Advertisement
E-Paper

ফিতে কাটার নেতারা ও গণতন্ত্র

নাম লিখে ফিতে কেটে জনগণের করের টাকায় যা করা হচ্ছে, তা আসলে খ্যাতি উৎপাদনের ফিকিরমাত্র। জনকল্যাণের সঙ্গে তার বিন্দুমাত্র যোগ নেই।

তূর্য বাইন

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৯ ০০:১৫

শেক্সপিয়র লিখেছিলেন, হোয়াটস ইন আ নেম, নামে কী আসে যায়? আজ হয়তো তিনি এমন কথা বলতেন না। কিছু দিন আগেই আমরা দেখলাম, একটি সরকারি প্রকল্পের শিলান্যাস-ফলকে নিজের নাম দেখতে না পেয়ে ক্ষিপ্ত বিজেপি সাংসদ শরদ ত্রিপাঠী পূর্ত দফতরের বাস্তুকার এবং নিজেরই পার্টির স্থানীয় বিধায়ক রাকেশ সিংহের সঙ্গে কী ভাবে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এমন একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে দু’জন আইনপ্রণেতা একে অপরকে শুধুমাত্র চটি ও চপেটাঘাতে আপ্যায়িত করেই ক্ষান্ত হননি, সঙ্গে যে সব দেবভাষা বর্ষণ করেছিলেন, তা এতই অশালীন যে ইন্টারনেটে ভিডিয়ো ক্লিপটির ওই অংশগুলি ‘মিউট’ করে দেওয়া হয়েছে।

সাহিত্যে কুম্ভীলকবৃত্তি একটি প্রাচীন ব্যাধি। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে শুধু সাহিত্য নয়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষস্থানীয়রা জননির্মাণ থেকে শুরু করে নানা সামাজিক প্রকল্প স্রেফ নাম বদল করে আপন কীর্তি বলে জাহির করার নির্লজ্জ প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করেছেন। এর ফলে রাস্তা হোক বা সেতু, হাসপাতাল হোক বা সরকারি কার্যালয়, একই উদ্যোগ বারংবার বিভিন্ন ক্ষমতাশালী ব্যক্তিবর্গ উদ্বোধন করে নিজের নামটি সেই সৃষ্টির সঙ্গে অন্বিত করার চেষ্টা করছেন।

এই যেমন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাজ্য প্রশাসনকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে গত ৬ ফেব্রুয়ারি শিলিগুড়ি সার্কিট বেঞ্চটি উদ্বোধন করেন বলে অভিযোগ। প্রধানমন্ত্রীর এহেন আগ্রাসন যে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন ও নিজের নামপ্রচারের অসংসদীয় পদক্ষেপ, তাতে সন্দেহ নেই। আবার গত ৯ মার্চ ওই একই সার্কিট বেঞ্চের উদ্বোধন করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হয়তো তিনি তাঁর হকের কাজই করেছেন, তবু, একই সার্কিট বেঞ্চ দ্বিতীয় বার উদ্বোধন?

৭ মার্চ দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানায় হাতানিয়া দোয়ানিয়া নদীর উপর নির্মিত সেতুটি রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস উদ্বোধন করলে একই বিতর্ক শুরু হল। ওই সেতুটি নাকি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতীন গডকড়ীর উদ্বোধন করার কথা ছিল। কয়েক মাস আগে আসানসোলের রেল-সেতুর একাধিক বার উদ্বোধনকে ঘিরেও একই বিতর্ক মনে পড়ে।

একই রাস্তা, সেতু, সরকারি ভবন কিংবা অন্য যে কোনও সরকারি উদ্যোগ ভিন্ন ভিন্ন ‘মাননীয়’র দ্বারা বার বার উদ্বোধনের নজির এ দেশে ভূরি ভূরি। আলাদা নামও চাই সে জন্য। ‘শিলান্যাস’, ‘অধিকাঠামো উদ্বোধন’, ‘কাজ শুরু’, ‘জনসাধারণের জন্য উন্মুক্তকরণ’, বাহানার শেষ নেই!

স্রেফ নামের কারণেই অনেকগুলি কেন্দ্রীয় প্রকল্প এ রাজ্যে পরিত্যক্ত হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রকল্প ‘আয়ুষ্মান ভারত’, ‘স্বচ্ছ ভারত মিশন’ সহ একগুচ্ছ কেন্দ্রীয় প্রকল্প এ রাজ্যে ব্রাত্য, অথবা ভিন্ন নামে প্রচলিত। একই কারণে রাজারহাট-নিউটাউন ‘স্মার্ট সিটি’র সুবিধা (নাকি বাধ্যতামূলক জলকর আরোপের অসুবিধা?) থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

তবে অভিযোগ উভয়ত। কেন্দ্র এবং রাজ্য, উভয়ের বিরুদ্ধে কিছু কিছু প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে সেগুলি নিজেদের নামে চালাবার অভিযোগ নিয়ে রাজ্য তথা দেশের রাজনীতি সরগরম। ফলক-সংস্কৃতিতেও সম্প্রতি এক মারাত্মক রোগের প্রাদুর্ভাব। এ রাজ্যে ঐতিহ্যশালী সরকারি ভবনগুলি থেকে মূল দ্বারোদ্ঘাটক বা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপকদের নামের ফলক সরিয়ে দিয়ে সেখানে ‘নবরূপে’ উদ্বোধক/দ্বারোদ্ঘাটকের নামে পাথরের ফলক বসানো হচ্ছে, যাতে নামগন্ধী অতীতের ছিটেফোঁটাটুকুও চিরতরে হারিয়ে যায়।

গত অগস্ট মাসে রাজস্থান সরকার এক সার্কুলারে কড়া নির্দেশিকা জারি করেছে, সে রাজ্যে সরকারি আমলারা কোনও জননির্মিতি উদ্বোধন করতে তো পারবেনই না, উপরন্তু প্রস্তরফলকে নিজেদের নাম যুক্ত করতে বা উদ্বোধনকালে কোনও পুষ্পমাল্য গ্রহণ করতে পারবেন না। তাঁদের দায়িত্ব হল, জনপ্রতিনিধিরা যাতে সুচারু ভাবে উদ্বোধন সুসম্পন্ন করতে পারেন, তা নিশ্চিত করা। সত্যিই তো, রাজ্য কিংবা দেশের কোনও স্থায়ী সুকৃতির সঙ্গে বেতনভোগী কর্মীর নাম কখনও একই পঙ‌্ক্তিতে বসতে পারে? নাম জাহির অথবা প্রচারের গুড়টুকু যে একান্তই জনপ্রতিনিধিদের ভোগ্য, এই সারসত্যটাও গণদাসরা বুঝবেন না?

একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি। এক প্রতিবেশী হঠাৎ আমার দরজায় এসে কড়া নাড়লেন: তিনি নাকি একখানা পাকা ঘর করেছেন, তার ‘উৎপাদন’-এ আমাদের নিমন্ত্রণ! অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, উৎপাদন মানে? ভদ্রলোক বললেন, ওই যে, আজকাল রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, এমনকি প্রস্রাবখানা তৈরি হলে বড় মানুষরা ফিতে কেটে উৎপাদন করেন! হেসে বললাম, অ, আপনি উদ্বোধনের কথা বলছেন? তিনি বললেন, সে যা-ই বলেন, আসতে হবে কিন্তু। আমি ফিতেটিতে সব কিনে রেখেছি।

না, তিনিই সে দিন ঠিক বলেছিলেন। কথাটা আসলে ‘উৎপাদন’ই। নাম লিখে ফিতে কেটে জনগণের করের টাকায় যা করা হচ্ছে, তা আসলে খ্যাতি উৎপাদনের ফিকিরমাত্র। জনকল্যাণের সঙ্গে তার বিন্দুমাত্র যোগ নেই।

Indian Democracy Government Projects
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy