বিশেষ করে বাঙালিদের এই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান জনস্ফীতি তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার পক্ষে বিপজ্জনক।

কিন্তু ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে কয়েকটি বিশেষ অঞ্চল ছাড়া যে কোনও রাজ্যে সব ভারতীয়ের বসবাসের সাংবিধানিক অধিকার আছে। তাই, মহা ফাঁপরে এখন কেন্দ্রের শাসকদল।

যে সিএএ অবশিষ্ট ভারতে তুলছে মুসলিম-বিরোধী হিন্দুত্ববাদী হাওয়া, সেই সিএএ-রই বিরোধিতা করে হিংসা ছড়াচ্ছে উত্তর-পূর্বে, তছনছ হচ্ছে শাসকদলের বিধায়কের আবাস। এক দিকে, সিএএ, এনআরসি করে হিন্দু তথা অমুসলিম ভোট একছাতার তলায় আনার কদর্য চেষ্টা, অন্য দিকে হিন্দুত্বকে ছাপিয়ে ভাষা, কৃষ্টি ও জাতিসত্তার আবেগ থেকে থেকে 'বঙ্গাল খেদা' আন্দোলনের পুনরুজ্জীবন। আর ধর্মকে ছাপিয়ে এই ভাষা-কৃষ্টির লড়াই প্রমাণ করে এ দেশ একরৈখিক হিন্দুত্বকে কোনও দিন মান্যতা দেয় না। অথচ, ধর্মীয় মেরুকরণকে মাথায় রেখেই পাশ হল নাগরিকত্ব আইন, যা মনে করায় অর্থনৈতিক ভাবে ধ্বস্ত উনিশ শতকের তিরিশের দশকের জার্মানিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পাশ হওয়া Nuremberg Act-কে। মনে করায় জার্মানির ড়চল (Reich Citizenship Law), যার আদলে এই জাতীয় নাগরিক পঞ্জি। ইহুদী নিধনকে সামনে রেখে জার্মান জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে ইহুদিনিধনকে সে দিন সমর্থন করেছিলেন আজকের শাসকদলের আদর্শ সাভারকর ও গোলওয়ালকর।

সিএএ-এর সঙ্গে এনআরসি-কে এমন পরিকল্পনা করে সম্পৃক্ত করা হয়েছে যে, চট করে তাকে ধরা মুশকিল। সহজ করে বললে চেতন ভগতের কথায় বলতে হয়, “এনআরসি হল সেই বিমান যাতে প্রত্যেক ভারতীয়কে উঠতে বাধ্য করে বলা হবে নিজেকে ভারতীয় প্রমাণ করতে এবং তা না পারলে বিমান থেকে ফেলে দেওয়া হবে। আর সিএএ হল সেই মহার্ঘ লাইফ জ্যাকেট, যা বাঁচার জন্য মুসলিম আর ইহুদি বাদে বাকি অমুসলিমদের দেওয়া হবে।"

অবশ্য সেই লাইফ জ্যাকেটও তাদের বাঁচাতে কতটা কাজে আসবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কারণ, এই জ্যাকেট পরা মানেই নিজেকে শরণার্থী ঘোষণা করা। আর শরণার্থীর নাগরিকত্ব পাওয়ার রাস্তা মুখে যাই বলা হোক না কেন, আদৌ সহজ নয়। সেক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনীতি, অসাধু আর্থিক লেনদেনের সম্ভাবনা, সর্বোপরি আইনগত দীর্ঘসূত্রতা, কোনও কিছুই অস্বীকার করা যায় না। সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই সিএএ!

প্রশ্ন উঠতেই পারে, ভারত কি তা হলে চিরকাল সবার জন্য অবারিত 'ধর্মশালা' হয়েই থাকবে? নিশ্চয়ই না।কিন্তু সেখানে ধর্ম বা এথনিসিটি বিশেষ ছাড় পাবে কেন? যে কোনও সভ্য দেশের মতো ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সাংবিধানিক কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে থাকা আইনগত ও নৈতিক পরিসরকে সঠিক ভাবে বাস্তবায়নের জন্য রয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কাঠামো, যার কাজ হবে সতর্ক, সংবেদী, মানবিক ও নিরপেক্ষ। তারাই ঠিক করবে কে বিদেশি, কে ভূমিপুত্র, কে শরণার্থী আর কে অনুপ্রবেশকারী। এ এক দীর্ঘমেয়াদী চলমান প্রক্রিয়া। শুধু ভোটের কথা মাথায় রেখে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় যদি শুরু হয় সাজো সাজো রব আর সেটা করতে গিয়ে যদি তার হঠকারিতার মাসুল গুনতে হয় লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে, তখন সেই প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, সদিচ্ছা ও সততা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে না কি?

দুর্ভাগ্য, বিরোধিতার নামে হিংসা ছড়িয়ে কিছু দুষ্কৃতীর হাতে রেল-সহ অন্য রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির বিরাট ক্ষতি আমাদের দেখতে হচ্ছে, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়। নিন্দনীয় তাকে আটকাতে না পারার প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্ব ও অপদার্থতা। আরও নিন্দনীয় তাকে আটকাতে না পেরে, কিংবা গ্রেফতারে ব্যর্থ হওয়ার ক্রোধ থেকে আইনের রক্ষকদের তরফে দেখামাত্র গুলি বা বদলা নেওয়ার অগণতান্ত্রিক নিদান। কিন্তু সবচেয়ে যা দুর্ভাগ্যজনক হল, শুধু পোশাক দেখে একটা সম্প্রদায়কে ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে ফেজ টুপি-লুঙ্গি সন্ত্রাসের কথা।

অনেকে আবার ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার প্রসঙ্গ টেনে গোটা একটা সম্প্রদায়কেই ভয়ানক হিংস্র ও উগ্র বলে দেগে দিচ্ছেন। তাঁদের একবারও মনে পড়ছে না আসানসোলের ইমাম রাশিদির ফেজ টুপি পরা মুখ, যিনি মাত্র কয়েক মাস আগেই নিজের ছেলের নৃশংস হত্যার পরও ব্যতিক্রমী সংযমের নজির রেখে হিংসা রুখেছিলেন।

একুশ শতকের ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে দেশভাগের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতাকে নতুন করে উস্কে দিয়ে যাঁরা রাজনীতি করছেন, তাঁদের অনেকেরই যুক্তি, ধর্মের ভিত্তিতেই যখন দেশভাগ হয়েছে তখন ধর্মীয় মেরুকরণে দোষ কোথায়? কিন্তু যে কোটি কোটি মুসলমান দেশভাগ মেনে নিতে না পেরে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ভারতকে ভালবেসে, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার সাংবিধানিক রক্ষাকবচে আস্থা রেখে থেকে গেলেন এ দেশে, তাঁদেরকে যদি সেই ধর্মীয় মেরুকরণই দেখতে হয়, তা সে শাসক, বিরোধী যে দলের কাছেই হোক, তার চেয়ে পরিহাসের আর কী হতে পারে?

আমরা কি ভুলে যাব জাতীয় কংগ্রেসের ৫৩তম অধিবেশনে সভাপতি হিসেবে মৌলানা আজাদের সেই দৃপ্ত উচ্চার, “I am a part of the indispensable unity that is Indian nationality, I am indispensable to this noble edifice and without me this splendid structure of India is incomplete. I am an essential element which has gone to build India. I can never surrender this claim.”

এর মধ্যে যে গভীর বিশ্বাস, জাতিসত্তা নির্মাণের অংশীদারত্বের যে দাবি ও অহংকার, তাকে অস্বীকারের সাধ্য কার?

আশার কথা, সংখ্যার জোরে তাকে অস্বীকারের ধৃষ্টতা ইতিহাস ক্ষমা করে না। হিটলারের স্যুইসাইড, হিন্দু-বিদ্বেষী ঔরঙ্গজেবের শোচনীয় পতন, নিরাশ্রয় শরণার্থীদের মুখের উপর অমানবিক প্রাচীর তোলার হোতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সম্প্রতি মার্কিন সেনেটে ইম্পিচমেন্ট, সবই ইতিহাসের নির্মম পরিহাস।আর সংখ্যা? তার চেয়ে বড় মরীচিকা আর কে? সে তো এই ছিল, এই নেই। আর কে না জানে এই সব কিছুকে গর্ভে ধারণ করেই ইতিহাস নিজেকে রিপিট করে চলে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Politics Citizenship Amendment Act CAA
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE