NREGA
আরও এক বার ভারতের কৃষি সমস্যার কথা বলতে চলেছি। সত্যি বলতে, সম্প্রতি দেশের চারিদিকে কৃষক সমাবেশ, আবার এক বার কৃষকদের সুবিধের জন্য সরকারের বর্ধিত শস্যমূল্যের ঘোষণা, আবার তা নিয়ে বিবাদ-বিতর্ক অর্থাৎ এতে সত্যি কৃষকদের সুবিধে হবে কি না, সঙ্গে সঙ্গে মাঝে মাঝেই এ রাজ্যে ও রাজ্যে চাষের ঋণ মকুবের ঘোষণা— সবই পুনরাবৃত্তি মাত্র। কৃষির মূল সমস্যা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই। কৃষকদের সমস্যা এবং আমাদের ১০০ দিনের কাজের নীতির মধ্যে সম্পর্কের কিছু না-বলা কথা বলে ফেলা যাক। অপ্রিয় কথা, তবু বলি।
গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্প চালু হয়েছে বেশ কয়েক বছর। সর্বজনজ্ঞাতার্থে একটা কথা বলা প্রয়োজন— এর ফলে কৃষিতে মজুর বা শ্রমিক সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এই প্রকল্প চালু হলে মজুরি বাড়ার কথাই ছিল। কৃষিতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের কাজের জন্যই এই প্রকল্প। ছোট চাষি এখন জমিতে কাজের লোক পান না। বিভিন্ন রাজ্যের তথ্য নিয়ে কাজ করে তৈরি বিভিন্ন গবেষণাপত্রে, এমনকি সরকারি কৃষি মূল্য নির্ধারণকারী কমিশনের গবেষণায় এ বিষয়ে সরকারকে অনেক দিন আগেই সতর্ক করা হয়েছিল।
একশো দিনের কাজের ফলে কৃষিতে উৎপাদন ব্যয় ঊর্ধ্বমুখী। ভারতের মতো দেশে, যেখানে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা নিতান্তই কম, কৃষকরা এখনও বৃষ্টির মুখ চেয়ে থাকতে বাধ্য হন, সেখানে কৃষিতে এই ব্যয়বৃদ্ধি গুরুতর বিষয়। যদি কৃষিতে লাভ বেশ খানিকটা কমে যায়, তা হলে কৃষকেরা স্বভাবতই ঋণ মকুব এবং শস্যের দাম বাড়ানোর দাবিতে পথে নামবেন। সরকার ডান পকেট থেকে একশো দিনের কাজ প্রকল্পের জন্য টাকা খরচ করবে, আর সে খরচের ফলে বেড়ে যাওয়া চাষের খরচের ঘাটতিও পোষাবে বাঁ পকেট থেকে খরচা করে— শস্যের ক্রয়মূল্য বাড়িয়ে দিয়ে। ভোটের কথা মাথায় রাখলে, দু’দিক দিয়েই সরকারের লাভ।
কর্মসংস্থান প্রকল্পের একেবারে গোড়ায় একটা গলদ আছে। এই প্রকল্পের মূল শর্ত কর্মসংস্থান। তাতে যদি গ্রামীণ সম্পদ না-ও বাড়ে, আপত্তি নেই। অথচ, এই বিপুল খরচের সঙ্গে গ্রামীণ পরিকাঠামোর উন্নয়নের শর্তটি জুড়ে নেওয়াই যেত। তাতে হয়তো গ্রামীণ অর্থনীতি খানিক উন্নতির মুখ দেখত। এই সম্পদ বৃদ্ধির খতিয়ান দেখতে চাইলে সরকার ‘রে-রে’ করে উঠবে। ১০০ দিনের কাজ ‘ভাল ভাবে’ হওয়া মানে টাকাটা খরচ হচ্ছে এবং লোকে টাকা নিয়ে সই করছে। কত সম্পদ সৃষ্টি হল তার বিচার করবে কে? আর তার দরকারই বা কী?
এনআরইজিএ তুলে নিলে কী ক্ষতি হবে? এই প্রশ্নটা এই কারণেই গুরুত্বপূর্ণ যে রুগ্ণ গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে এবং উৎপাদনশীল কর্মক্ষমতা বাড়াতে কৃত্রিম উপায়ে অর্থ সংযোজনের শেষ কোথায়? আর তার ফলে যদি কৃষিতে উৎপাদন ব্যয় ক্রমাগত বাড়তে থাকে, তা হলে ঋণ মকুব এবং শস্যের ক্রমবর্ধমান দামও সরকারকে দিতেই হবে।
সরকারের তো বটেই, অন্য অনেকেরই এই বিচিত্র ব্যবস্থায় কোনও সমস্যা নেই। কারণ গ্রামীণ কর্মসংস্থানের খরচার অনেকটা কর থেকে আসে। আর করদাতাদের পয়সা গৌরী সেনের সম্পদ। সরকারকে সেটা রোজগার করতে হয় না। কিন্তু অর্থনীতির গোড়ার কথা বলে, যে ধরনের নীতি বিশেষত ছোট ও প্রান্তিক কৃষকের রোজগারের রাস্তা বন্ধ করে দেয়— কারণ শ্রমের জোগানের প্রবল সমস্যা— সে নীতিই এক অর্থে কৃষক আন্দোলনের সৃষ্টি করে চলবে অবিরত। এই কৃষকেরা, যাঁরা দলে দলে সমাবেশ করেছেন তাঁরা কিন্তু কৃষি শ্রমিক নন। অন্তত, হওয়ার কথা নয়। যাঁরা দুটো কাজই করেন, অর্থাৎ কিছু জমিও আছে আবার আংশিক শ্রমের সঙ্গেও যুক্ত— তাঁরাও লোকাভাবে নিজেদের জমি চাষ করতে পারবেন না বা চাইবেন না। সরকার দু’হাতে টাকাকড়ি বিলোবেন। রাজনীতি বলবে, এটাই কাম্য। এ সম্পর্কে সরকার এবং উদারমনস্ক নীতিবিদেরা একই ধরনের কথা বলেন। এক দল বলেন ভোটের জন্য, আর এক দল নিজেদের ভাবমূর্তির জন্য। বাজেটের সীমাবদ্ধতা বস্তুটি নিয়ে ভাবার সময় বা ইচ্ছা কারও নেই।
গ্রামীণ কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্য এবং বাস্তব কার্যকারিতার মধ্যে কতটা ফারাক, তা নিয়ে জাতীয় স্তরে কোনও বিবাদ–বিতর্ক হওয়ার জো নেই। আসলে এটা ‘পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি’র একটি মহার্ঘ ব্যবস্থা, না কি গ্রামীণ অর্থনীতিকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য অপরিহার্য নীতি, তা নিয়েও কথাবার্তা হয় না। যেখানে যেখানে সম্পদ সৃষ্টি হচ্ছে না, সেই জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করা; বা যাঁদের কাজ পাওয়ার কথা তাঁরা না পেয়ে অন্যরা পাচ্ছেন কি না; কী ভাবে টাকা খরচা হচ্ছে— ‘কমিশন’-এর পরিবর্তে কাজ ছাড়াই টাকাপয়সা বিলোনো হচ্ছে কি না, এ সবই দেখা প্রয়োজন। যদি মজুরির হার খুব বেড়ে যায়, তা হলে সব জায়গায় কি কাজ না পাওয়ার সমস্যা এক রকম, না কিছু কিছু জায়গায় শ্রমিক এমনিতেই বাড়ন্ত সেখানে গ্রামীণ কর্মসংস্থান এই সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করছে? বিপিএল কার্ড কি সত্যি ঠিকমতো বিলি হচ্ছে? গণবণ্টন ব্যবস্থায় টার্গেটিং-এর সমস্যার কথা গবেষণায় বারে বারেই এসেছে। দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে গ্রামের বর্ধিষ্ণু মানুষদের হাতেই বিপিএল কার্ড বেশি।
অনেকে বলেন, গরিব মানুষ কম হয়ে গেলে কী বিলোবে সরকার? এতে বিতর্কের অবকাশ নেই। দারিদ্র হ্রাস পাওয়া মানে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির মৃত্যুঘণ্টা।
সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা’য় অর্থনীতির শিক্ষক
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy