সিপিএমের দফতরের সামনে মোটর বাইক জ্বালানোর চেষ্টা। —নিজস্ব চিত্র
আফ্রিকার কোনও গৃহযুদ্ধদীর্ণ গ্রাম দেখছি না। মধ্য এশিয়ায় আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইও দেখছি না, যেখানে ইরাকি সেনার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে লড়তে দেখা যায় অরাষ্ট্রীয় কুর্দ মিলিশিয়াদের। কোনও দক্ষিণ ভারতীয় ছায়াছবিও দেখছি না। দেখছি আমাদের কোচবিহারকে, দিনাজপুরকে, মুর্শিদাবাদকে, বীরভূমকে, বাঁকুড়াকে, পুরুলিয়াকে। দেখছি এক ভয়ঙ্কর ‘ছায়া-যুদ্ধ’, যা গত কয়েক দিনে গ্রাস করে ফেলেছে প্রায় গোটা গ্রামীণ বাংলাকে এবং অত্যন্ত গভীর কালো ছায়াপাত ঘটিয়ে দিয়েছে গণতন্ত্রের অস্তিত্বের উপরে।
কথিত রয়েছে, কোনও অস্তিত্বের চেয়ে তার ছায়া যখন প্রলম্বিত হতে থাকে, তখন বুঝে নিতে হয় সূর্যাস্ত আসন্ন। তৃণমূলের আকাশে সূর্যাস্ত আসন্ন কি না, বলার সময় এখনও আসেনি। কিন্তু তৃণমূলের মূল অস্তিত্বের চেয়ে তার ছায়া যে আজ প্রলম্বিত, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।
বাংলায় শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে এবং অবাধে নির্বাচন হয় না, এ নিয়ে খেদোক্তি আগেও বহু বার করতে হয়েছে। কিন্তু দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করা যায়নি এই দৃশ্য। বোমা-হাঁসুয়া-লাঠিধারী দুষ্কৃতী বাহিনী আর ব্যাটন-কাঁদানে গ্যাস-রাবার বুলেটধারী পুলিশ বাহিনী প্রায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছুটে যাবে একই দিকে, হামলা বা ‘অ্যাকশন’ করবে একই লক্ষ্যে, পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলবে কোনও অভিন্ন প্রতিপক্ষকে, এবং সেটা ঘটবে আমাদেরই ঘরের উঠোনে, দুশ্চিন্তার সুদূর দিগন্তেও এমন ভাবনা উঁকি দেয়নি।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
কী হচ্ছে এটা! পঞ্চায়েত নির্বাচনের নামে কী চলছে! উন্নয়নের এত বড়াই, কথায়-বার্তায় এত প্রত্যয়, বিরোধী দলের গণভিত্তির প্রতি এত অবজ্ঞা বছরভর। তা হলে নির্বাচনে এত ভয় কেন? লোককে দেখাতে বা লোককে ঠকাতে নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তি জারি হবে, কিন্তু মনোনয়ন আর জমা দিতে দেওয়া হবে না বিরোধীদের। যদি বা মনোনয়ন জমা দিতে পারেন বিরোধী শিবিরের কেউ কেউ, প্রত্যাহারে বাধ্য করা হবে। প্রত্যাহারও করানো যাবে না যাঁদের দিয়ে, তাঁদের জন্য অন্য বন্দোবস্ত হবে, তীব্র ত্রাসের মাঝে অবাধে ভোট লুঠ হবে।
নির্বাচনে সহজে সাফল্য পাওয়ার জন্য এই ‘মডেল’ বাংলার কোনও শাসক আগে কখনও প্রয়োগ করেননি, এমন নয়। এই ‘মডেল’ প্রয়োগের প্রবণতা আগেও দেখা গিয়েছে। কিন্তু তা ওই ‘প্রবণতা’ শব্দটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই ‘মডেল’ই একমাত্র প্রযোজ্য, এই ‘মডেল’ই সর্বত্র প্রযোজ্য এবং এই ‘মডেল’ই নির্বাচনের সমার্থক— তেমনটা আগে কখনও মনে হয়নি। এ বার মনে হচ্ছে।
আরও পড়ুন
পঞ্চায়েত: পুলিশের সামনেই বোমা-গুলি-লাঠি, হামলা চলছেই
বিরোধী আসনে থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিপিএম-এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সরব হতেন যে বিষয়গুলি নিয়ে, রিগিং বা নির্বাচনী সন্ত্রাস বা ভোট লুঠ ছিল তার সামনের সারিতে। বামেরা যে নানা পন্থায় নির্বাচনী কারচুপি চালিয়ে যাচ্ছেন বছরের পর বছর, সে অভিযোগ তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংসদেও সরব হয়েছিলেন। বদলের ডাক দিয়েছিলেন। ক্ষমতার অলিন্দে রং বদলে গেল শেষ পর্যন্ত মমতার ডাকে। নির্বাচনী সংস্কৃতিটাও আগের চেয়ে বদলে গেল। কিন্তু সে বদল কোনও ইতিবাচক বদল নয়, বরং চূড়ান্ত নেতিবাচক পরিবর্তন।
বাংলার বাম শাসকদের মধ্যে যা কিছু নেতিবাচক ছিল, সে সবের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতিমূর্তি ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলের মূল অস্তিত্ব তো সেই সংগ্রামী প্রতিমূর্তিকে ঘিরেই আবর্তিত। সেই অস্তিত্বে ভর করেই তো সাফল্য এসেছিল ২০০৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে, ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে, ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে। পরবর্তী নির্বাচনগুলোর ছবি তা হলে ধীরে ধীরে এ ভাবে বদলে দেওয়ার দরকার পড়ল কেন? বোমা-বন্দুক-মাস্কেট-হাঁসুয়া-টাঙ্গি-হকি স্টিক তো দেখা যেত বামফ্রন্টের ‘ভোট মেশিনারি’ হিসেবে পরিচিত দুষ্কৃতীদের হাতে। ক্ষমতায় আসার জন্য ওই ‘মেশিনারি’র প্রয়োজন তো পড়েনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আজ তা হলে বাংলার যে কোনও ভোটে ওই কুখ্যাত ‘মেশিনারি’র এমন বল্গাহীন দাপট কেন? সদুত্তর কি রয়েছে তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে?
দুষ্কৃতীরা শাসকের আশপাশেই থাকতে চায়, শাসকের কাজে লাগতে চায়, শাসকের অনুগত হিসেবে পরিচিত হতে চায়। তাতে দুষ্কর্ম সহজতর হয়। তাই শাসক বদলে গেলে দুষ্কৃতী যে আনুগত্য বদলে ফেলতে চাইবে, সে অত্যন্ত স্বাভাবিক। প্রশ্ন হল, দুষ্কৃতী আনুগত্য বদলাতে চাইলেই, নতুন শাসক সে সুযোগ দেবেন কেন? যদি বা সে সুযোগ দেন, দলের রাশ দুষ্কৃতীর হাতে যেতে দেওয়া হবে কেন?
গণতন্ত্রের উপর সশস্ত্র হামলা চালাচ্ছেন যাঁরা, মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা-গুলি ছুড়ছেন যাঁরা, বিডিও-এসডিও-ডিএম অফিস ঘিরে রেখে বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দেওয়া দুঃসাধ্য করে তুলছেন আজ যাঁরা, তাঁরা কেউই সম্ভবত তৃণমূলের আদি অস্তিত্বের আত্মীয় নন। তাঁরা তৃণমূলের সঙ্গে ছায়ার মতো জুড়ে গিয়েছেন তৃণমূল ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে। সেই ছায়াই আজ তৃণমূলের মূল অস্তিত্বকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্রের উপর সে ছায়া ভয়ঙ্কর আঘাত হানছে।
সঙ্কটটা কিন্তু তৃণমূলের এই অবক্ষয়-কেন্দ্রিক নয়। সঙ্কটটা আসলে গণতন্ত্রের। আগেও বলেছি, আবার বলতে হচ্ছে, বাংলায় গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে পড়েছে। পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘিরে শাসক আশ্রিত দুষ্কৃতীর উন্মত্ত তাণ্ডবেই সীমাবদ্ধ নেই আজকের সঙ্কট। তাণ্ডবে দুষ্কৃতীর সঙ্গী হতে দেখা যাচ্ছে পুলিশকে। গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপরে এত নির্লজ্জ সংহার এ দেশের কোনও প্রান্তে আগে কখনও দেখা গিয়েছে কি না, স্মৃতি হাতড়ে তা খুঁজে আনা খুবই কষ্টকর হয়ে উঠছে।
বাংলার শাসককুল এত কিছু দেখেও একটুও বিচলিত নয়। এক অদ্ভুত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে যাবতীয় অভিযোগ নস্যাৎ করে দিচ্ছে শাসক দল তথা সরকার। এই নির্লিপ্তিই বলে দিচ্ছে, নির্বাচন ঘিরে উন্মত্ত তাণ্ডবে শাসকের প্রশ্রয় রয়েছে, দলের রাশ বিভিন্ন স্তরে দুষ্কৃতীদের হাতে চলে যাওয়া নিয়ে নেতৃত্বের কোনও আক্ষেপ নেই, দলের ছায়া দলকে ছাপিয়ে যাচ্ছে দেখেও নেতৃবর্গ আশঙ্কিত নন।
ছায়া অতএব আরও প্রলম্বিত হবে। সূর্যাস্তের ক্ষণ কি ক্রমশ এগিয়ে আসছে? উত্তরটা তৃণমূলকেই খুঁজতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy