Advertisement
E-Paper

যবনিকা

সিঙ্গুর-নাট্যের সূচনা হইতে পরিসমাপ্তি, এবং তাহাকে কেন্দ্র করিয়া রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদল, গোটা ঘটনাক্রমের মধ্যে বঙ্গসমাজের, বঙ্গ-মানসিকতার একটি নির্ভুল ছবি ধরা পড়িয়াছে।

শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৭ ০০:০০

ধূলি হইতে জন্ম, ফের ধুলাতেই মিশিয়া যাওয়া। ধর্মগ্রন্থ বলিবে, ইহাই মনুষ্যজীবনের সারসত্য। বঙ্গ-রাজনীতির নথি বলিবে, ইহা রাজ্যের শিল্প-সম্ভাবনারও সারসত্য বটে। তবে, ধুলা নহে, ছাঁট। এক দশক পূর্বে যে লোহায় ভর করিয়া পশ্চিমবঙ্গের শিল্প-ভবিষ্যৎ নূতন করিয়া লিখিবার চেষ্টা হইয়াছিল, তাহা ফের লোহা— আরও নির্দিষ্ট করিয়া বলিলে, লোহার ছাঁট— হিসাবেই বিক্রয় হইয়া গেল। সিঙ্গুরে। সাড়ে সতেরো কোটি টাকায়। কত টাকা খরচ করিয়া এই কাঠামোটি নির্মিত হইয়াছিল, ছাঁটের প্রকৃত দাম কত হওয়া উচিত ছিল, সেই প্রশ্নগুলি অবান্তর, কারণ ব্যয় বনাম বিক্রয়মূল্যের তুল্যমূল্য হিসাবে রাজ্যের ক্ষতির অংকটি ধরা পড়িবে না। নিলাম ডাকিয়া যাহা বিক্রয় করা হইল, তাহা বাহ্যিক ভাবে যাহাই হউক না কেন, প্রকৃত প্রস্তাবে তাহা একটি সম্ভাবনা। রাজ্যের মোড় ঘুরাইবার সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনার বিক্রয়মূল্য হয় না। সিঙ্গুরের বিতর্কিত হাজার একর ফের কৃষির উপযোগী হইল কি না, যাঁহারা জমি ফিরিয়া পাইলেন, তাঁহারা সত্যই কৃষিতে ফিরিবেন কি না, সেই প্রশ্নগুলিও অর্থহীন। কারণ, কৃষি বনাম শিল্পের বিতর্কটি বহু পূর্বেই মিলাইয়া গিয়াছে। হাজার একরে যাহা পড়িয়া ছিল, তাহার নাম জেদ। সিঙ্গুরের হাওয়ায় কান পাতিলে হয়তো দীননাথ বাত্রাদের কোপে পড়া এক কবির একটি পঙ্‌ক্তির অনুরণন শোনা যাইবে— জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ।

এই নিলামে পশ্চিমবঙ্গ সম্বন্ধে দুনিয়ার মনোভাবে ইতরবিশেষ হইবে, ভাবিবার কোনও কারণ নাই। বুলডোজার আসিয়া যে দিন কারখানাটিকে গুড়াইয়া দিয়াছিল, সে দিনও রাজ্য সম্বন্ধে কেহ নূতন করিয়া ভাবিতে বসেন নাই। পশ্চিমবঙ্গ যে শিল্পের পরিবর্তে রাজনীতিকে বাছিয়া লইয়াছে, এই কথাটি বুঝিবার জন্য দুনিয়া এই দিনগুলির অপেক্ষায় ছিল না। তবুও, এই নিলামের গুরুত্ব আছে। ইহা রাজ্যের শিল্প-সম্ভাবনার নাটিকার ক্লোজার— যবনিকা পতন। যাহার পর আর কিছু থাকিতে পারে না। বিক্রয় হইয়া যাওয়া লোহার ছাঁট গলাইয়া তেলেভাজার কড়াই তৈরি হইবে কি না, তাহা ভিন্ন উপাখ্যান। রাজ্যের শিল্প-সম্ভাবনার সহিত তাহার আর কোনও সম্পর্ক নাই।

সিঙ্গুর-নাট্যের সূচনা হইতে পরিসমাপ্তি, এবং তাহাকে কেন্দ্র করিয়া রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদল, গোটা ঘটনাক্রমের মধ্যে বঙ্গসমাজের, বঙ্গ-মানসিকতার একটি নির্ভুল ছবি ধরা পড়িয়াছে। বাঙালি পরিবর্তনে ভয় পায়। যত ক্ষণ অবধি রাজনীতির চরিত্র অপরিবর্তিত থাকে, রং বদলাইলে তাহার অস্বস্তি হয় না। কিন্তু, অচেনায় তাহার ভয় দুর্মর। শিল্প, এবং তৎসংক্রান্ত পরিবর্তনগুলি একুশ শতকের বাঙালির অচেনা। তাহার পূর্বের অর্ধশতক সে শিল্প দেখে নাই। ফলে, সম্ভাবনাটির অঙ্কুরোদ্গম মাত্র বাঙালি দিশাহারা হইয়াছিল। সেই কারখানার নটেগাছটি মুড়াইয়া, রাস্তা উপড়াইয়া, বাহির হইতে মাটি আনিয়া ফেলিয়া অধিগৃহীত হাজার একরকে পুনর্মূষিক করিয়া দেওয়া আসলে সেই বিব্রত বাঙালিকে স্বস্তির সন্ধান দেওয়া। এই চেনা মাটিতে ফের চেনা ফসল ফলিবে কি না, বাঙালির নিকট সেই প্রশ্ন অবান্তর। মাটির চেহারা যথাপূর্বম্ হইল, অভ্যাসের আরাম ফিরিয়া আসিল, অল্পেতে খুশি বাঙালি ইহার অধিক কখনও চাহে নাই। তাহার জন্য শিল্প-সম্ভাবনা যদি ধূলিতে ফিরিয়া যায়, যাউক।

Singur Tata Nano controversy Land Singur Tata Iron সিঙ্গুর
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy