Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
তাঁদের প্রতিবাদের ভাষা

মিঞা কবিদের গ্রেফতার বলে দেয়, অসমের জনসমাজ কত বিপন্ন

উর্দুতে ‘মিঞা’ শব্দের অর্থ ‘ভদ্রলোক’। কিন্তু, এই ধরনের কবিতায় ব্যবহৃত ‘মিঞা’ সম্প্রদায়ের মধ্যে ঠিক কারা পড়েন, কেনই বা তাঁদের জাতিগত পরিচয় বর্তমান অসমে এত অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে, সেটা খুঁজে বার করতে গেলে ফিরে যেতে হবে ব্রিটিশ শাসনকালে বা তারও আগে।

আত্মপরিচয়: আধার কার্ড ও এনআরসি-র সংযোগ তৈরির ‘পরীক্ষা’য় চোখ চিহ্নিতকরণ চলছে অসমে, ১০ অগস্ট, বরপেটা। ছবি : এএফপি

আত্মপরিচয়: আধার কার্ড ও এনআরসি-র সংযোগ তৈরির ‘পরীক্ষা’য় চোখ চিহ্নিতকরণ চলছে অসমে, ১০ অগস্ট, বরপেটা। ছবি : এএফপি

অনিন্দিতা ঘোষাল
শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৯ ০০:১১
Share: Save:

মিঞা কবিতা। সেটা আবার কী? এখনও অবধি অসমের বাইরে অন্যান্য রাজ্যের মানুষ, এমনকি সাহিত্যজগতের সঙ্গে যুক্ত মানুষের মধ্যেও এই বিশেষ ধরনের লেখা সম্পর্কে বিশেষ সচেতনতা নেই। মিঞা কবিতােক আদৌ সত্যিকারের সাহিত্যের মর্যাদা দেওয়া যায় কি না, না কি এটি শুধু এক প্রাদেশিক বা স্থানীয় সমস্যা থেকে উদ্ভূত এক প্রতিবাদী ভাষা, তা নিয়ে অসমের মানুষও হয়তো ধন্দে আছেন। তবু, এত অস্পষ্টতা সত্ত্বেও মিঞা কবিতা এখন বিরাট ‘খবর’। গত ১০ জুলাই গুয়াহাটির পানবাজার থানায় এফআইআর দায়ের করা হয় দশ জন ‘মিঞা কবি’র বিরুদ্ধে। এফআইআর রুজু করা হয় ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা ১২০(বি), ১৫৩(এ), ২৯৫(এ), ১৮৮, আইটি অ্যাক্ট-এর ৬৬(এ) ধারাকে ব্যবহার করে, যা সংবিধানের ১৫, ১৬, ১৯ ও ২১ ধারাকে লঙ্ঘন করে।

কেন? মিঞা কবিদের অপরাধ কী? সাংবাদিক প্রণবজিৎ দলুই অভিযোগ এনেছেন যে, মিঞা কবিদের আসল উদ্দেশ্য— তাঁদের লেখার মাধ্যমে সকলের সামনে অসমিয়া জনগণকে জাতিবিদ্বেষী হিসেবে তুলে ধরা— যা অসম তো বটেই, জাতীয় নিরাপত্তা ও সামাজিক ঐক্যের পরিবেশ সৃষ্টির পথে ক্ষতিকারক। কিন্তু এই মিঞা শব্দের অর্থ কী? মিঞা ভাষাই বা কাকে বলে? মিঞা কবি কারা? তাঁদের রচিত কবিতায় সমস্যার জায়গাগুলোই বা কী?

উর্দুতে ‘মিঞা’ শব্দের অর্থ ‘ভদ্রলোক’। কিন্তু, এই ধরনের কবিতায় ব্যবহৃত ‘মিঞা’ সম্প্রদায়ের মধ্যে ঠিক কারা পড়েন, কেনই বা তাঁদের জাতিগত পরিচয় বর্তমান অসমে এত অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে, সেটা খুঁজে বার করতে গেলে ফিরে যেতে হবে ব্রিটিশ শাসনকালে বা তারও আগে। অসমের মিশ্র সংস্কৃতির আবহে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা মুসলমান কৃষক শ্রেণি স্বাধীন ভারতে ‘নব্য অসমিয়া’ বলে পরিচিত হয়। ১৯২১ এবং ১৯৩১-এর জনগণনায় সরকারি ভাবে প্রথম এই মুসলমান কৃষকদের ক্রমবর্ধমান অস্তিত্বের কথা জানা যায়। তখনকার অসমে অনাবাদি জলাজমি পরিষ্কার করে সোনার ফসল ফলিয়েছিলেন তাঁরা। মৌলানা ভাসানি এঁদের উদ্দেশেই ডাক দিয়েছিলেন ‘চল চল আসাম চল, আল্লাহ্‌-এর জমি চাষ কর’। এমনকি এঁদের সংখ্যাধিক্য ব্রিটিশ সরকারকে বাধ্য করেছিল অসমে ‘লাইন প্রথা’ প্রবর্তনে। কিন্তু দেশভাগের আগে পর্যন্ত এই বাঙালি মুসলমান চাষি সম্প্রদায়কে দেখা হত বন্ধ্যা জমিতে ফসল ফলানোর কারিগর হিসেবে। স্বাধীনতার পর থেকে সেই হিসেব ক্রমশ পাল্টাতে শুরু করল। বাঙালি-অসমিয়া জাতীয়তাবাদ ও সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু পরিমাণ মাপের অঙ্কে এই শ্রেণি আঁকড়ে ধরেছিলেন তাঁদের জমির অধিকারকে এবং তার থেকে পাওয়া আবাদি পরিচয়কে। ১৯৫১ সালে স্বাধীন ভারতে প্রথম জনগণনা হলে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁরা স্পষ্ট উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমাগো ভাষা অহমিয়া।’ কিন্তু তথাকথিত ভাষিক পরিচয়ের এই পরিবর্তন যে তাঁদের ধর্মীয় পরিচয়কে আড়াল করতে পারেনি, তার জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেল ১৯৮৩ সালের নেলি হত্যাকাণ্ডের সময়। ২০১৪ সালের বড়ো ও বাঙালি মুসলমানদের সংঘর্ষের সময়েও তাঁদের ধর্ম, ভাষা ও জাতিগত অস্তিত্বের প্রশ্ন উঠে এল।

এই ইতিহাস মাথায় রেখে মিঞা ভাষার উৎপত্তি খুঁজতে বসলে দেখব যে, এটা আসলে বাংলা বা অসমিয়া, কোনও ভাষারই উপভাষা নয়। বরং সিলেটি, ময়মনসিংহি, অসমিয়া, কামতাপুরি— অনেকগুলো ভাষার সংমিশ্রণে তৈরি এই ভাষা। যার আর এক নাম ‘চর-চাপরির ভাষা’। এই ‘চর-চাপরির মানুহ’রা তাঁদের ‘চরুয়া’ এবং ‘পামুয়া’ অস্তিত্বের সঙ্কট নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগতেন। সে দিক দিয়ে অসমে বসবাসকারী পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানদের বঞ্চনার ইতিহাসও এই ভাষার সঙ্গে জড়িত।

স্বাধীনতা-উত্তর অসমে ‘মিঞা’ শব্দের মধ্যে যে তীব্র শ্লেষ, বিদ্রুপ ও অপমান জড়িয়ে আছে, সেই বিদ্বেষ, আর কোনও কোনও ক্ষেত্রে অভিমান থেকেই ‘নব্য অসমিয়া’রা এই গালিকে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলা শোষণ ও বঞ্চনার প্রতিবাদ করতে শুরু করেন। তাঁদের প্রতিবাদ জানানোর ভাষাও পাল্টে যায়। অসমে দীর্ঘ সময় ধরে বসবাসের পরও অকারণে তাঁদের অভিহিত করা হয় ‘বাংলাদেশি’ বা ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ বলে। বিশেষত ২০১৪ সাল থেকে এনআরসি প্রক্রিয়ায় তাঁদের নিয়ে অসমের নাগরিক সমাজে যে প্রাত্যহিক সন্দেহ, তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ভাসমান অস্তিত্বকেই তাঁরা তুলে ধরেছেন নিজেদের পরিচয় হিসেবে। নিজেদের দৈনন্দিন যন্ত্রণা প্রকাশের হাতিয়ার করেছেন কবিতাকে।

এ ক্ষেত্রে মূল সমস্যার প্রথম সূত্রপাত ‘চর চাপরি সাহিত্য পরিষদ’-এর সভাপতি ড. হাফিজ আহমেদের ইংরেজিতে লেখা একটি কবিতা নিয়ে, যার প্রথম কয়েকটি লাইন হল: ‘‘রাইট, রাইট ডাউন, আই অ্যাম আ মিঞা। মাই সিরিয়াল নম্বর ইন দ্য এনআরসি ইজ় ২০৫৪৩। রাইট, রাইট ডাউন, আই অ্যাম আ মিঞা। আ সিটিজ়েন অব আ সেকুলার ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক, উইদাউট এনি রাইটস।’’ এই কবিতা স্যোশাল মিডিয়ায় তিনি প্রথম পোস্ট করেছিলেন ২০১৬ সালের ২৯ এপ্রিল। সেই থেকে শুরু এই মিঞা কবিদের প্রতিবাদ। তাঁদের ওপর সংগঠিত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিপীড়নের প্রতিবাদ হিসেবে কবিতার ব্যবহার।

কিন্তু এই প্রথম নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে মিঞা অস্তিত্বের জানান দিয়ে লেখা কবিতার সন্ধান পাওয়া যায় দেশভাগের আগেও। ১৯৩৯ সালে মৌলানা বন্দে আলি ‘চরুয়া’দের নিয়ে লেখা কবিতায় ‘মিঞা’ শব্দটি ব্যবহার না করলেও তাঁরাই ছিলেন ওই কবিতার মূল উপজীব্য। ‘মিঞা’ শব্দের প্রথম জোরালো উচ্চারণ শোনা যায় নেলি হত্যাকাণ্ডের পরে কবীর আহমেদ যখন লেখেন ‘‘আমি এ দেশের বাসিন্দা, এক ঘৃণিত মিঞা’’ (১৯৮৫)। কিন্তু তখনও তাঁর কবিতা রাষ্ট্রের কাছে ‘থ্রেট’ হয়ে ওঠেনি।

তা হলে এখন কেন মিঞা কবিতা নিয়ে এত সমস্যা? কী এমন আছে সেই নতুন কণ্ঠে? কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। কুড়ির কোঠায় বয়স, রেহানা সুলতানা লিখেছেন, ‘‘আমি মিঞা, তুমিই আমগো মা/ তোমার কোলেই জন্ম আমার... তোমার কোলেই জন্ম আমগো বাবার ও মার, আমগো দাদার/ মা, তাও তুমি কও আমি তোমার আপন না, আমি তোমার কেউ না/ কারণ আমার পরিচয়, তোমার কোলে জন্ম নেওয়া আমি সেই অভিশপ্ত মিঞা।’’ আবদুর রহিম লিখেছেন, ‘‘আর কত দিন এই ভাবে চাইপ্যা-চুইপ্যা থাকুম?/ এইটা আমার দেশ বইলা আর কত দিন বোবা হইয়া থাকুম? আর কত চোখের পানি ফালাইলে আমি মানুষ হওয়ার যোগ্যতা পামু?’’ কাজি নীল-এর ইংরেজি কবিতা বলছে, ‘‘যে দেশ আমার বাবাকে বিদেশি বানায়/ যে দেশ আমার ভাইকে গুলি করে মারে/ যে দেশে আমার বোন মরে গণধর্ষণে/ যে দেশে আমার মা বুকে আগুন চেপে রাখে/ সেই দেশ আমার, আমি সেই দেশের না।’’

‘মিঞা’ কবিদের সংখ্যা এখন কুড়ির কাছাকাছি। বহু শতাংশ চরুয়া শিক্ষালোক-বঞ্চিত হলেও, শিক্ষিত যাঁরা, তাঁদের অনেকেই থাকেন রাজ্যের বাইরে। তাঁরা অনেকে উচ্চশিক্ষিত, কেউ আবার সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। তাঁরাই এই সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের সঙ্কট নিয়ে বিভিন্ন ভাষায় লিখে চলেছেন। কিন্তু হীরেন গোঁহাই-এর মতো সাহিত্যিক বা অসম সাহিত্য সভার মতো সংস্থা হঠাৎ মিঞা কবিতার গতি প্রতিরোধে ব্যস্ত কেন? বিশেষত যেখানে দিল্লিতে কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভ-এর ডিরেক্টর, অসমিয়া সমাজবিজ্ঞানী সঞ্জয় হাজরিকা এই ধরনের কবিতা আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়েছেন? তবে কি এই প্রতিবাদের হেতু লুকিয়ে আছে ‘মিঞা’-দের ডি-ভোটার হওয়ার আশঙ্কায়, নাগরিকত্ব না থাকার প্রশ্নে? লক্ষণীয়, গত অক্টোবরে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা স্পষ্ট খারিজ করে দিয়েছেন অসমে মুসলমানদের আশ্রয় পাওয়ার সম্ভাবনার প্রশ্ন। অসমের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল-এ (২০১৬) মুসলমানদের কোনও উল্লেখ নেই। ‘মিঞা’দের আশঙ্কা বাড়ছে সেই থেকে।

ধর্ম, ভাষা ও বাসভূমির বৈচিত্রে সমৃদ্ধ অসমের জনসমাজ এখন বিপুল বিপদের মধ্যে। মিঞা কবিতা নিয়ে রাজনৈতিক আলোড়ন— তার সাক্ষাৎ প্রমাণ।

লেখক : ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Assam Demography
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE