Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
‘আমিই সব জানি’ স‌ংস্কৃতি
Coronavirus

বিশেষ জ্ঞানের গুরুত্বকে খাটো করে চলার বিশ্বজোড়া প্রবণতা

কোভিড অতিমারি বিষয়ে নিদারুণ ধোঁয়াশা এবং বিশেষজ্ঞদের আপাত ব্যর্থতার সঙ্গে এই জ্ঞান-বিরোধিতার বিশেষ সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না।

অতীত: কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। ৩ নভেম্বর, ১৯৫৪। নিজস্ব চিত্র

অতীত: কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। ৩ নভেম্বর, ১৯৫৪। নিজস্ব চিত্র

অচিন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

আমার থেকে বেশি কেউ জানে না।” এটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি প্রিয় বাক্য। তাঁর নিজেরই দফতর আলো করা বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টাদের অপদস্থ করতেও তাঁর জুড়ি নেই। বিশ্ব জুড়েই এক রাজনৈতিক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যেখানে ‘বিশেষ জ্ঞান’-কে শুধু অপ্রয়োজনীয় ভাবা হচ্ছে না, যাঁরা আজীবন অনুশীলন করে বিশেষ জ্ঞান রপ্ত করেছেন সেই বিশেষজ্ঞদেরও ‘খেটে খাওয়া মানুষ’-এর বিপরীতে ঠেসে ধরে তাঁদের ওপর এক সুবিধাবাদী, চক্রান্তকারী, গণশত্রু ভাবমূর্তি চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘হার্ভার্ড না হার্ড ওয়ার্ক’ কটাক্ষ থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রাত্যহিক বক্তৃতায় দেখি এই প্রবণতারই বহিঃপ্রকাশ।

এই সব জ্ঞানবিরোধী অবস্থান বা প্রগতির উল্টো দিকে হাঁটার পরিণতিতে যে এই রাজনীতিকদের প্রতি জনসমর্থন কমে যাচ্ছে, তা কিন্তু নয়। জনসাধারণের বৃহত্তর অংশ যেন একে সমর্থনই করছেন। বিজ্ঞানী থেকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ থেকে অর্থশাস্ত্রী— যে কোনও পেশায় বিশেষ জ্ঞানের অধিকারীদেরই তাঁদের জ্ঞান বিষয়ে অবজ্ঞার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তবে এই প্রবণতাকে নতুন বলা যায় না একেবারেই। কোভিড অতিমারি বিষয়ে নিদারুণ ধোঁয়াশা এবং বিশেষজ্ঞদের আপাত ব্যর্থতার সঙ্গে এই জ্ঞান-বিরোধিতার বিশেষ সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। ইতিহাসের পাতায় দেখি, বৈজ্ঞানিক দর্শনের সঙ্গে, প্রগতিশীল সমাজচিন্তার সঙ্গে রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষমতার আকচা-আকচির আখ্যান কম নেই। সে সব দ্বন্দ্বে সমাজের গরিষ্ঠ অংশের সমর্থন বিজ্ঞানের দিকে যায়নি।

উনিশ এবং বিশ শতকে পশ্চিমি দুনিয়ায় মেধাজীবীদের মধ্যে ধর্মবিশ্বাসের মুঠো যখন আলগা হতে থাকল, এক নতুন ধরনের সংলাপের উত্থান হল, যার নাম আধুনিকতা। তথ্যভিত্তিক, বস্তুনিষ্ঠ, যুক্তিবাদী চর্চাই এই আধুনিকতার লক্ষণ। গত শতকের মাঝামাঝি সদ্য স্বাধীন হওয়া তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির রাষ্ট্রনায়কদের চেতনার মধ্যে এই আধুনিকতা কম-বেশি ছিল। এঁদের মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় পণ্ডিত নেহরু আর তানজ়ানিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নিয়েরেরে-র কথা। এই দুই রাষ্ট্রনায়কই আধুনিকতায় অন্য অনেকের থেকে এগিয়ে ছিলেন। রাষ্ট্রভাবনায় আধুনিকতাকে প্রভূত জায়গা দেওয়ার জন্যে নেহরুর কথা বিশেষ ভাবে বলতেই হবে। এই আধুনিকতা আগাগোড়া বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে চোবানো, যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলে। এই দৃষ্টিভঙ্গিই রাষ্ট্র পরিচালনায় তথ্য ও পরিসংখ্যানকে প্রধান গুরুত্বের জায়গায় নিয়ে এল। পরিসংখ্যান-সংগ্রহ ব্যবস্থাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে গড়ে তুলতে মহলানবিশ প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটকে যোজনা কমিশনের মাধ্যমে পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থা করলেন নেহরু, প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার যথাসম্ভব সুরক্ষিত রেখে।

এই আধুনিকতা ও তথ্য-যুক্তি-বিশ্লেষণভিত্তিক উন্নয়ন ও প্রশাসনিকতা, যা নেহরু ও মহলানবিশের চিন্তার কেন্দ্রে ছিল— সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে। রাষ্ট্রকে ‘কম্যান্ডিং হাইট’-এ রাখতে গিয়ে কিছু অবাঞ্ছিত পরিণতিও এড়ানো যায়নি। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র, বিশেষজ্ঞ ও জনগণের মধ্যে যে ভাব বিনিময়ের এবং সংলাপের প্রয়োজন ছিল, তা দেখা যায়নি। ফলে এলিট নীতি-নির্ধারক আর জনসাধারণের দূরত্ব যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গিয়েছে। তথাকথিত মেধাসম্পদের শ্রেণি বিভাজন ভাঙা যায়নি। অর্থনৈতিক উন্নয়ন যে গতিতে হবে বলে আশা ছিল তা হয়নি, দারিদ্র হ্রাসের গতিও ছিল মন্থর। তবুও, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে প্রতিষ্ঠানগুলি অপরিহার্য মনে হয়েছিল, তাদের পাকাপোক্ত ভিত্তিতে গড়ে তোলার চেষ্টা ছিল। কোনও প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা দীর্ঘ সময় ধরে কষ্টসাধ্য পথে অর্জন করতে হয়। কলকাতার আইএসআই, বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এই আধুনিকতার ফসল। এ ছাড়াও রয়েছে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার অজস্র প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়।

কিন্তু এ সবই যে হেতু সরকারি অনুদানে পুষ্ট, তাই রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দলগুলি কম-বেশি মনে করে এসেছে, জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চাও তাদের নির্দেশিত পথেই চলবে। তার সঙ্গে যোগ্য সঙ্গতকারী আমলাতন্ত্র। ফলে উৎকর্ষ ধরে রাখতে যে স্বাধীনতার প্রয়োজন, তা এই প্রতিষ্ঠানগুলি তেমন পায় না। অশোক রুদ্র রচিত প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের জীবনী পড়লে আন্দাজ পাওয়া যায়, নেহরুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও তাঁকে কী পাহাড়প্রমাণ বাধা প্রতিনিয়ত ঠেলে যেতে হয়েছে। ভারতের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় আইএসআই-এর অবদানকে সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে কত শত কৌশলের সাহায্য নিতে হয়েছে।

জ্ঞানচর্চায় শ্রদ্ধাশীল সেই রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে আজ আমরা বিপরীত মেরুতে এসে পৌঁছেছি। আইসিএমআর-এর মতো প্রতিষ্ঠানকে যখন ১৫ অগস্টে ভ্যাকসিন ভূমিষ্ঠ হবে বলে ঘোষণা করতে হয়, বিজ্ঞানের পক্ষে সে বড় সুখের সময় নয়। এই পরিবর্তনকে দু’দিক থেকেই দেখতে হবে। এক দিকে সাধারণ ভাবে রাজনীতিকদের মধ্যে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিরোধিতা এবং বিশেষজ্ঞ-বিরোধিতার গোষ্ঠী মানসিকতা। বিশেষজ্ঞের মতামতকে গুরুত্ব না দেওয়াটা তাঁরা যেন আত্মপ্রত্যয়ের প্রকাশ হিসেবে দেখেন। রাজনীতির কুশলী কারবারিরা বিলক্ষণ জানেন, এই কৌশল খুবই কার্যকর। অন্য দিকে, বিশেষজ্ঞরাও তাঁদের দায়িত্ব পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে পারেন না। জ্ঞানচর্চার জগৎটি তো সমাজবিচ্ছিন্ন কোনও অস্তিত্ব নয়। সেখানেও আছে ক্ষমতার দাপাদাপি, কায়েমি স্বার্থ। বিশেষ জ্ঞানের গুরুত্বকে খাটো করার সংস্কৃতিকে জ্ঞানের কারবারিরাও অনেক সময়ে পুষ্টি জুগিয়ে থাকেন। টিভির পর্দায় মুহুর্মুহু মুখ দেখা যায়, এমন এক শল্য চিকিৎসক করোনাভাইরাস বিষয়ে মতামত দিতে গিয়ে বলেন যে ছাত্রবয়সে তাঁরা এপিডেমিয়োলজি বিষয়টিকে একেবারেই গুরুত্ব দিতেন না। ঠিকই, এপিডেমিয়োলজি বিষয়টিতে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করে যাঁরা ‘কমিউনিটি মেডিসিন’-এ শিক্ষক-গবেষক হয়েছেন, তাঁদের এই দুঁদে ডাক্তারবাবুরা নিম্নবর্গের বলে মনে করেন। অথচ যত দূর জানি, সংক্রমণ ও অতিমারি বিষয়ে এক জন এপিডেমিয়োলজিস্টের যে বিশেষ জ্ঞান থাকার কথা, তা এক জন শল্য চিকিৎসকের থাকার কথা নয়, যদি আমরা বিশেষজ্ঞতাকে মর্যাদা দিই। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, কোভিড নিয়ন্ত্রণে গঠিত কমিটি থেকে সান্ধ্য টিভির আসর, কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের সেখানে কদাচিৎ দেখা যায়। দেখা যায় চিকিৎসা-বিপণনে অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নয়।

তবে স্বীকার করতেই হবে, ইন্টারনেটের প্রভাবে জ্ঞানের এক ধরনের সামাজিকীকরণ ঘটে গিয়েছে। অনেকেই বলবেন, বিশেষজ্ঞের মতকে অত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। জ্ঞান তো এখন হাতের মুঠোয়। আমি কোন জ্ঞানকে প্রাধান্য দেব, তা আমিই ঠিক করতে পারি। জ্ঞানের এই তথাকথিত সুষম বণ্টনের ফলে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত বিশেষ জ্ঞানের আধিপত্য ভাঙার সুযোগ অনেক বেড়েছে। ক্ষমতাসীন জ্ঞানকে প্রশ্ন করে তার বিকল্পের অনুসন্ধানই তো প্রগতি। অনেক সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান এবং লোকপ্রজ্ঞার দ্বন্দ্ব থেকেও ইতিবাচক জ্ঞান উঠে আসতে পারে।

তবে বিশেষজ্ঞকে নস্যাৎ করার যে প্রবণতার কথা আমি এখানে বলছি, এর পিছনে মূল প্রেরণা কিন্তু এই জ্ঞানের লড়াই বলে মনে হয় না। এর উৎসে রয়েছে আসলে আত্মপ্রেম— নার্সিসিজ়ম। অন্যের প্রতি অবজ্ঞা ছুড়ে দিয়ে নিজেকে উচ্চে তুলে ধরা, অধিকাংশ ক্ষমতাধর মানুষই যা থেকে মুক্ত নন। অথচ এঁদের জীবনে বিশেষজ্ঞদের যে প্রয়োজন নেই তা নয়— অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়, মোকদ্দমায় আইনজ্ঞের সাহায্য নিতে হয়। কিন্তু চিকিৎসা ঠিক হল কি না, গাফিলতি হয়েছে কি না, তা আমিই জানি, যদিও চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ে বিন্দুবিসর্গ জানা নেই। এই ‘রোগ’টিই যখন সমাজ-রাজনীতিতে বিস্তার পায়, তখন চিন বা পাকিস্তানকে সরকার কখন ‘শিক্ষা’ দেয়, সে দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকব, নির্বোধ আবেগে ভাসব, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কিংবা কূটনীতির জ্ঞান এখানে অবান্তর।

বিশেষজ্ঞরা চর্চালব্ধ ‘বিশেষ জ্ঞান’ তুলে ধরবেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত নেবেন, আর আশা করা যায় জনগণ এই প্রক্রিয়াটি বুঝতে চেষ্টা করবেন, সতর্ক থাকবেন, বেলাইন হলে সংশোধনের জন্যে চাপ তৈরি করবেন। এটাই গণতন্ত্র। তার মানে এই নয় যে প্রত্যেক নাগরিককে নীতি-নির্ধারণ ও তার প্রয়োগের খুঁটিনাটির চর্চায় সদাসর্বদা ব্যাপৃত থাকতে হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞ বনাম রাজনীতিকের দ্বন্দ্বে মানুষজন যদি ভেবে নেন এ আমার বিষয় নয়, তা হলে ভুল হবে। কারণ এমন প্রতিটি দ্বন্দ্বের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তাঁদের ভালমন্দ।

ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Narendra Modi Donald Trump
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE