Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

শিক্ষার সঙ্গেই সংস্কৃতিচর্চার ঐতিহ্য পাইকরে

সে দিনের সামাজিক প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। মানুষ ছিল সাদামাটা। গভীর আস্থা ছিল শিক্ষকের প্রতি। আর এ আস্থা তথা প্রত্যাশা শিক্ষককেও করে তুলত যেন গ্রামের আভিভাবক। আজ বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতেও এ গ্রামে শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও অভিভাবক-শিক্ষক সম্পর্ক আত্মিক। লিখছেন গোপা চট্টোপাধ্যায়।শিক্ষাচর্চার সঙ্গে সংস্কৃতিচর্চাও কম ছিল না পাইকরে। যতীন্দ্রমোহনের পৃষ্ঠপোষকতা ও সক্রিয় যোগদানের মাধ্যমে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয় এ গ্রামে নানা সংস্কৃতির চর্চা।

মঞ্চ: সূর্য নেই স্বপ্ন আছে নাটকের দৃশ্য। ছবি: লেখক

মঞ্চ: সূর্য নেই স্বপ্ন আছে নাটকের দৃশ্য। ছবি: লেখক

শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৫:১২
Share: Save:

পাইকর গ্রামে একটি মাইনর স্কুল (প্রাথমিক) ছিল। মধ্যশিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে পাইকর উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৯২৭ সালে। গ্রামের মানুষের আর্থিক আনুকুল্যে এবং পাইকরের তৎকালীন নায়েব যতীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের মুখ্য সহায়তায়। সে-সময় আশপাশের অসংখ্য গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়ানোর একমাত্র আলকবর্তিকা ছিল পাইকর উচ্চ বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই এই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার পালন করেন শ্রী উমাপতি পালধি আর সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদে আসীন হন নিত্যগোপাল চক্রবর্তী (আমার মাতামহ)। পরিচিত ছিলেন সেকেন্ড মাস্টার নামে। শুনেছি, সে কালে শিক্ষকেরা তাঁদের শিক্ষা ও শাসন বিদ্যালয় গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতেন না, প্রয়োজনে তত্ত্বাবধান করতেন শিক্ষার্থীর আর্থ সামাজিক অন্তরায়গুলিরও। তাই বোধহয় মাস্টারমশায় ডাকটির মধ্যে থাকত গভীর শ্রদ্ধা, ভয়ও।

সে দিনের সামাজিক প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। মানুষ ছিল সাদামাটা। গভীর আস্থা ছিল শিক্ষকের প্রতি। আর এ আস্থা তথা প্রত্যাশা শিক্ষককেও করে তুলত যেন গ্রামের আভিভাবক। আজ বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতেও এ গ্রামে শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও অভিভাবক-শিক্ষক সম্পর্ক আত্মিক। প্রসঙ্গত জানাতে চাই একেবারে শুরুর দিকে বিদ্যালয়ের ফলাফলকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হত। উনবিংশ শতকের শেষ দিক থেকেই বীরভূম জেলার বেশ কিছু গ্রাম ছিল সচেতন, সংস্কারমুখী। গৌরবের এটাই যে, পাইকর ছিল সেগুলির অন্যতম।

শিক্ষাচর্চার সঙ্গে সংস্কৃতিচর্চাও কম ছিল না পাইকরে। যতীন্দ্রমোহনের পৃষ্ঠপোষকতা ও সক্রিয় যোগদানের মাধ্যমে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয় এ গ্রামে নানা সংস্কৃতির চর্চা। নাটক তার একটি। যতীনবাবুদের খামারবাড়িতে চলত চর্চা। ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখলেই দেখা যায়, যে-সব গ্রামের জমিদার, নায়েব বা ধনী ব্যক্তিবর্গ শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, সে গ্রামগুলি হয়ে উঠেছিল শিল্পচর্চার প্রাণকেন্দ্র। সৌভাগ্যের যে আমার গ্রাম পেয়েছিল তেমন এক নায়েবমশায়কে। সেকাল হতেই এ গ্রামের মানুষের বড় আগ্রহ ছিল অভিনয়, গান-বাজনার প্রতি। সবটাই শোনা কথা। দেখা ছবি অনেকটা পরের দিকে। সেকালে নারীর চরিত্রে পুরুষ অভিনেতারায় রূপদান করতেন। যতীনবাবুর খামারবাড়ির নাট্যচর্চায় গ্রামের আরও অনেকের সঙ্গে যোগ দিতেন আমার পিতামহ এবং মাতামহ, সহজকথায় আমার দুই দাদু। আমার মাতামহ নাকি প্রায়ই নারীচরিত্রে রূপদান করতেন।

ছোটবেলায় এ গল্প হাসির উদ্রেক ঘটালেও পরে বুঝেছি একজন অভিনেতার অভিনয় নিষ্ঠা কতখানি থাকলে এ কাজ সম্ভব! যে গ্রামের স্কুলে দিবালোকে ছাত্র পড়াতে হয় সে গ্রামেই মঞ্চে নারীচরিত্রে অভিনয় করা, মুখের কথা নয়। যদিও মঞ্চ তখন ছিল মুষ্টিমেয়র মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেদিনের এক কিশোরের কথা বলব। নাটকের স্বাদ নেওয়ার সুযোগ যেহেতু সকলের হত না। তাই কিছুটা লুকিয়েই দেখতে হত বঞ্চিত আগ্রহীদের। সেই কিশোর এবং তার কয়েক জন সহপাঠী গেটের ফাঁকফোকর দিয়েই নাটক দেখত। তাদের মনে মনে মঞ্চে যাওয়ার স্বপ্ন। এক দিন তাদের সুযোগ এল গেটের ভিতরে প্রবেশের। এ যেন হাতে চাঁদ পাওয়া। আজ বিনোদনের সমারোহে সে যুগের এটুকু পাওয়া যে কী পরম পাওয়া, তা সহজে বোঝা যাবে না। কিছুদিন পরে এল আর এক মহতি ক্ষণ। কোনও এক অজ্ঞাতকারণে নাটকের বার্তাবাহকের চরিত্রে এক কিশোরের প্রয়োজন হয়। সেই কিশোর পেল চরিত্রটি। বিশেষ কোনও সংলাপ ছিল না। গ্রামের বড় বড় গণ্যমান্যদের মাঝে এক মঞ্চে সংলাপহীন ওই সুযোগটুকুই যে কী মহার্ঘ্য ছিল, তা শুনেছি আমি আমার বাবা নোটন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে—সে দিনের সেই কিশোর। যিনি এক সময়ের পাইকরের নাট্যচর্চার মুখ্য ব্যক্তিত্ব। তবে তার আগেও যিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাহায্যে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন পাইকরের সার্বিক সাংস্কৃতিক চর্চাকে, তিনি দুর্গাদাস ঘোষ। আধুনিক নাট্যচর্চা, কর্মশালার মাধ্যমে কলকাতার সমকালীন নাট্যভাবনা গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা, বছরভর নানা সাংস্কৃতিক আনুষ্ঠানের আয়োজন করা, সবই হত তখন তাঁর প্রচেষ্টায়। তাঁদের কিছু জনের আন্তরিক প্রচেষ্টায় জেলা তথা রাজ্যের নাট্যমোদী মানুষের কাছে পাইকরকে পরিচিত এক নাম করে তুলেছিল।

জ্ঞান হওয়া থেকে আমার দেখা পাইকরে বিত্তবান থেকে নিম্নবিত্তের প্রায় সকলকেই দেখেছি শিক্ষার পাশাপাশি গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা— এ সব কিছুকেই অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে। নাটক তো ছিলই। নাচও হত। তবে নিজেদের মতো করে। মাঝে মাঝে বিশেষ অনুষ্ঠানের সময় শান্তিনিকেতনের কোনও শিল্পীকে নিয়ে গিয়েও গ্রামের ছেলেমেয়েদের তৈরি করা হত। এমন গ্রামে বড় হয়েছি, ভাবলে ভাগ্যবান মনে হয়। এক দিকে গ্রামের খোলামেলা পরিবেশ পাশাপাশি আত্মবিকাশের এমন সুযোগ। যে সুযোগ হয়তো পাওয়ার কথা ছিল না অবস্থানগত কারণে, যোগাযোগের অপ্রতুলতা হেতু। তবু এ গ্রামের কিছু আগ্রহী ব্যক্তির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সে-সব সম্ভব হয়েছিল। শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চাও ছিল। ছিল সারা বছর ধরে অন্যান্য সংগীতচর্চাও। আবৃত্তি তখনও বছরভর অনুশীলনের বিষয় হয়ে ওঠেনি। শুধুমাত্র কোনও প্রতিযোগিতা বা মঞ্চানুষ্ঠানের আগে আগে চলত চর্চা।

নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কারণে পুজো, ঈদ বা নবান্নের বাইরেও গ্রামে ছিল সারা বছর জুড়ে উৎসব। মাইকে ঘোষণা করা হত। বাড়ির মেয়ে-বউরাও সব কাজকর্ম সেরে বিকেল থেকেই জায়গা ঘিরে বসে পড়ত। সন্ধে থেকে এক দিকে চলত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, অন্য দিকে ছোট ছোট ঠেলা গাড়িতে আনা চানাচুর বাদামভাজার বিক্রি। তখনও ফুচকা নামক খাদ্যবস্তুটি আমাদের গ্রামে এসে পৌঁছয়নি। আশির দশকের কথা বলছি। মেয়েরাও ততদিনে নাটকে যোগ দিতে শুরু করেছে। বিনোদন তখন ছিল অনেকে মিলে উপভোগের। ’৯০-এর দশক থেকে বদলাতে শুরু করল গ্রামের চিত্র। টেলিভিশনের একাধিক চ্যানেল আর পাঁচটা জায়গার মতো পাইকরের মানুষকেও কিছুটা গৃহবন্দি করে ফেলল। বিনোদন ততদিনে অনেকের থেকে সরে এসে পরিবারের গুটি কয়েক জনের মধ্যে উপভোগের বিষয় হয়ে উঠল। আজকের নিজের মধ্যে অন্তরলীন হয়ে থাকা পরিবেশ দেখলে মনে হয় গ্রামীণ ভাবনা না থাক, তবু তো পারিবারিক ধারণাটুকু ছিল কয়েক বছর আগে।

আজ শুধুই স্মৃতি। ‘চর্চা’ হয়তো কিছু ক্ষেত্রে বেড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে কমেছে। তবে আজ সে স্বতঃস্ফূর্ততা নেই যেন। সব রুটিন। অভিভাবকের ইচ্ছে-পূরণ। ঐতিহ্য ভুলে কেবলই সমকালীন হয়ে ওঠার প্রয়াস। সমকাল মানে তো গ্রাম-শহর নির্বিশেষে সকল ঐতিহ্য ভুলে টিভি, কম্পিউটার, মোবাইলের জগতে গা ভাসিয়ে দেওয়া নয়। তাই অতীত রোমন্থন করে এখন মনে সুখ জাগে। মনে পড়ে ফেলে আসা ছেলেবেলার কথা। পাইকরের কথা। আমার গ্রাম পাইকর।

(লেখক লাভপুর সত্যনারায়ণ শিক্ষানিকেতন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, মতামত নিজস্ব)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education Culture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE