Advertisement
০৬ মে ২০২৪
Gene Deitch

আনন্দের আয়ুধ

অ্যানিমেশনের জগৎকে যে অসামান্য চরিত্রগুলি চেক প্রজাতন্ত্রবাসী মার্কিন শিল্পী ডিচ উপহার দিয়া গিয়াছেন, তাহাদের মূল্যায়ন কোনও এক সময় হইবে।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২০ ০০:০০
Share: Save:

নীলাভ গাত্রবর্ণের একটি গৃহপালিত মার্জার এবং অতি ক্ষুদ্র একটি চঞ্চল অথচ বুদ্ধিমান মূষিক একদা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-তাড়িত বিবর্ণ বিশ্বের ক্যানভাস নির্মল হাস্যরসে রঙিন করিয়া দিয়াছিল। মার্জার মূষিককে পাকড়াও করিতে সেই যে দৌড় আরম্ভ করিল, কয়েক দশকে আর তাহা থামে নাই। টম ও জেরির আট জন স্রষ্টার শেষতম জিন ডিচ সম্প্রতি পঁচানব্বই বৎসর বয়সে তাঁহার রঙ তুলি রাখিয়া ভিন্নতর ক্যানভাসের উদ্দেশে পা বাড়াইয়াছেন। মানবের প্রিয় পৃথিবীর বুকে টম এবং জেরির বিরতিহীন দৌড় যেন প্রমাণ করিয়া দিয়াছিল যে পৃথিবীর ইতিহাসকে বারংবার যুদ্ধ, ধ্বংস, হাহাকারের পর্ব অতিক্রম করিতে হয় বটে, যাপনের নিরন্তর বৃত্তান্তে প্রাণের অন্তহীন প্রবাহের গতি কিন্তু এতটকু শ্লথ হইবার উপায় নাই। আশ্চর্য সেই প্রবাহে আনন্দের নিমিত্তই আনন্দ বাঁচিয়া থাকে, উদ্দেশ্য সন্ধান করে না।

অ্যানিমেশনের জগৎকে যে অসামান্য চরিত্রগুলি চেক প্রজাতন্ত্রবাসী মার্কিন শিল্পী ডিচ উপহার দিয়া গিয়াছেন, তাহাদের মূল্যায়ন কোনও এক সময় হইবে। বিংশ শতকের প্রথম পর্ব হইতেই যে ভাগ্যবান কাঠবিড়ালি, চঞ্চল মূষিক, আশ্চর্য ভূখণ্ডের স্বপ্নে বিভোর কিশোরী, বিরাটাকার হংস শৈশবের কল্পরাজ্যে রীতিমতো কলরোল তুলিয়া বেড়াইতেছিল, আজিকার মোবাইল ফোনের স্বল্প পরিসরে তাহাদের উত্তরপ্রজন্মই গ্রিফিন, ব্লু, ডোরেমন, বাঁটুল অথবা ছোটা ভীম রূপে আবির্ভূত। এই দীর্ঘ বিনোদনের সারিতে ডিচ সংযোজন করিয়াছিলেন তাঁহার অসাধারণ সৃষ্টিসম্ভার। তীব্র গতি ও শব্দক্ষেপণে সমৃদ্ধ তেরো পর্বের টম এবং জেরি ছাড়াও সেই আনন্দ আয়োজনে স্থান করিয়া লইয়াছে নাবিক পপাই, পালংশাক উদরস্থ করিলেই যাহার পেশি স্ফীত হইয়া যায়। আমরা বিস্মৃত হইতে পারি না তাঁহার সৃষ্ট নীলবর্ণ ভীরু হস্তীকে, অদ্ভুতচরিত্র নুদনিককে। শিশুর অপটু হস্তে অঙ্কিত সাদাকালো চিত্রপটের সারল্য ব্যবহার করিয়া যে দুর্দান্ত টম চরিত্রকে ডিচ নির্মাণ করিয়াছিলেন, তাহা অনবদ্য। একদা বিমানের নকশা অঙ্কন করিতে দক্ষ এই পরিচালক মানরোর ন্যায় অসাধারণ শিশু চরিত্র আঁকিয়া অস্কার জিতিয়া লইয়াছিলেন। অবশ্য তাঁহার জয়যাত্রার প্রকৃত নিশান উড়িয়াছিল দর্শকের হৃদয়ে, যাহা সততই বাস্তবের কাঠিন্যকে উপেক্ষা করিয়া এক বাৎসল্যের জগতে প্রবেশে আগ্রহী।

করোনাকাতর পৃথিবী জিন ডিচের প্রয়াণে শোকার্ত হইবার যথেষ্ট অবকাশ পাইল না। জীবনকে যাহা জীবনান্তের শোক হইতে বঞ্চিত করে, তাহার অপেক্ষা দুঃসহ সময় আর কী হইতে পারে? আগামীকালের পরিবর্তিত বিশ্ব কি অদৃশ্য সেই হিংস্র ভাইরাসকে সহজে বিস্মৃত হইতে পারিবে, যাহা নিষ্ঠুর সংক্রমণে নির্দোষকে হত্যা করিল? প্রাণবান জীবনের এই অন্যায় অপচয়ের গ্লানি কি তাহাকে দিবারাত্র মলিন করিয়া রাখিবে না? তখন প্রয়োজন পড়িবে জিন ডিচের ন্যায় রসিক স্রষ্টার। অতিমারি-উত্তর বিষণ্ণ বিশ্বকে তো আবার হাসিতে হইবে? তথ্যচিত্র, চলচ্চিত্র, কল্পবিজ্ঞানের পাশাপাশি কল্পনার রঙিন অঙ্গনে পশুপাখি, মানুষের সম্ভব-অসম্ভব সহাবস্থানে জীবনের জন্মগত অধিকার। সেই অধিকারের দাবিকে নস্যাৎ করিয়াছে যে বর্তমান, তাহার উপসংহার লিখিতে হইলে জিন ডিচের তুলির তুল্য আয়ুধ প্রয়োজন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gene Deitch Tom and Jerry
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE