বিষবৃক্ষের বীজ বপন করিলে বিষফল ফলিবে, তাহাতে আর আশ্চর্য কী। গত ডিসেম্বর মাসে মোদী সরকার কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্যদের এক সম্মেলন ডাকিয়াছিলেন। সেই মহতী সভায় গৃহীত অন্যতম সিদ্ধান্ত ছিল: বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ‘জাতীয় প্রয়োজন’-এর সহিত সমঞ্জস হওয়া আবশ্যক। গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন কেরল বিশ্ববিদ্যালয় নির্দেশ দিয়াছে, গবেষণা প্রকল্প অনুমোদনের সময় লক্ষ রাখিতে হইবে, সেই গবেষণা জাতীয় প্রয়োজন মিটাইবে কি না। অন্য নানা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও বোধ করি অনুরূপ অনুশাসন জারি হইয়া গিয়াছে বা অচিরেই হইবে। এই বিষয়ে অন্তত একটি রাজ্যের তৎপরতা ইতিমধ্যেই কীর্তিত। তাহার নাম গুজরাত। আনুষ্ঠানিক নির্দেশিকা না দিয়াও অবশ্য গবেষণার বিষয় নিয়ন্ত্রণ করা যায়, অনুমান করা চলে, অনেকেই লাঠি না ভাঙিয়া সাপ মারিবার তেমন কৌশল অবলম্বন করিতেছেন বা করিবেন। অতঃপর কেন্দ্রীয় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করিতে চাহিলে আগে দেখিতে হইবে, সেই গবেষণা জাতীয় স্বার্থের উপযোগী কি না।
জাতীয় স্বার্থের ছাঁকনি দিয়া গবেষণা ছাঁকিবার এই উদ্যোগ ভয়ঙ্কর। কেন ভয়ঙ্কর, তাহা বুঝিবার জন্য একটি কাহিনি স্মরণীয়। গত শতকের ষাটের দশকের শেষের দিকে একটি গবেষণা প্রকল্পে সরকারি অর্থ বরাদ্দ মঞ্জুরির আবেদন বিচার করিবার সময় মার্কিন সেনেটের এক সদস্য প্রকল্পের কর্ণধারকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, প্রকল্পটি দেশের প্রতিরক্ষার কাজে লাগিবে কি না। প্রবীণ বিজ্ঞানী জবাব দিয়াছিলেন— না, তেমন কথা তিনি বলিতে পারেন না, তবে তাঁহাদের গবেষণা হয়তো দেশকে প্রতিরক্ষার যোগ্য হইয়া উঠিতে সাহায্য করিবে! ইহা শিক্ষাব্রতীর স্বাভাবিক উত্তর। যথার্থ শিক্ষা এবং গবেষণা কোনও ‘জাতীয় প্রয়োজন’-এর তোয়াক্কা করে না, তাহার এক এবং একমাত্র লক্ষ্য: জ্ঞানের প্রসার। যে দেশ বা জাতি বা রাষ্ট্র সেই জ্ঞানের চর্চাকে নিয়ন্ত্রণ করিতে চাহে, সে কেবল অজ্ঞ ও অশিক্ষিত নহে, সে জ্ঞান এবং শিক্ষার শত্রু। প্রবীণ শিক্ষাবিদ কাঞ্চা ইলাইয়ার ভাষায় বলিলে, ইউনিভার্সিটি কথাটির প্রকৃত অর্থ ইহাই যে, সেখানে ইউনিভার্স বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে কোনও বিষয়ে চর্চা করা চলিবে। বিশ্ববিদ্যালয় নামটিই জানাইয়া দেয় যে, কোনও ‘দেশ’ নাই, থাকিতে পারে না।
নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁহার পারিষদ দলের নিকট অবশ্য এই সকল কথা অর্থহীন। জগৎ ও জীবনের তাবৎ বিষয়কে সঙ্কীর্ণ এবং অসহিষ্ণু অতিজাতীয়তার চশমা দিয়া দেখাই তাঁহাদের রাজত্বের ধর্ম। ব্যবহারিক প্রয়োজনের বাহিরে তাঁহাদের নিকট জ্ঞানের কোনও অর্থ নাই, এমনকি ‘সবই ব্যাদে আছে’ গোছের অহঙ্কার করিবার জন্য যে সব প্রাচীন বিদ্যার কথা তাঁহারা কপচাইয়া থাকেন, সেগুলিও তাঁহাদের রাজনীতির হাতিয়ারমাত্র, চরক-সুশ্রুত বা আর্যভট্ট-ব্রহ্মগুপ্তের জ্ঞানচর্চাতেও তাঁহাদের তিলমাত্র অনুরাগের লক্ষণ আজ অবধি দেখা যায় নাই। এক দিকে অতলস্পর্শী অজ্ঞতা, অন্য দিকে আকাশচুম্বী একাধিপত্যকামিতা— দুই ব্যাধির ক্রিয়ায় মুক্ত চিন্তার প্রতি তীব্র বিরাগ জন্মায়, যে কোনও রকম প্রশ্ন সম্পর্কে দেখা দেয় প্রবল ভীতি। এই ব্যাধিগ্রস্ত মানসিকতায় জারিত ‘জাতীয় প্রয়োজন’ আর কিছুই নহে, মুক্ত চিন্তা এবং তীক্ষ্ণ প্রশ্ন হইতে আত্মরক্ষার প্রয়োজন। এই কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকে প্রবল বিক্রমে ঝাড়াই বাছাই করিয়া ‘নিরাপদ’ করা এখন জরুরি। উদ্বেগের কথা, উপাচার্যদের অন্তত একটি অংশও স্বধর্ম বিসর্জন দিয়া সরকারি ফরমানের নিকট আত্মসমর্পণে প্রস্তুত, হয়তো-বা ব্যগ্র। ইহাই ক্ষমতার বিষক্রিয়া। সেই বিষ তৎক্ষণাৎ হত্যা করে না, তাহা ক্রমশ শরীর ও মনকে অধিকার করিয়া লয়। নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বে তাহার লক্ষণ উত্তরোত্তর ফুটিয়া উঠিতেছে। অন্ধকার ক্রমে আসিতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy