Advertisement
E-Paper

বিরোধী রাজনীতির সন্ধান চাই

গোটা ব্যাপারটাই যে সরকারের একটা বিজ্ঞাপনী প্রচার, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ রাখেননি প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর পারিষদবর্গ।

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৭ ১৩:৪১

বিরোধী দলগুলি অনেকেই শেষ পর্যন্ত সংসদ ভবনে মধ্যরাত্রির বিচিত্রানুষ্ঠান বয়কট করল। তাতে ভারতীয় গণতন্ত্র অশুদ্ধ হল না। জিএসটি প্রবর্তনের আসরটিকে সংসদের অধিবেশনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার কোনও কারণ নেই। এই অনুষ্ঠান বিজ্ঞান ভবনে হতে পারত, তালকাটোরা স্টেডিয়ামে হতে পারত, কুরুক্ষেত্র বা পানিপথেও হতে পারত, কেন্দ্রীয় সরকার সংসদ ভবনকে বেছে নিয়েছিল, এই যা। সংসদ আর সংসদ ভবন এক নয়। প্রধানমন্ত্রী নিজে সেটা বিলক্ষণ জানেন— তিনি সংসদ ভবনে প্রথম প্রবেশের আগে তার সিঁড়িতে শুয়ে পড়ে প্রণাম করেছিলেন, কিন্তু সংসদের বিতর্কে সচরাচর তাঁকে দেখা যায় না, দেখা গেলেও শোনা যায় না। তাই যাঁরা জিএসটির সভায় গেলেন না, তাঁরা সংসদের অপমান করলেন— এমন কথা বললে আবেগ উথলে উঠতে পারে, যুক্তির দাবি মেটে না।

গোটা ব্যাপারটাই যে সরকারের একটা বিজ্ঞাপনী প্রচার, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ রাখেননি প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর পারিষদবর্গ। যাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, কর কাঠামোর একটা পরিবর্তন নিয়ে এত ঢাকঢোল বাজানোর কী ছিল, তাঁরা হয় অতিসরল নয় তো কেবল বলতে হয় বলে বলছেন। ঢাক বাজানোটাই লক্ষ্য, জিএসটি উপলক্ষমাত্র। উপলক্ষ বাছতে প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই স্বভাবসিদ্ধ চতুরতার পরিচয় দিয়েছেন। জিএসটি নামক এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চান তিনি। প্রথমত, ‘একটি কর, এক ভারত’ প্রচার করে জাতীয়তাবাদের ইজারাটিকে আরও জোরদার করা যাবে। দ্বিতীয়ত, স্বেচ্ছায় হোক, দলের মুখ চেয়ে হোক, পরিস্থিতির চাপে হোক, সব রাজ্যই যেহেতু শেষ পর্যন্ত জিএসটি’তে সায় দিয়েছে, সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শের ধারক ও বাহক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা যাবে। কংগ্রেস বা অন্য বিরোধীরা সবাই অনুষ্ঠানে যোগ দিলে শাসক দল ও তার সর্বাধিনায়কের এই লক্ষ্য ষোলো কলায় পূর্ণ হত। বিরোধীরা তাতে বাদ সাধতে চাইলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

প্রশ্ন হল, যাব কি যাব না ভেবে ভেবে প্রায় শেষ মুহূর্ত অবধি কংগ্রেস এমন দ্বিধায় থাকল কেন? শুধু কংগ্রেস নয়, অন্য নানা বিরোধী দল, এমনকী এ-সব ব্যাপারে সচরাচর কিংকর্তব্যনিশ্চিত বামপন্থীরাও শুরু থেকে একটা সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে পারেননি। অনুমান, সবাই ভয় পাচ্ছিলেন, তাঁদের অনুপস্থিতি অগণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদ-বিরোধী আচরণ বলে সাব্যস্ত হবে না তো? শেষ পর্যন্ত অবশ্য বিরোধীদের একাংশ নিজেদের চিন্তা, ভয় ও দ্বিধাকে অতিক্রম করতে পেরেছেন। এখনও সবাই এক ঘাটে জল খাচ্ছে না।

কিন্তু এই অভিজ্ঞতা আরও এক বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক শিবির এখনও অপ্রস্তুত। তাদের নিজেদের মধ্যে নানা বিষয়ে মতানৈক্য আছে, সেটা সমস্যা নয়, গণতন্ত্রে বিরোধীদের মতানৈক্য স্বাভাবিক এবং কাম্য। বিরোধীদের মূল সমস্যা হল, তারা নিজের খেলা তৈরি করে উঠতেই পারেনি, শাসকদের খেলাটাই খেলতে চেষ্টা করছে। নোট বাতিল থেকে জিএসটি, সার্জিকাল স্ট্রাইক থেকে গোরক্ষা-তাণ্ডব, প্রত্যেকটা বিষয়ই সঙ্ঘ পরিবার থেকে উঠে আসা। এমনকী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়েও এই ধারা অক্ষুণ্ণ থাকল— দলিত রামনাথ কোবিন্দের মহড়া নিতে মনোনীত হলেন দলিত মীরা কুমার!

প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বিরোধীদের নিজস্ব যুক্তি থাকতে পারে। গরুর নামে মানুষ মারার পিশাচলীলা চললে তার প্রতিবাদ করতেই হবে। আরএসএস-ছাপযুক্ত দলিত প্রার্থীই যে ভারতীয় দলিত-সমাজের একমাত্র প্রতিনিধি নন সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোও হয়তো প্রয়োজনীয় রাজনীতি। কিন্তু, প্রথমত, কোনও বিষয়েই বিরোধীরা নিজেদের অবস্থান যথেষ্ট জোরের সঙ্গে পেশ করতে পারছেন না, গোরক্ষকদের বিরোধিতা থেকে প্রতিস্পর্ধী মীরা কুমার— সবটাই কেমন আধো-আধো। দ্বিতীয়ত, বিরোধীদের নিজেদের দাবি কোথায়? নিজেদের আন্দোলন? যে দাবি এবং আন্দোলনের বিষয় নরেন্দ্র মোদী স্থির করে দেননি, তাঁরা নিজেরা তৈরি করেছেন? বস্তুত, এই দ্বিতীয়টিই তাঁদের সমস্যার উৎস। নিজেদের রাজনীতির জমি নিজেরা তৈরি করতে পারলে সে রাজনীতি এমন কমজোরি হত না, পদে পদে এত দ্বিধাদ্বন্দ্বেও ভুগতে হত না।

বিরোধী রাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল কৃষকদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। দেখতে দেখতে সে সম্ভাবনা পাটে বসল। অথচ এ দেশে কৃষি ও কৃষিজীবীর সমস্যা অন্তহীন। ঠিক যেমন অন্তহীন শিল্পশ্রমিক থেকে তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী— বিভিন্ন স্তরের, বিভিন্ন ধরনের শ্রমজীবী মানুষের রুজি রোজগারের সংকট, বিশেষত তাঁদের জীবিকার অনিশ্চয়তা। কৃষিতে, শিল্পে, জনজীবনের অন্য নানা পরিসরে সংকট বাড়ছে। তার পিছনে আছে রাজনীতির গূঢ় লীলা। সরকারি প্রশ্রয়ে বড় পুঁজির আগ্রাসনে প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশের সংহার চলছে দেশের নানান অঞ্চলে, তার অভিঘাতে বিপর্যস্ত, বিপন্ন হচ্ছে স্থানীয় অধিবাসীদের জীবন। যে সব প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চেষ্টা করছেন, তাঁদের উপরে রাষ্ট্রের শ্যেনদৃষ্টি পড়ছে, অচিরেই নেমে আসছে আঘাত। বিরোধী রাজনীতি নিশ্চুপ।

শুক্রবার নৈশ আসরে বিরোধীদের থাকা বা না-থাকায় ভারতীয় গণতন্ত্রের কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি নেই, কিন্তু তাঁরা যে ভাবে বিরোধী রাজনীতির দায়দায়িত্ব বিসর্জন দিয়ে সসেমিরা অবস্থায় বিচরণ করছেন, তাতে নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর পরিবারবর্গের পৌষ মাস। বিরোধীরা বিরোধী রাজনীতিকে বয়কট করলে বুঝতে হয়, গণতন্ত্রের ঘোর দুর্দিন সমাগত।

democracy Opposition politics GST জিএসটি নরেন্দ্র মোদী
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy