আইএএস-দের রচিত গ্রন্থরাজির বেশির ভাগই হল স্মৃতিকথা বা আত্মকথন। প্রতীকী ছবি
সাম্প্রতিক সময়ে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আধিকারিকরা যে পরিমাণে বই লিখছেন, তেমনটা আগে দেখা যায়নি। এঁদের বেশির ভাগই ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস (আইএফএস) এবং ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস (আইএএস)-এ যুক্ত ছিলেন। এই বই লেখার প্রবণতা কিন্তু ‘কেন্দ্রীয় সরকারি’ চাকুরেদের তথাকথিত নিম্নবর্ণের মধ্যে তেমন ছড়িয়ে পড়েনি। যদিও কিছু প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিক তাঁদের স্মৃতিকথা লিখেছেন, তবে সংখ্যার দিক থেকে তা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। এই সব মাথায় রেখে যদি কেউ আইএএস এবং আইএফএস-দের লেখা বইপত্রের দিকে তাকান, একটি বিশেষ ছক বা প্যাটার্ন তাঁর সামনে ফুটে উঠবে।
যে সব আইএএস আধিকারিকরা সরকারের আমলাতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদ অধিকার করে ছিলেন, তাঁরা মুলত তাঁদের চাকরিজীবনের কীর্তিকলাপ লিখেই ক্ষান্ত হন। এর বিপরীতে, আইএফএস আধিকারিকরা নিজেদের সম্পর্কে মিতবাক এবং তুলনায় বেশি করে লিখে থাকেন তাঁদের কাজের বিবিধ ইস্যু ও পরিপ্রেক্ষিত (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ইতিহাস) নিয়ে। মাঝে মাঝে অবশ্য নিঃসম্পর্কিত বিষয়ও তাঁদের কলমে উঠে আসে। তাঁদের লেখা বেশ কিছু বই সত্যি সত্যি প্রকৃত প্রজ্ঞা বা মেধার ছাপ বহন করে। তুলনায় আইএএস-দের লেখা বইগুলি সম্পর্কে এতটা বলা যায় না।
এই যে এক প্রকার বিভাজন উঠে এল, এর পিছনে খানিক ব্যাখ্যার অবকাশ থেকে যায়। দুই ‘সার্ভিস’-এর আধিকারিকরাই কিন্তু একই প্রেক্ষিত থেকে উঠে আসছেন। অনেকেই একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিদ্যার্থীও বটে। এমনকি, অনেকে একই বিষয় নিয়ে পড়াশোনাও করেছেন (মূলত ইতিহাস)। চাকরির পরীক্ষা এবং ইন্টারভিউয়ে তাঁদের কৃতির মধ্যেও তেমন একটা পার্থক্য হয়তো নেই। তবু, পেশাগত জীবনের অন্তিম লগ্নে এসে এই দুই ‘বিশেষ’ চাকুরেদের মস্তিষ্ক যা ধারণ করে থাকে, তা পরস্পরের চাইতে যোজন যোজন দূরের বিষয়।
সাম্প্রতিক সময়ের কিছু উদাহরণের দিকে তাকানো যাক। আইএফএস শিবির থেকে হাতে আসছে তালমিজ আহমদের চিত্তাকর্ষক গ্রন্থ ‘ওয়েস্ট এশিয়া অ্যাট ওয়ার’, শ্যাম শরণের ‘হাউ চায়না সিজ ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’ (এটিকে তাঁর পূর্ববর্তী গ্রন্থ ‘হাউ ইন্ডিয়া ভিউজ দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর সমান্তরাল পাঠ বলা যায়), রাজীব ডোগরার হয় তিন, নতুবা চার নম্বর বই ‘ওয়ার টাইম’ (আগের বইগুলির মধ্যে দু’টি ডুরান্ড লাইন নিয়ে লেখা), শিবশঙ্কর মেননের চিন্তাশীল রচনা ‘চয়েসেস’, চন্দ্রশেখর দাশগুপ্তের বাংলাদেশ যুদ্ধ নিয়ে নতুন আলোকপাত-সমৃদ্ধ গ্রন্থ, এবং টিসিএ রাঘবনের ব্যতিক্রমী তিনটি কাজ, যার একটি ভারতের প্রধান ইতিহাসবিদদের নিয়ে রচিত (‘হিস্ট্রি মেন’), ভারত-পাক সম্পর্ক নিয়ে রচিত একটি (‘দ্য পিপল নেক্সট ডোর’) এবং অন্যটি মুঘল দরবারের সভাসদ ও কবিদের নিয়ে রচিত গ্রন্থ (‘অ্যাটেন্ড্যান্ট লর্ডস’)।
একেবারে সাম্প্রতিক না হলেও কয়েকটি গ্রন্থের উল্লেখ না করলেই নয়। তার মধ্যে অন্যতম নরেন্দ্র সিংহ সারিলার লেখা দেশভাগের ‘অকথিত’ কাহিনি। পাশাপাশি ভাস্বতী মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘বেঙ্গল অ্যান্ড দ্য পার্টিশন’ দেশভাগ নিয়ে আর একটি ‘অকথিত কাহিনি’র কথা বলে। ইতিমধ্যে কিষাণ রানা দ্রুত হাতে ন’খানি বই লিখে ফেলেছেন, যার মধ্যে তাঁর সহগামী কূটনীতিবিদদের সাহায্যার্থে লেখা কূটনীতির বাস্তব দিকগুলির উপর আলোকপাত লক্ষণীয়। অন্য দিকে যামিনী ভগবতী (অর্থনীতিবিদ এবং তৎসহ কূটনীতিবিদ) সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে কলম ধরেছেন তাঁর ‘দ্য প্রমিস অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে। আইএফএস-এর মতো এক ক্ষুদ্র পরিসরের চাকরির সাপেক্ষে দেখলে এই পরিমাণ উদ্যোগ এবং তাদের গুণগত মান রক্ষার জন্য যত্নশীলতা সত্যিই প্রশংসার্হ।
এর বিপরীতে আমি আইএএস শিবির থেকে উঠে আসা সাম্প্রতিক কিছু বইপত্রের কথা বলতে চাই। যেমন, তেজেন্দ্র খন্নার স্মৃতিকথা ‘অ্যান ইনটেন্ট টু সার্ভ’ এবং প্রাক্তন পরিষদীয় সচিব বিকে চন্দ্রশেখরের প্রকাশিতব্য গ্রন্থ (এটিও লেখকের আত্মজীবনী ও পেশাগত অভিজ্ঞতার উপরেই আলোকপাত করছে)। অন্যান্য আইএএস-লিখিত বইয়ের মধ্যে বিনোদ রাইয়ের ‘নট জাস্ট অ্যান অ্যাকাউন্ট্যান্ট’ (ক্রম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল হিসেবে অধিষ্ঠান কালে তাঁর সংবাদ শিরোনামে উঠে আসার বিবিধ নেপথ্যকাহিনি) এবং জগদীশ খট্টরের ‘ড্রিভন: মেমোয়ার্স অব আ সিভিল সার্ভেন্ট’ (যার মধ্যে মারুতি সুজুকির ডিরেক্টর হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতার কথাও সন্নিবিষ্ট)।
ব্যক্তিগত স্তরে, বিনাদোষে কয়লা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত কয়লা সচিব পিসি পারেখ তাঁর উপর আরোপিত যাবতীয় কলঙ্ক মোচনের জন্য যে বিপুল সংগ্রাম করেছিলেন, তা নথিবদ্ধ করেছেন। অরুণ শৌরীর সময়ে বিলগ্নিকরণ সচিব হিসেবে কর্মরত প্রদীপ বৈজাল তাঁর অবসরগ্রহণের পরবর্তী কালের যন্ত্রণাময় অনুভূতির কথা লিখেছেন ‘আ বুরোক্র্যাট ফাইটস ব্যাক’ গ্রন্থে। পাশাপাশি, বিনোদ রাই আরও একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন ‘রিথিঙ্কিং গুড গভর্ন্যান্স’ নামে, যেখানে তিনি তাঁর নিজের কথা না বলে অন্যান্য বিষয়ের অবতারণা করেছেন। ইতিমধ্যে হায়দরাবাদের এক স্বল্প পরিচিত আইএএস আধিকারিক বসন্ত বাওয়া কলম ধরেছেন স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে (‘নিজাম: বিটুইন মুঘলস অ্যান্ড ব্রিটিশ’)।
এই তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, আইএএস-দের রচিত গ্রন্থরাজির বেশির ভাগই হল স্মৃতিকথা বা আত্মকথন। এই ধরনের অতীতচারণার অবশ্যই গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে যখন সেগুলি লিখছেন ভারতের সব থেকে দক্ষ সরকারি আধিকারিকবর্গ। এই সব গ্রন্থে তাঁরা মেলবন্ধন ঘটাচ্ছেন অন্তর্দৃষ্টির সঙ্গে প্রশাসকের মননের। কোথাও কোথাও হয়তো সূক্ষ্মতার খানিক অভাব থেকে যাচ্ছে এই সব লিখনে, তবু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা কোনও বিশেষ বিষয়ে গভীরতর অনুধ্যানকে লিখতে সমর্থ হচ্ছেন, কোথাও আবার রসাভাস বেশ প্রকট হয়ে উঠছে। বিকে নেহরুর সুলিখিত গ্রন্থ ‘নাইস গাইজ ফিনিশ সেকেন্ড’-কে এমন রচনার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বলা যেতে পারে। কিন্তু তিনি ছিলেন আইএএস-দের পূর্বসূরি, আইসিএস অর্থাৎ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস আধিকারিক। সাম্প্রতিক সময়ে আইএফএস আধিকারিকরা সিভিল সার্ভিসের ‘সোনার ছেলে’ ইমেজকে ধরে রাখতে পারেননি। সেই জায়গায় রাজত্ব করছেন আইএএস-রা। কিন্তু কেউ যদি গ্রন্থরচনার বিন্দু থেকে বিষয়টিকে দেখেন, তা হলে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, আইএফএস-রা লিখনের প্রতি গভীর থেকে গভীরতর দায়বদ্ধতার পরিচয় রাখছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy