মহাত্মা গাঁধী নাম দিয়াছিলেন, স্বতন্ত্রতা সঙ্কল্প দিবস। জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে ১৯২৯ সালের বর্ষশেষে পূর্ণ স্বরাজ আনিবার শপথ-সূত্রে ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারিকে বলা হইল স্বাধীনতা দিবস। শেষ পর্যন্ত কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের শিকল ভাঙিয়া ভারত যখন সত্যই স্বাধীনতার মুখ দেখিল ও ভাগ্যের সহিত গাঁটছড়া বাঁধিল— দিনটি ঘটনাচক্রে দাঁড়াইল ১৫ অগস্ট। ফলত ২৬ জানুয়ারির অভিধাও ক্রমে পাল্টাইল। আড়াই বৎসর পর দেশের প্রথম সংবিধান প্রস্তুত হইলে একটি শুভদিন দেখিয়া তাহা কার্যকর করিবার দরকার পড়িল। এবং সেই সূত্রে বাছিয়া লওয়া হইল ঐতিহাসিক মাহাত্ম্যে পূর্ণ ২৬ জানুয়ারি দিনটিকেই। সেই হইতে বিংশ শতকের ভারতে যাহা ছিল স্বাধীনতা দিবসের প্রথম দাবিদার, সেই ২৬ জানুয়ারির পরিচয় ভারতীয় জনসাধারণের নিকট দাঁড়াইল: প্রজাতন্ত্র দিবস। বিবর্তনটিকে ইতিহাসের খামখেয়াল মনে হইতে পারে, আবার ঈষৎ ভিন্ন দৃষ্টিতেও দেখা যাইতে পারে। স্বাধীনতা বস্তুটিকে কেবলই স্ব অর্থাৎ নিজের অধীনতা ভাবিলে তাহার অর্থ যেমন দাঁড়ায়, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃপুরুষরা হয়তো তাহা হইতে কিছু পৃথক ভাবে স্বাধীনতার কল্পনা করিয়াছিলেন। হয়তো ভাবিয়াছিলেন, কেবল নিজের অধীনতা অর্জন বলিলে স্বাধীনতা বস্তুটিকে সঙ্কীর্ণ বা ছোট করিয়া দেখা হয়। কিন্তু যদি সমষ্টিগত অর্থে শব্দটিকে ভাবা যায়, তবে স্বাধীনতার অর্থ অনেক বৃহৎ হইয়া যায়। সেই স্বার্থভাবনা-অতিক্রমী উদার ও বৃহৎ স্বাধীনতার ছবিটি অঙ্কিত হইল দেশের সংবিধানের মধ্যে, এবং প্রজাতন্ত্র বা সাধারণতন্ত্রের ধারণাটি উদ্দীপিত করিবার মধ্যে। সেই দিক দিয়া ভাবিলে প্রজাতন্ত্র দিবস কিন্তু এক ভিন্ন স্বাধীনতার কথা বলে। শাসনতান্ত্রিক স্বাধীনতার সহিত আদর্শতান্ত্রিক স্বাধীনতা মিলিলে তবেই দেশের সমাজের সত্যকারের অগ্রগতি সম্ভব, এমন একটি ইঙ্গিত রহিয়া যায় ২৬ জানুয়ারির উদ্যাপনে।
ঔপনিবেশিক ভারত যখন স্বাধীন হইল, তাহার দ্বিখণ্ডিত রূপটির চেহারা ভাবিলে উপরের কথাটি আর একটু পরিষ্কার হইবে। ভারতের সহিত সে সময় পাকিস্তানও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে জন্ম লইয়াছিল, তাহার স্বাধীনতা দিবসটি ছিল এক দিন আগে, ১৪ অগস্ট। সহোদর পাকিস্তানের সংবিধানের মধ্যে কিন্তু সেই বৃহৎ আদর্শটিতে উন্নীত হইবার শপথ রহিল না। স্বাধীনতালাভের অব্যবহিত পর পাকিস্তান গণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্র কোনওটিই হইতে পারিল না। ইহার অর্থ এই নয় যে, ভারতীয় রাষ্ট্র রাতারাতি গণতান্ত্রিক বা প্রজাতান্ত্রিক আদর্শ আদ্যন্ত সফল ভাবে রূপায়িত করিয়া ফেলিল। না, ফেলিল না। কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রীয় আদর্শের মধ্যে সাংবিধানিক ভাবে বৃহৎ ও উদার তন্ত্রে পৌঁছিবার স্বপ্নটি নিশ্চিত ভাবে থাকিয়া গেল। উচ্চারণ, শপথ ও লক্ষ্যের দিক দিয়া দেখিলে ইহা মোটেই সামান্য কথা নয়। সংবিধান চালু হইবার পর বৎসরই এমন বিশাল জনবহুল বিভেদময় দেশের প্রতিটি কোণে গণতান্ত্রিক নির্বাচনক্রিয়া অনুষ্ঠিত হইবার মধ্যে সেই অসামান্য শপথের ছাপ লুকাইয়া রহিল। সব ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের সমমনস্ক হইবার প্রতিজ্ঞার মধ্যে, কিংবা যুগ-যুগ ধরিয়া পিছাইয়া থাকা পশ্চাৎপদ সমাজকে আলাদা ভাবে রাষ্ট্রীয় সুযোগ দিবার মধ্যে সেই অসামান্য শপথ ধ্বনিত হইল। সময় চির কাল সমান যায় না, রাষ্ট্রের ধ্বজাধারীদের চরিত্রও সব সময় এক হয় না, কিন্তু আশা করা হইল, যে কোনও পরিস্থিতিতে দেশের এই বৃহৎ স্বাধীনতাটি রাষ্ট্র সতর্ক ভাবে রক্ষা করিয়া চলিবে। গত কয়েক বৎসর ধরিয়া যেহেতু ভারতীয় রাষ্ট্রের এই ‘বৃহৎ’ চরিত্রটি বহু দিক দিয়া বিপন্ন হইয়া পড়িয়াছে, জনসমাজের বিবিধ অংশ যেহেতু সংখ্যাগুরু সমাজের ঔদ্ধত্যের সামনে নিয়মিত বিপন্ন বোধ করিতেছে, এই বৃহৎ স্বাধীনতার কথাটি স্মরণ করা— কোথা হইতে শুরু করিয়া কোথায় আসিয়া পৌঁছানো গেল তাহা বিবেচনা করা—বিশেষ জরুরি। প্রজাতন্ত্র দিবস এই জরুরি কাজটি করিবার দিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy