Advertisement
E-Paper

ইমরান খানের শাসনে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে উন্নতির আশা কম

ইমরান ক্ষমতায় এসে ভারতের সঙ্গে আলোচনা শুরুর কথা বলেছেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি ও দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগকে সরল করার উপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু যে বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সম্পর্ক আবর্তিত হয়, অর্থাৎ কাশ্মীর সমস্যা, সন্ত্রাসবাদ, দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ, পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা, এবং পাকিস্তানের বিদেশ ও জাতীয় নিরাপত্তা নীতি নির্মাণে সামরিক বাহিনী ও গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর ভূমিকা, এই সব নিয়ে ইমরানের বক্তব্য এখনও অজানা।

পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।

পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।

শিবাশিস চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৮ ০১:০৭
Share
Save

ভারতীয় নিরাপত্তাকর্মীদের নৃশংস হত্যা ভারত-পাকিস্তান আলোচনা ভেস্তে দিয়েছে। ভারতের অভিযোগ, এই ঘটনার দায় নিতে হবে নতুন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে। আলোচনার কথা তুলে তিনি নাকি ইচ্ছাকৃত ভাবে মিথ্যাচার করেছেন। সেই অভিযোগে না ঢুকেও এইটুকু বলা যায় যে ইমরান খানের পাকিস্তান একই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে— অন্তহীন ছায়াযুদ্ধের নিদারুণ বাস্তবে।

ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রিত্বকে কেন্দ্র করে দু’টি সম্ভাবনার কথা শোনা গিয়েছিল। এক, ক্ষমতা বদল হলে পরিবর্তনের একটা সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। ইমরানের দল এই প্রথম ক্ষমতায় এল বলেই তার নীতি ঘিরে অনিশ্চয়তা রয়েছে। অর্থাৎ এই সরকার একই পথে চলবে, না নতুন পথের সন্ধান দেবে, জানা নেই। তবে ক্ষমতার পরিবর্তন মানেই তো নীতির পরিবর্তন নয়; বিশেষত বিদেশনীতির ব্যাপারে দ্রুত দিঙ‌্‌নির্দেশ শুধু দুরূহ নয়, প্রায় অসম্ভব। নেতিবাচক মতাবলম্বীরা তাই নতুন সরকারের থেকে কোনও পরিবর্তনের আশা রাখছেন না।

ইমরান ক্ষমতায় এসে ভারতের সঙ্গে আলোচনা শুরুর কথা বলেছেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি ও দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগকে সরল করার উপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু যে বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সম্পর্ক আবর্তিত হয়, অর্থাৎ কাশ্মীর সমস্যা, সন্ত্রাসবাদ, দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ, পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা, এবং পাকিস্তানের বিদেশ ও জাতীয় নিরাপত্তা নীতি নির্মাণে সামরিক বাহিনী ও গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর ভূমিকা, এই সব নিয়ে ইমরানের বক্তব্য এখনও অজানা। মনে রাখতে হবে, ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব একাধারে ভূখণ্ড, জাতীয় পরিচিতি ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক। বিবাদের মধ্যমণি অবশ্যই কাশ্মীর বিতর্ক, যাকে অনেকেই দেশভাগের অমীমাংসিত কারবার মনে করেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রতিপত্তি এই মনোভাবকে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে। দেশের দুর্বল গণতান্ত্রিক সরকার কাশ্মীর প্রসঙ্গে কোনও সমঝোতার মনোভাব ব্যক্ত করলেই সামরিক নেতৃত্ব তাদের নিয়ন্ত্রণ কঠোরতর করে থাকে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামোর গুণগত পরিবর্তন ছা়ড়া এ ছবি পাল্টাবে না।

পাকিস্তানের রাষ্ট্র ও সমাজের দিকে নজর দিলে, কেন ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্কে মৌলিক পরিবর্তন সম্ভব নয়, তা বোঝা যায়। জ়ুলফিকার আলি ভুট্টোর হত্যার পর রাষ্ট্রপতি জ়িয়া-উল হক প্রবর্তিত আইন-সংস্কার পাকিস্তানকে একটি ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। এক দিকে ইসলামিকরণের রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া আর অন্য দিকে আফগানিস্তানে মুজাহিদ যোদ্ধাদের ব্যাপক লড়াই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ও সমাজের অভিমুখ মৌলবাদী রাজনীতির দিকে ঘুরিয়ে দেয়। নিরাপত্তার সঙ্গে ভারত-সংক্রান্ত বিদেশনীতির রাশও সেনাবাহিনীর হাতে চলে আসে। সেনাবাহিনীর উচ্চপদে আসীন হন মৌলবাদী নেতারা। পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলি, তা সে নওয়াজ় শরিফের মুসলিম লিগ হোক বা বেনজ়ির ভুট্টোর পিপিপি, এই ধর্মীয় মৌলবাদের সঙ্গে আপস করাটাকেই বেছে নিয়েছে অন্য কোনও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানের থেকে। ইমরানের তেহরিক-ই-ইনসাফও এর ব্যতিক্রম নয়।

৯/১১-র পরে পাকিস্তান এক দিকে মার্কিন ও নেটো-অন্তর্ভুক্ত জোটের অংশরূপে আল কায়দা ও তালিবান জঙ্গিদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, আবার পাশাপাশি এই শক্তিগুলিকে ইন্ধনও জুগিয়েছে। খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে ও আফগান সীমান্তে তালিবান ও মৌলবাদী দলগুলির সঙ্গে পাক সরকারের জটিল সম্পর্ক পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করেছিল। ক্রমে এক দিকে তালিবানি শক্তি দুর্বল হয়ে প়ড়ে মার্কিন ড্রোন হানার ফলে। অন্য দিকে আইএসআইএস-এর মধ্য দিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদী ও সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি সে দেশের বুকে আধিপত্য বজায় রাখে। এই মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে পাকিস্তানি রাষ্ট্র নিরন্তর সমঝোতা করে নিজের স্থায়িত্বের প্রয়োজনে, আর কাশ্মীর উপত্যকায় সন্ত্রাসবাদী হামলার স্বার্থে। এই যুক্তিতেই নির্মিত হয় ভাল ও মন্দ তালিবানের বিভাজন, কিংবা মাসুদ আজ়হার ও হাফিজ় সৈয়দের মধ্যে পার্থক্যরেখা।

ইমরান খানের রাজনৈতিক উত্থানের পিছনে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা সুবিদিত। সেনা নেতৃত্বের অঙ্গুলিহেলনে পাক সুপ্রিম কোর্ট ইমরানের জয়ের পথ তৈরি করে, অন্য দিকে তাঁর দলের উত্থানও ধর্মীয় রাজনীতির হাত ধরে। সুতরাং এই প্রেক্ষিতকে উপেক্ষা করে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি করার কোনও তাগিদ ইমরানের নেই।

বিদেশনীতির নিরিখেও ইমরানের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। পাকিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনীতি, বেহাল বিদ্যুৎব্যবস্থা, ক্রমবর্ধিত বেকার সমস্যা ইত্যাদি আপাতদৃষ্টিতে অভ্যন্তরীণ সমস্যা মনে হলেও, এগুলো পাকিস্তানের বিদেশনীতির বিষয়ও বটে। ট্রাম্পের তীব্র পাকিস্তান-বিরোধিতা ইমরানের চিন্তা বাড়াবেই। সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের হিসেবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসলামাবাদকে প্রায় ৭৮.৩ বিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য করেছে ১৯৪৮ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে। ৯/১১-র পর আফগানিস্তানে সামরিক অভিযানে সাহায্যের পুরস্কারস্বরূপ আমেরিকা দু’বার পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক ভরাডুবির হাত থেকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু ট্রাম্প জমানা অন্য রকম। অন্য দিকে, চিন এখন পাকিস্তানের ত্রাতার ভূমিকায়। শি জিনপিং তাঁর বিতর্কিত সড়ক উদ্যোগ (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) প্রকল্পের অঙ্গ হিসেবে সিপিইসি-র মাধ্যমে প্রায় ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য পাঠালেও শেষ অবধি তা পাকিস্তানের পক্ষে খুব লাভের হবে বলে মনে হয় না। ইমরান ক্ষমতায় এসেই সিপিইসি নিয়ে অনেক বিভ্রান্তিমূলক কথা বললেন, যা এই আশঙ্কাকেই বদ্ধমূল করে। ভূ-রাজনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সাঁড়াশি চাপে চিনের শর্তাবলি মানা ছাড়া পাকিস্তানের সামনে কোনও রাস্তা খোলা নেই।

২০১৬ থেকে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধের মাত্রা তীব্র করেছে, এবং পাশাপাশি, সন্ত্রাসবাদী দলগুলোকে আরও পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ মদত জুগিয়ে আসছে। এই রণনীতির কান্ডারি সে দেশের সেনাবাহিনী ও গুপ্তচর সংস্থা, এখানে গণতান্ত্রিক সরকারের কোনও স্বাধীন ভূমিকা নেই। মাঝেমধ্যে আলাপ-আলোচনার টেবিলে বসার কথা বলে উত্তেজনার পারা প্রশমনের প্রয়াস ছাড়া ইমরানের আর কিছু করার আছে বলে মনে হয় না।

ভারতের দিক থেকেও, কাশ্মীর সমস্যার অভ্যন্তরীণ চরিত্র বদলেছে। নবনীতা বেরার গবেষণা বলছে, ১৯৮০-র দশক থেকে কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাকামী আন্দোলন চক্রাকারে আবর্তিত। চার দশকে সমস্যার চরিত্র অনেকটা বদলেছে। প্রথমত, কাশ্মীরি জাত্যভিমানের বদলে এসেছে বিশ্বব্যাপী জেহাদের ভাষ্য। দ্বিতীয়ত, কাশ্মীর উপত্যকার রাজনৈতিক চালিকাশক্তি আঞ্চলিক নেতৃত্বের থেকে বহিরাগতদের হাতে গিয়েছে। তৃতীয়ত, এই আন্দোলনের পদ্ধতিগত বৈচিত্র লক্ষণীয়: গণঅভ্যুত্থান থেকে সন্ত্রাসবাদী হিংসা, পাথরবৃষ্টির রণনীতির পাশাপাশি গুপ্ত জঙ্গি অভিযান। চতুর্থত, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের লক্ষ্যেও পরিবর্তন এসেছে। কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি থেকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি, বিপরীতমুখী দুই দাবিই শোনা যায়।

কাশ্মীর তাই আজ দুই যুযুধান রাষ্ট্রের বধ্যভূমি। পাকিস্তানের লক্ষ্য ছায়াযুদ্ধের সাহায্যে এই অস্থিরতা বজায় রাখা, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও হিংসাশ্রয়ী জেহাদি মৌলবাদী শক্তির হাত আরও মজবুত করা, আর কাশ্মীরের ‘মুক্তিযুদ্ধ’-এ সে দেশের অভ্যন্তরীণ মৌলবাদকে আরও রাষ্ট্রোপযোগী করে তোলা। অন্য দিকে, ভারতের রাজনীতির নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির জাতীয়তা কল্পনা ইত্যাদি কাশ্মীরকে নিয়ে নতুন জটিলতা সৃষ্টি করছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দৃষ্টিতে ভারত পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নানা ভাবে দেখা সম্ভব। সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানের লক্ষ্য নিরাপত্তা নয়, ভারতের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও ঈর্ষার মানসিকতা। তাই এই সঙ্কটের সমাধান এত কঠিন। টি ভি পাল বলেছেন, ভারত-পাক সম্পর্ক হল স্থায়ী ও সামঞ্জস্যহীন বৈরিতার উদাহরণ। উন্নত অস্ত্র-ভাণ্ডারের সাহায্যে, সুকৌশলে, জোটের মাধ্যমে ও ছায়াযুদ্ধ তৈরি করে প্রায় জন্মলগ্ন থেকে পাকিস্তান ভারতকে প্রতিহত করে আসছে। চিনকে উপেক্ষা করাও ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। ধারাবাহিকতাহীন মার্কিন নীতি ও উদাসীন রাশিয়া দিল্লির পরিস্থিতি কঠিন করেছে।

উদারনীতি বলে ব্যবসা-বাণিজ্য, গণতন্ত্র ও উদারমনস্ক সমাজ ক্রমে পরিবর্তনের পথ দেখাবে। কিন্তু কেমন করে? আত্মপরিচিতির রাজনীতির হাত ধরে কি পরিবর্তন আসতে পারে? এই রাজনীতি যে শান্তিকামী হবে, তার নিশ্চয়তা কোথায়? ভারত-পাকিস্তানের জটিল সম্পর্কের মৌলিক চরিত্রগত পরিবর্তনের ক্ষমতা তাই ইমরান কেন, কোনও রাজনৈতিক নেতার হাতেই নেই। পাকিস্তানের রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতির পরিকাঠামোয় পরিবর্তন না এলে তার ভারতবিরোধিতারও অবসান হবে না।

লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক

India Pakistan Bilateral Relationship Imran Khan

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy