Advertisement
E-Paper

প্রাচীরও তাঁর কাছে ব্যবসা

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তাঁর সম্পর্কে মানুষের ধারণা ছিল তিনি আত্মসর্বস্ব অভব্য এক ধনকুবের, টিভি ব্যারন, চটকদার কথায় লোকের মন ভোলানোর চেষ্টা করেন।

শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৯ ০০:০১

প্রশ্ন: হোয়াইট হাউসে আড়াই বছর কাটিয়ে দিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প সম্পর্কে আমেরিকার মানুষের ধারণা কিছুটা হলেও পাল্টেছে?

নিনা ক্রুশ্চেভা: ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তাঁর সম্পর্কে মানুষের ধারণা ছিল তিনি আত্মসর্বস্ব অভব্য এক ধনকুবের, টিভি ব্যারন, চটকদার কথায় লোকের মন ভোলানোর চেষ্টা করেন। আড়াই বছর ধরে আমেরিকার সাধারণ মানুষ দেখলেন, লোকটা সত্যিই এ-রকম। শুধু আমেরিকা নয়, সারা পৃথিবীর মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন, কেমন মানুষ ট্রাম্প। দুঃখের বিষয়, বহির্বিশ্বের কাছে তিনিই এখন আমেরিকার ‘মুখ’!

প্র: ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে দীর্ঘতম শাটডাউন হল আমেরিকায়। এই অচলাবস্থা বিশ্বকে কী বার্তা দিল?

উ: সময় ও সম্পদ তো নষ্ট হলই, প্রাচীর তুলতে ব্যগ্র প্রেসিডেন্ট দেশের সুরক্ষা নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে কথা বলার একটা ভাল সুযোগ হারালেন। এই প্রাচীর প্রেসিডেন্টের ট্রাম্পের কাছে তাঁর ক্ষমতা ও দম্ভের প্রতীক হয়ে উঠেছে। পৌরুষেরও। লক্ষণীয়, এক মহিলাই (বিরোধী ডেমোক্র্যাট নেত্রী তথা হাউস অব রিপ্রেজ়েন্টেটিভস-এর স্পিকার, ন্যান্সি পেলোসি) প্রাচীর তোলার প্রধান বিরোধী স্বর। মহিলাদের বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেন না ট্রাম্প। ভোটের আগেই আমরা শুনেছিলাম, মেয়েদের সম্পর্কে কী ধরনের আপত্তিকর মন্তব্য করতে অভ্যস্ত তিনি। তাই এক জন মহিলার ট্রাম্পকে থামিয়ে দেওয়ার এই চেষ্টা বিশেষ প্রতীকী হয়ে উঠেছে।

প্র: প্রাচীর বানানোয় ট্রাম্পের বেশ কিছু পূর্বসূরি আছেন— সকলেই স্বৈরাচারী শাসক। তাঁদের সঙ্গে কি আপনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে একাসনে রাখবেন?

উ: সেই কোন কাল থেকে প্রাচীর বানিয়ে বিভেদ তৈরির চেষ্টা চলেছে। প্রথমেই বলব খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে চিনের প্রথম সম্রাট ছিন শি হুয়াংয়ের বানানো প্রাচীরের কথা। আধুনিক ইতিহাসেও এই বিভাজন নীতির অসংখ্য নজির। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানি-অধিকৃত বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের মধ্যে প্রাচীর তৈরি করেছিল জার্মানি। তার পর পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানিকে বিভক্ত করতে আমার প্রমাতামহ, নিকিতা ক্রুশ্চেভ পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনের মধ্যে বানিয়েছিলেন কংক্রিটের ‘বার্লিন প্রাচীর’। মদত জুগিয়েছিলেন পূর্ব জার্মানির তৎকালীন শাসক ভাল্টার উলব্রিখ্ট। ২০১৫-তে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবানের নির্দেশে সার্বিয়া সীমান্তে বানানো হল ১০০ মাইল লম্বা, ১৩ ফুট উঁচু কাঁটাতারের বেড়া। তবে, ক্রুশ্চেভের স্থান-কাল সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। ট্রাম্পকে আমি বলব এক ‘গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী’ বা ‘সঙ্কীর্ণমনা গণতান্ত্রিক’ শাসক। ভিক্টর ওরবান, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়িপ এর্দোয়ান, মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফতে এল সিসি, বা ভারতের নরেন্দ্র মোদী— এঁরা সকলেই এই দলের।

প্র: প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারে ট্রাম্প বলতেন, মেক্সিকো থেকে টাকা আদায় করে প্রাচীর তুলবেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, মার্কিন করদাতাদের টাকা ছাড়া এই প্রাচীর বানানোর কোনও উপায় নেই। আগে যাঁরা ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিলেন, এখনও কি তাঁরা তাঁর প্রাচীর-পরিকল্পনা সমর্থন করছেন?

উ: দে-ও-য়া-ল। এই চারটে অক্ষরের মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে ‘অনেক বেশি নিরাপদ’ ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। আমেরিকার সাধারণ মানুষ সেই স্বপ্নটাই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন, যতটা জোরে পারা যায়, যত দিন ধরে পারা যায়। যাঁঁরা স্বপ্নে মজেছিলেন তাঁরা ভেবেছিলেন, এই প্রাচীর আমেরিকার মানুষকে রক্ষা করবে। নিউ ইয়র্কে ট্রাম্প তাঁর ব্যবসা চালাতেন ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে, লোক ঠকিয়ে। নিজের ব্যবসার জন্যও অন্য জায়গা থেকে টাকা জোগাড় করতেন। আমার দৃঢ় ধারণা, প্রাচীর তৈরি করাকেও একটা ব্যবসার চেহারা দিতে চাইছেন তিনি। প্রাচীর তোলার জন্যও টাকা চাইছেন করদাতাদের কাছ থেকে।

প্র: আপনি তো বহু বছর ধরে আমেরিকায় রয়েছেন, সেখানেই পড়াচ্ছেন। আমেরিকা সম্পর্কে আপনার যে-ধারণা, গত কয়েক বছরে তার কি কোনও পরিবর্তন হয়েছে? গত কয়েক বছরে আমেরিকা কি বেশি অসিহষ্ণু হয়ে উঠেছে?

উ: আমেরিকা সত্যিই এক মহান দেশে। কিন্তু যে-কোনও সুপারপাওয়ারই ‘আমরা সব থেকে মহান’, ‘আমরা সব ভুলের ঊর্ধ্বে’, এই ধরনের ভাবাবেগে ভুগতে থাকে। আমেরিকাও তার ব্যতিক্রম নয়। আর একটা বড় সমস্যা, এখানে অনেকের মধ্যেই সব কিছু সাদা-কালোয় দেখার প্রবণতা রয়েছে। ‘অপর’-এর উপস্থিতি অগ্রাহ্য করা বা নিজের দোষত্রুটি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অসচেতন থাকা, এগুলোই বিপদ ডেকে আনে। এই এক-মেরুর জীবনদর্শনের চরম প্রকাশ ডোনাল্ড ট্রাম্প। সে-দিক থেকে, তিনি এক সার্থক মার্কিন ‘প্রডাক্ট’। তাঁকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনল মার্কিন আমজনতাই। কিন্তু গত আড়াই বছর ধরে সেই ‘ভুল’-এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে রাশিয়াকে। বলা হচ্ছে, রুশ হ্যাকাররাই ট্রাম্পকে জিতিয়ে দিয়েছেন। আমেরিকা কিছুতেই স্বীকার করছে না যে, ট্রাম্পকে ক্ষমতার মসনদে বসানোর ভুলটা তারা নিজেরাই করেছে!

প্র: ট্রাম্পের আমেরিকা ও পুতিনের রাশিয়ার মধ্যে কি কোনও তফাত রয়েছে?

উ: প্রায় প্রতি মাসেই রাশিয়া যাই। দুই গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসক, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও প্রেসিডেন্ট পুতিনের মধ্যে অনেক মিল থাকতে পারে। কিন্তু ট্রাম্পের আমেরিকা ও পুতিনের রাশিয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আমেরিকা যেমন শুধু ‘ট্রাম্পের’ নয়, তেমনই রাশিয়া শুধু ‘পুতিনের’ নয়। প্রত্যেকটি জাতিসত্তার মধ্যে এই ‘বহুত্ব’ রয়েছে, এবং সেটা বোঝা খুব জরুরি।

প্র: আমেরিকার ছাত্র রাজনীতির সাম্প্রতিক এমন কোনও আন্দোলনের কথা উল্লেখ করতে চান, যা বৃহত্তর রাজনীতিতে ছাপ ফেলেছে?

উ: এ দেশের ৯৯ শতাংশ আন্দোলনেরই জন্ম কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। যেমন, সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলির মধ্যে বিশেষ ভাবে বলা যায় #মিটু এবং #ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার, এই দু’টির কথা। আমরা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরাও সমানে চেষ্টা চালিয়ে যাই, যাতে ছাত্রছাত্রীরা সাদা-কালোর চশমা দিয়ে দুনিয়াটা না-দেখেন। অন্য সংস্কৃতিকে বোঝার চেষ্টা সেই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর প্রাথমিক ধাপ।

নিউ ইয়র্কের ‘দ্য নিউ স্কুল’-এর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক
সাক্ষাৎকার: সীমন্তিনী গুপ্ত

Mexico Wall Donald Trump USA
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy