Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

নাট্যাভিনয়ে রাজদ্রোহের ভয় ছিল প্রাচীন ভারতেও

নাটকে কী-কী দেখানো যাবে না, সে কালে তার একটা লম্বা তালিকা করে দেওয়া হয়েছিল। যেমন রতি বা কামসম্ভোগ আর রাষ্ট্রবিপ্লব অর্থাৎ যা রাজাকে পদচ্যুত বা হত্যা করা বোঝায়। লিখছেন অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়।

অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:৪৭
Share: Save:

অতি প্রাচীনকাল থেকেই ভারতের মানুষ সঙ্গীতের অনুরাগী ছিলেন। কিন্তু বৈদিক সাহিত্যে কোথাও ‘নাটক’, ‘নাট্যশালা’ বা ‘নটের’ নামগন্ধ পাওয়া যায় না। যদিও ‘মহাব্রত’ বলে একটি যজ্ঞানুষ্ঠান ছিল যেখানে ঝগড়া ও লড়াইয়ের ভান করে দুটি নাটকের মতো জিনিস অভিনয় হত। সোমলতা বিক্রি করা নিয়ে ক্রেতা আর বিক্রেতার মধ্যে বাদ-বিবাদের অভিনয় আর শূদ্র ও ব্রাহ্মণের যুদ্ধানুকরণের অভিনয়। এ বাদে আর কোথাও নাটক বিষয়ক কোনও আভাস বৈদিক সাহিত্যে নেই। যদিও ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে কতগুলি সংবাদসূক্তে কথোপকথনের আকারে কিছু খণ্ড কাহিনির সূত্র আছে। তার মধ্যে পুরুরবা-ঊর্বশী সংবাদসূক্তটি (ঋগ্বেদ ১০/৯৫) খুবই বিখ্যাত, যাকে অবলম্বন করে কালিদাস পরে তাঁর ‘বিক্রোমোর্বশীয়ম্‌’ নামের নাটকটি রচনা করেছিলেন।

বৈদিক সাহিত্যে নাটক সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া না গেলেও বৈয়াকরণ পাণিনির (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দী) ‘অষ্টাধ্যায়ী’তে (৪/৩/১১০) সর্বপ্রথম ‘শিলালী’ বলে এক জনের নাম মেলে যাঁকে পাণিনি ‘নটসূত্রকার’ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে এর পূর্বে সংস্কৃত সাহিত্যে ‘নট’ শব্দটির ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় না। পাণিনির সময়ে ‘নৃত্য’ ও ‘নাট্য’ শব্দ দু’টির কোনও পার্থক্য ছিল কি না, তা-ও আর বিশেষ জানা যায় না। সংস্কৃত ভাষায় অভিনয়বাচক কোনও ধাতুও দেখতে পাওয়া যায় না। তবে প্রাকৃত ভাষায় ‘নট্‍’ বলে একটি ধাতু পাওয়া যায় অর্থ ‘অভিনয় করা’। প্রাকৃতে সাধারণত স্বল্পশিক্ষিত তথা অন্ত্যজ শ্রেণির লোকজন কথা বলতেন। তাই মনে করা যেতেই পারে যে প্রাকৃত ‘নট্‍’ ধাতুটির সংস্কৃতায়ন হয়েই পরে ‘নাট্য’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে।

অর্থাৎ ধারণা করা যায় যে নাটক আদিতে অন্ত্যজ সম্প্রদায়েরই সংস্কৃতি ছিল। কারণ, পাণিনির সামান্য পরে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ-তৃতীয় শতাব্দী) এই নট-নটীদের সম্পর্কে বিচিত্র বিধিনিষেধ দেখতে পাচ্ছি। চতুর্বর্ণের কর্মবিভাজন আলোচনা করতে গিয়ে কৌটিল্য বলছেন, কারুশিল্প ও কুশীলব কর্ম হল শূদ্রদের কর্ম। নগরে যাতে নটনটীরা প্রবেশ করতে না পারে, সে পরামর্শও তিনি দিয়েছেন। কারণ, তারা নাকি কাজে-কর্মে বিঘ্ন ঘটাতে ওস্তাদ (“নটনর্তনগায়ন-বাদকবাগ্‌জীবনকুশীলবা ন কর্মবিঘ্নং কুর্যুঃ” – অর্থশাস্ত্র ১/২/১/৫)।

শিল্পীদের প্রতি এই আচরণ কেন? শিল্পীদের কি আবহমান কাল থেকেই রাজশক্তি ভয় পেত? আবার এ কথাও তো ঠিক যে রাজারা অনেক সময়ে শিল্পীদের ভরণপোষণের ভার নিতেন। রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে (৬৭/১৫) “নারাজকে জনপদে প্রহৃষ্টনটনর্তকাঃ”। অর্থাৎ, নাট্যাভিনয়ের মাধ্যমে নটেরা আর নর্তকেরা হৃষ্ট হয়ে থাকেন, কিন্তু রাজাহীন জনপদে তাদের শ্রীবৃদ্ধি হয় না। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও দেখতে পাচ্ছি, রাজারা মাঝেমধ্যে রাজপুরীতে অভিনয়ের ব্যবস্থা করতেন। তার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র-শস্ত্র, বাদ্যযন্ত্র বা সাজপোশাক প্রাসাদ থেকেই সরবরাহ করা হত। বাইরে থেকে নিয়ে আসার বিষয়ে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ছিল। কারণ সহজবোধ্য— যাতে নৃত্যরত মর্জিনার নাচের ছলে ডাকাত-সর্দারকে সত্যি করে ছুরি মারার মতো কোনও চক্রান্ত এড়ানো যায়।

সে কালে অভিনেতাদের অবিশ্বাস করার একটা বড় কারণ ছিল তাঁদের একাংশকে গুপ্তচর হিসাবে ব্যবহার করার রীতি। তাঁরা নানা বেশে বাজারে-বেশ্যালয়ে, পানশালা থেকে ধর্মস্থানে ছড়িয়ে থাকতেন এবং তাঁদের মাধ্যমে রাজা খবর পেতেন কে তাঁর প্রতি কেমন মনোভাব পোষণ করেন। শত্রুরাজার রাজ্যেও গুপ্তচর নিয়োগের ব্যবস্থা ছিল। সেই কারণেই হয়তো অভিনেতাদের সম্পর্কে রাজাকে সতর্ক থাকতেই হত।

ভরতের নাট্যশাস্ত্রে নাটকের যে দৈব উৎপত্তির কথা বলা রয়েছে, তা অনুযায়ী চতুর্বর্ণের চক্ষু ও কর্ণের জন্য আনন্দদায়ক এক ক্রীড়নক বা খেলনা ব্রহ্মা সৃষ্টি করেছিলেন, যাতে বেদের মতন শুধু দ্বিজাতিদের একচেটিয়া অধিকার ছিল না। ফলে প্রাকৃতজনের এই শিল্পধারাটিকে অভিজাত শ্রেণির উপযোগী করার জন্য ভরতের মতো আলঙ্কারিকেরা নাটককে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন, সোজা কথায় যাকে ‘সেন্সার’ করা, নাট্যবস্তুর উপরে কাঁচি চালানো। নাটকে কী-কী দেখানো যাবে না তার একটা লম্বা তালিকা করে দেওয়া হয়েছিল। যেমন নায়ক-নায়িকার বিবাহ দৃশ্য, তাদের রতি বা কামসম্ভোগ, স্নানের দৃশ্য, অনুলেপন, দন্তাঘাত, নখাঘাত দেখানো নিষিদ্ধ। উদ্দেশ্য, অশ্লীলতা পরিহার। আবার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কাউকে হত্যার মতো হিংসাত্মক কিছুও দেখানো বারণ।

উল্লেখযোগ্য ভাবে, নিষিদ্ধ হয়েছিল ‘রাজ্যদেশাদিবিপ্লবঃ’ বিষয়ক কোনও দৃশ্যের উপস্থাপন। টীকাকারেরা আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘রাজ্যবিপ্লব’ বা ‘রাষ্ট্রবিপ্লব’-এর মূল অর্থ হল রাজাকে পদচ্যুত করে বা হত্যা করে শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো। অন্য দিকে ‘দেশাদিবিপ্লব’ শব্দের অর্থ বিভিন্ন রকম হতে পারে। দেশে বন্যা-দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি প্রাকৃতিক কারণে পরিবর্তন অথবা ‘আদি’ পদের দ্বারা ধর্মবিপ্লব বা সমাজবিপ্লবের মতো সব কিছুকেই বোঝানো হতে পারে। সেই সঙ্গে, “নগরাদ্যবরোধনম্‌” অর্থাৎ সৈন্যদলের রাজ্য বা নগর অবরোধও দেখানো চলবে না।

নিষেধের তালিকা থেকে স্পষ্ট, প্রকাশ্য যৌনতা বাদে রাজতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক যা কিছু নিষিদ্ধ। রাজা যেখানে প্রজার কাছে ‘মহতী দেবতা’, সেখানে এ সব দেখিয়ে প্রজাদের ক্ষিপ্ত করা চলবে না। তা সত্ত্ব্বেও শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকেই ছিল রাষ্ট্রবিপ্লবের আভাস। ‘মুদ্রারাক্ষস’ কূটনীতি প্রধান। আবার শৃঙ্গাররস-প্রধান কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্‌’ নাটকের তৃতীয় অঙ্কে এমন সব বিষয়ের সম্মেলন রয়েছে যে খোদ বিদ্যাসাগর অনার্সের ছেলেমেয়েদের পড়ার উপযোগী করার জন্য তার উপরে কাঁচি চালিয়েছিলেন।

তবে নাট্যশাস্ত্রের প্রথম অধ্যায়েই ভরত বলেছেন, নাটক হবে শ্রমকাতর, শোকার্ত ও তপস্বীদের বিশ্রামজনক; ধর্মসম্মত, আয়ু ও শুভবুদ্ধিবর্ধক, জনগণের কাছে উপদেশজনক। এমন কোনও জ্ঞেয় বস্তু নেই, এমন কোনও শাস্ত্র নেই, বিদ্যা নেই, কলা নেই, এমন কোনও যোগ বা কর্ম নেই যা কিনা নাটকের প্রতিপাদ্য হতে পারে না।

রাজারা কবেই চলে গিয়েছে। রাজা মানে আর দেশ নয়, গণতন্ত্রে মানুষের হাতেই এসেছে দেশের ভার। যদিও ‘রাজদ্রোহ’ আজও ‘দেশদ্রোহ’ শব্দের সমার্থক হয়েই রয়ে গিয়েছে। যখন রাজনৈতিক পটভূমিকা এ ভাবে বদলে গিয়েছে, নাটকের উপস্থাপনরীতি বা উদ্দেশ্যও বহুলাংশে পাল্টে গিয়েছে। এসে গিয়েছে রাজনৈতিক নাটক যা সরাসরি শাসকের উদ্দেশ্যকে প্রশ্ন করে, দেশেরই হিতাকাঙ্ক্ষায়।

তবু ইতিহাসের পাতা উল্টানোর দরকার এটাই বুঝে নেওয়ার জন্য যে ভারতীয় নাটক বা শিল্প শুধু ধর্মকর্মের অংশ ছিল না, তাতে মিশে গিয়েছিল বহু লৌকিক উপদান। শিল্পসৃষ্টির সঙ্গে প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গও যে মিশে ছিল, নাটকের উপরে আরোপিত নিষেধ সেটাই ঈঙ্গিত করে। সেই আমলে এই বাচিক ও আঙ্গিক শিল্পীরাই ছিলেন মূল গণমাধ্যম। এঁরা দেশ থেকে দেশান্তরে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে গিয়ে গিয়ে অভিনয় করতেন, সুখদুঃখের কথা শোনাতেন। আর তখন মানুষ নিজের সুখ-দুঃখের সঙ্গে অন্যের সুখ- দুঃখ মিলিয়ে নিত। সমাজ ও সমাজে তাঁদের অবস্থান সম্পর্কেও হয়তো সচেতন হতেন।

এখন এই সোশ্যাল মিডিয়া লাঞ্ছিত যুগেও নাটক সেই মনকে মনের সঙ্গে সংযুক্ত করার আর দর্শককে সচেতন করার কাজটাই নিরন্তর করে চলেছে।

(সঙ্গের ছবিতে বহুরূপী অভিনীত ‘রক্তকরবী’ নাটকের একটি দৃশ্য)

নাট্যকর্মী ও সংস্কৃত বিভাগীয় প্রধান, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Theatre Theatre Activist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE