সারা দেশ অবাক হয়ে দেখল এক ব্যতিক্রমী সাধারণতন্ত্র দিবস। দেখল রাস্তায় দাঁড়িয়ে সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ। রীতিমতো স্লোগান উঠল ‘সংবিধান বাঁচাও’। স্বাধীনোত্তর ভারতে নজিরবিহীন।
আবহটা অবশ্য ছিলই। আবহটা তৈরি ছিল একটা তাগিদ থেকে। অস্তিত্বের তাগিদ। সংসদীয় সংখ্যার জোরে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে নস্যাৎ করে ধর্মের ভিত্তিতে নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের তাগিদ। না, কোনও রাজনৈতিক পতাকার ছত্রছায়ায় নয়। ছত্রছায়া একটাই। ভারতের জাতীয় পতাকা। আর এই মহার্ঘ্য আবহ তৈরির কুশীলব একেবারে সাধারণ মানুষ। সেই সাধারণ মানুষ, যাদের উল্লেখ করেই শুরু ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা— “আমরা ভারতের জনগণ…”। এ সেই জনগণ, যারা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে শুধু ভারতীয় বলেই জানে, জেনে এসেছে এতকাল। এবং কোনও দিন অবচেতনেও ভাবেনি এই ভারতীয় পরিচয়ের বাইরে তাদেরকে ধর্মের ভিত্তিতে এই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে নতুন করে ভাগ করে কেউ নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্রত পালন করতে এগিয়ে আসবে। কারণ, দশকের পর দশক ধরে তারা এটাই জেনে এসেছে নাগরিকত্ব আসলে একটা অনুশীলন, একটা বোধের চর্চা। আর সে চর্চায় ইতিমধ্যেই তারা সসম্মানে উত্তীর্ণ। সে উত্তরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলার ধৃষ্টতা কেউ কোনও দিন দেখায়নি, দেখাবে বলেও তারা ভাবেনি। কিন্তু হায়! সময় বড় পরিহাসপ্রিয়।
তাই সময়ের এই চরমতম পরিহাসের জবাবে সেই সাধারণ আজ পথে নেমে বলছে, ‘সংবিধান বাঁচাও’। সংবিধানের প্রস্তাবনার উচ্চকিত উচ্চারণ কীসের ইঙ্গিত? এ কি শুধুই হুজুগ? না কি বিপন্নতা? না কি অপমানের শীলিত সাংবিধানিক জবাব? যে জবাবের গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়েছে তার সংবিধান নিজেই, সেই সংবিধানকেই অস্ত্র করেছে সে। কারণ, এ অপমান শুধু তার নিজের নয়, এ অপমান তার সংবিধানেরও। একথা ঠিক সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সেকুলার’ শব্দটির সংযোজন হয়েছে অনেক পরে। ১৯৭৬-এ সংবিধানের ৪২তম সংশোধনীতে। কিন্তু তাই বলে কি তার সত্তা, সর্বধর্ম সমভাবের ঐতিহ্য ছিল না? সংবিধানের প্রস্তাবনাতে যখন ‘সেকুলার’ কথাটা যোগ হল (Sovereign Socialist Secular Democratic Republic), তখন স্বাভাবিক ভাবেই ‘সেকুলার’ শব্দের অর্থ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল, হয়েছিল বিতর্ক। কিন্তু বিতর্ক যাই হোক না কেন, একটি ব্যাপারে ঐক্যমত ছিল যে, সেকুলার আদর্শটি ইতিবাচক এবং ভারতীয় গণতন্ত্রের ক্রমোন্নতির সহায়ক। এমনই সম্ভ্রম ও মর্যাদা আদায় করল এই ‘সেকুলার’ শব্দটি যে, পরবর্তীতে মোরারজি দেশাইয়ের সরকার ইন্দিরা সরকারের আনা অনেক সংবিধান সংশোধনী রদ করলেও প্রস্তাবনার এই শব্দটিতে হাত দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখাননি। এমনকি, আন্তর্জাতিক সম্ভ্রম জাগিয়ে শব্দটি নিছক একটি শব্দ হয়ে রইল না। এর ভারতীয় প্রতিশব্দ তৈরি করা হল ‘পথনিরপেক্ষ’, মতান্তরে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’। ‘ধর্মনির্লিপ্ত’ নয়, যা পশ্চিমি সেকুলার রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে খাটে। আর এই তফাতটা না বুঝলে সেকুলার ভারত বলতে আসলে ঠিক কী বোঝায়, তা স্পষ্ট হবে না। কেমন সে তফাত? পাশ্চাত্যে ‘সেকুলার’ রাষ্ট্র বলতে বোঝানো হয় সেই রাষ্ট্রকে, যে ধর্ম (religion)-এর সঙ্গে রাষ্ট্রের যাবতীয় সংস্রবকে কার্যত নাকচ করে। ‘সেকুলারিজম’-এর এ ধারণা প্রথম এল ১৮৫১-তে ব্রিটিশ চিন্তাবিদ জর্জ জেকবের হাত ধরে। অবশ্য শুরুরও তো শুরু থাকে। পাশ্চাত্য দার্শনিক অগাস্ট কোঁৎ-এর ‘পজিটিভিজিম’-এর প্রভাবেই জেকবের মাথায় এল ‘সেকুলারিজম’ ধারণা, যা আসলে সামনে আনতে চায় ‘a social order separate from religion, without criticizing religious belief.’