বিরোধী দলগুলি অনেকেই শেষ পর্যন্ত সংসদ ভবনে মধ্যরাত্রির বিচিত্রানুষ্ঠান বয়কট করল। তাতে ভারতীয় গণতন্ত্র অশুদ্ধ হল না। জিএসটি প্রবর্তনের আসরটিকে সংসদের অধিবেশনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার কোনও কারণ নেই। এই অনুষ্ঠান বিজ্ঞান ভবনে হতে পারত, তালকাটোরা স্টেডিয়ামে হতে পারত, কুরুক্ষেত্র বা পানিপথেও হতে পারত, কেন্দ্রীয় সরকার সংসদ ভবনকে বেছে নিয়েছিল, এই যা। সংসদ আর সংসদ ভবন এক নয়। প্রধানমন্ত্রী নিজে সেটা বিলক্ষণ জানেন— তিনি সংসদ ভবনে প্রথম প্রবেশের আগে তার সিঁড়িতে শুয়ে পড়ে প্রণাম করেছিলেন, কিন্তু সংসদের বিতর্কে সচরাচর তাঁকে দেখা যায় না, দেখা গেলেও শোনা যায় না। তাই যাঁরা জিএসটির সভায় গেলেন না, তাঁরা সংসদের অপমান করলেন— এমন কথা বললে আবেগ উথলে উঠতে পারে, যুক্তির দাবি মেটে না।
গোটা ব্যাপারটাই যে সরকারের একটা বিজ্ঞাপনী প্রচার, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ রাখেননি প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর পারিষদবর্গ। যাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, কর কাঠামোর একটা পরিবর্তন নিয়ে এত ঢাকঢোল বাজানোর কী ছিল, তাঁরা হয় অতিসরল নয় তো কেবল বলতে হয় বলে বলছেন। ঢাক বাজানোটাই লক্ষ্য, জিএসটি উপলক্ষমাত্র। উপলক্ষ বাছতে প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই স্বভাবসিদ্ধ চতুরতার পরিচয় দিয়েছেন। জিএসটি নামক এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চান তিনি। প্রথমত, ‘একটি কর, এক ভারত’ প্রচার করে জাতীয়তাবাদের ইজারাটিকে আরও জোরদার করা যাবে। দ্বিতীয়ত, স্বেচ্ছায় হোক, দলের মুখ চেয়ে হোক, পরিস্থিতির চাপে হোক, সব রাজ্যই যেহেতু শেষ পর্যন্ত জিএসটি’তে সায় দিয়েছে, সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শের ধারক ও বাহক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা যাবে। কংগ্রেস বা অন্য বিরোধীরা সবাই অনুষ্ঠানে যোগ দিলে শাসক দল ও তার সর্বাধিনায়কের এই লক্ষ্য ষোলো কলায় পূর্ণ হত। বিরোধীরা তাতে বাদ সাধতে চাইলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
প্রশ্ন হল, যাব কি যাব না ভেবে ভেবে প্রায় শেষ মুহূর্ত অবধি কংগ্রেস এমন দ্বিধায় থাকল কেন? শুধু কংগ্রেস নয়, অন্য নানা বিরোধী দল, এমনকী এ-সব ব্যাপারে সচরাচর কিংকর্তব্যনিশ্চিত বামপন্থীরাও শুরু থেকে একটা সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে পারেননি। অনুমান, সবাই ভয় পাচ্ছিলেন, তাঁদের অনুপস্থিতি অগণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদ-বিরোধী আচরণ বলে সাব্যস্ত হবে না তো? শেষ পর্যন্ত অবশ্য বিরোধীদের একাংশ নিজেদের চিন্তা, ভয় ও দ্বিধাকে অতিক্রম করতে পেরেছেন। এখনও সবাই এক ঘাটে জল খাচ্ছে না।