Advertisement
E-Paper

মান-হারা বাংলা ভাষা, বলতে ভারী অস্বস্তি!

সহজ সেই প্রাণের আরাম বাংলা ভাষা টিকে আছে বটে কিন্তু সে ভাষায় বাক্যালাপ করতে কোথায় যেন অস্বস্তি, কোথায় যেন সিঁদ কেটেছে অন্য ভাষার বেয়াদপি। লিখছেন গার্গী চক্রবর্তীবাঙালি আড্ডাপ্রিয় জাতি। চায়ের কাপে তুফান তোলা বাঙালি আবালবৃদ্ধ নির্বিশেষে, বাজার ফেরত রাস্তার ধারে, উঁচু টেবিলের উপর বাল্ব ঝুলিয়ে পাড়ার ক্যারামের আড্ডায়, মোড়ের মাথায় তাসের মাচায়...

শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:৫২

বাঙালি আড্ডাপ্রিয় জাতি। চায়ের কাপে তুফান তোলা বাঙালি আবালবৃদ্ধ নির্বিশেষে, বাজার ফেরত রাস্তার ধারে, উঁচু টেবিলের উপর বাল্ব ঝুলিয়ে পাড়ার ক্যারামের আড্ডায়, মোড়ের মাথায় তাসের মাচায়, ছেলেমেয়ের মাধ্যমিকের সেন্টারের সামনে গাছতলায়, কলেজ থেকে শুরু করে অফিসের ইউনিয়ন রুমে, ক্যান্টিনে, বেপাড়ার বন্ধুর সঙ্গে অচেনা বাড়ির সিঁড়িতে, গ্রীষ্মের পূর্ণিমায় খোলা ছাদে, শীতের অলস দুপুরে এ যাবৎ শুধুই আড্ডা দিয়েছে, বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায়।

বাঙালি এখনও আড্ডা দেয়। তবে আড্ডাসঙ্গী এবং আড্ডা-ভাষাতেও বিরাট পরিবর্তন এসে গিয়েছে। ভাষাটা এখন বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি মেশানো অদ্ভূত এক ককটেল। শুদ্ধ বাংলা বা ইংরেজি শুনতে পাওয়া যায় না বললেই চলে।

ফ্ল্যাটবাড়ির লিফটে বাজার ফেরত দুই পড়শি ট্র্যাকপ্যান্ট আর টি-শার্ট গায়ে বিদঘুটে সঙ্কর ভাষায় আলোচনা করেন কাঁকড়ার দাম কত বেড়েছে। তাঁদের থলে থেকে উঁকি দেয় পুঁইশাক কিংবা মূলো।

এ বাড়ির সুফিয়া আন্টি ও বাড়ির মধুরিমাকে মাইক্রোওভেনে বানানো ভাপা পোস্ত করে পাঠালে মধুরিমা সেই বাসন ফেরত দেয় পাস্তা ভরে। সুফিয়া আন্টির কাছে মধুরিমা টিপস নেয় ‘হাউ টু মেক সরপুঁটির সর্ষে বাটা’।

বিউটি পার্লারে পাশাপাশি সিটে হেয়ার কালার আর ফেসিয়াল করাতে করাতে সহেলি আর অঙ্কনা নিজ নিজ মাদার-ইন-ল’য়ের আননেসেসারি নাক গলানোয় কী ভাবে তাদের হাজব্যান্ড-ওয়াইফের প্রাইভেসি হ্যাম্পার্ড হয় বা ছোট্ট ঋষিত কেমন ঠাম্মার আদরে প্যাম্পার্ড চাইল্ড হয়ে উঠছে সে বিষয়ে আলোচনা করে।

মিঃ দত্তা, মজুমদার সাহেব আর আর গাঙ্গুলিদা একে অপরের হ্যান্ডশেক করে শুভ বিজয়ার উইশ করেন। কালাকাঁদ দিয়ে মিষ্টিমুখ করান। রোমার বার্থডে পার্টিতে লনের এক কোণায় সান্ধ্য পানাসরে তিয়াস আর অর্চন’রা মি-টু নিয়ে চটুল বাক্যলাপ করে।

এই যে মধুরিমা, সহেলি, মি. দত্ত বা অর্চন’রা সবাই আমাদের পরিচিত। রোজ আমরা এদের আয়নায় দেখতে পাই। মধ্যবিত্ত তথা সদ্য বিত্তপ্রাপ্ত ‘এই বুঝি সকলে জেনে গেল আমার বাবা রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টার’ রোগে ভোগা কিম্ভূত জীব বিশেষ। এরা পেন্সিল দিয়ে নিজেদের বর্তমান আঁকে, কিন্তু অতীত মোছার মত ইরেজার খুঁজে পায় না। পেনশন প্ল্যানের অতিরিক্ত ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে এরা সময় নষ্ট করে না।

এই শ্রেণী সন্তানের বাংলা না জানা নিয়ে গর্ব বোধ করে এবং নিজের বাংলা জানাটা দুর্বলতা বোধ করে সন্তর্পণে গোপন রাখে। কিন্তু দাম্পত্য কলহে কিংবা রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দেওয়া নিয়ে বচসায় এরা অশ্রাব্য বাংলাটা বেশ ভালো বলেন, খুব শক্তিশালী সে শব্দচয়ন। বোঝা যায় রীতিমত

চর্চা আছে।

বছর দুয়েক আগে দক্ষিণ কলকাতার এক নামী প্রাইভেট স্কুলে ক্লাস এইটের বাংলা শিক্ষিকা স্বাধীন শব্দের সন্ধিবিচ্ছেদ শিখিয়েছিলেন সু+অধীন। এমনকি ষান্মাসিক পরীক্ষায় এক ছাত্র উক্ত সন্ধিবিচ্ছেদ স্ব+অধীন লেখায় কেটে দেন। সেই ছাত্রের মা স্কুলে কথা বলতে গিয়ে অবাঙালী প্রিন্সিপ্যালের কাছে অপমানিত হন এবং অন্য কোনও অভিভাবক অভিযোগ না করার অজুহাতে সেই শিক্ষিকার শেখানো ভুল ব্যাকরণ সঠিক বলে প্রতিষ্ঠিত হয়। ফেসবুকে ছাত্রের মায়ের লেখা এই অভিজ্ঞতা জেনে বহুল প্রতিবাদ ও ধিক্কারে অবশেষে স্কুল কর্তৃপক্ষ সেই ক্লাসে গিয়ে নিজেদের মান রাখতে বলে আসেন দুটো উত্তরই ঠিক।

সম্প্রতি মফসসলের এক নামজাদা হেরিটেজ কলেজের অধ্যক্ষা অসংখ্য ভুল ইংরিজিতে কলেজের এনসিসি প্রকল্পের সাফল্য বিষয়ে নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাস লিখেছেন। সেই অধ্যক্ষা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ডক্টরেট এবং এককালের নামকরা ছাত্রী। তাঁর সেই অশুদ্ধ ইংরিজিতে লেখা স্ট্যাটাস এখন অনেকেই দেখে ফেলেছেন। অথচ তিনি স্ট্যাটাসটা বাংলায় লিখলে শুদ্ধ লিখতেন এবং মোটেও উপহাস্য হতেন না।

উক্ত অধ্যক্ষা একসময় ভালোবেসে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। এখনও তাঁর গবেষণা গ্রন্থ চোখে পড়ে। এহেন শিক্ষিত মানুষেরও বিশ্বাস যে, লোকসমক্ষে একটু ইংরিজি না বললে না লিখলে মান থাকেনা।

এখন আবার এমন মানুষও দেখা যায়, যাঁরা বাঙালি হয়েও এবং এই বাংলায় থেকেও বাংলার বর্ণটুকুও চেনেন না। অথচ এঁরা হঠাৎ হঠাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে বাঙালি হয়ে উঠতে খুব পছন্দ করেন। পিঠেপুলী, সিঁদুর খেলা, মাথায় গলায় পলাশমালা বা পঁচিশে বৈশাখে মাটির গয়নার ছবি দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ভাসিয়ে দেন।

প্রশ্ন হল কেন নিজের ভাষা নিয়ে বাঙালি এত লজ্জিত এবং দায়সারা। মধ্যবিত্ত অতীত মুছে ফেলার কেনই বা প্রাণপণ অক্ষম প্রয়াস। আর কেনই বা এমন ধারণা যে, কেবল বাংলা ভাষাটা লুপ্ত করতে পারলেই সেই ‘লজ্জাজনক’ অতীত মুছে দেওয়া যাবে। খাদ্যাভ্যাস থেকে নিন্দেমন্দ ঝগড়াঝাটি সবেতেই এরা বাঙালি থাকতে প্রস্তুত শুধু ভাষাটি নিয়েই সমস্যা।

নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গের একটা গোটা প্রজন্ম প্রাথমিক স্তরে ইংরিজি না শিখে ষষ্ঠ শ্রেণীতে প্রথম এবিসিডি শুরু করে। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রকের সেই পরীক্ষামূলক গবেষণায় লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে হয়ে গেল ইংরিজিতে পঙ্গু গিনিপিগ। আজ বিশেষ করে তারাই সেই দীনতা ঢাকার প্রবল প্রচেষ্টায় অকারণে অশুদ্ধ ইংরিজি শব্দবন্ধ প্রয়োগ করে এবং সন্তানদের বাংলাভাষায় অক্ষম বানিয়ে নিজেদের ইংরিজি ভাষার অক্ষমতার দুঃখ ভোলে। কিন্তু উনিশশো অষ্টআশি সাল পর্যন্ত পুরোনো শিক্ষাপদ্ধতিতে পড়া ব্যক্তিরাও অনেকাংশই কেন ইংরিজিতে দুর্বল, সে এক দুরূহ রহস্য।

আশ্চর্যের বিষয়, এক সময় প্রত্যন্ত গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকেরাও বাংলা ইংরিজি সংস্কৃত ভাষায় সমান দক্ষ ছিলেন। ছাত্র গড়তে তাঁরা ছিলেন দিকপাল। বিজ্ঞান বা অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করলেও ভাষাচর্চা তখন ছিল বাধ্যতামূলক। এখন শিক্ষাদানে শুধু নয়, শিক্ষা পদ্ধতিতেও ঘটে গেছে বিরাট বিবর্তন। তৈরী হয়েছে দুটো শ্রেণী-ইংরিজি স্কুলে পড়া বাংলা লিখতে পড়তে না জানা তথাকথিত ‘স্মার্ট’ বাঙালি বাচ্চা এবং বাংলামাধ্যম স্কুলে পড়া কথ্য ইংরিজিতে দুর্বল লজ্জিত বাঙালি বাচ্চা।

তবে কলকাতা এবং সংলগ্ন শহরাঞ্চলের এই বাংলা ভোলার প্রকট ব্যধির প্রভাব মফসসল শহর এবং গ্রামগুলোকে ততটা আক্রান্ত করতে পারেনি। সেখানে সীমিত ভাষাজ্ঞান, স্বল্প শব্দভাণ্ডার এবং সময় বিশেষে ভুল বানান নিয়েও মোবাইল ফোনে বাংলা অ্যাপ ডাউনলোড করে বাংলা হরফে বাংলা লেখার প্রবণতা অনেক বেশি, ইংরিজি হরফে বিচিত্র আকৃতির বাংলা শব্দ তাঁরা কমই লেখেন।

শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে দেখা যায়, নগর শহর সর্বত্রই ইংরিজি মাধ্যমের হাইস্কুলগুলোয় বাংলা ছাড়া সব বিষয়ের শিক্ষকশিক্ষিকা সেই সেই বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর। শুধু বাংলা ভাষা-সাহিত্য-ব্যাকরণ পড়ানোর জন্য শিক্ষকশিক্ষিকা নির্বাচনের সময় বাঙালি পরিবারে জন্মানোই এক মাত্র যোগ্যতা বলে বিবেচিত হয়।

অথচ ইংরিজি মাধ্যম স্কুলেও কিন্তু পাঠ্য বাংলা বই বাংলা আকাদেমি অনুমোদিত সহজ বানানে লেখা। দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা নেওয়া শিক্ষার্থীরা রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-শরৎচন্দ্র থেকে শক্তি-সুনীল হয়ে জয় গোস্বামী অবধি পড়ে। বাংলা গল্প কবিতা প্রবন্ধের বই ছাপা হচ্ছে না তাও তো নয়। বইমেলার প্রাক্কালে সোশ্যাল মিডিয়ায় নতুন নতুন প্রকাশনী এবং নতুন বইয়ের বিজ্ঞাপনের ঘনঘটা।

দেখা যাচ্ছে, বাংলায় শিশু ও কিশোর সাহিত্য এখনও টুনটুনির গল্প, ক্ষীরের পুতুল বা চাঁদের পাহাড়েই থমকে আছে। কিন্তু ধামা, কুলো, ঢেঁকি, গোলা, কুয়ো, নরুন, কলসি, কোদাল, হেঁসো, কুমোর, কামার, ভিস্তি— চেনা বাঙালি বাচ্চা ওইসব সাহিত্যের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারে না। সাহিত্য পদবাচ্য অনূদিত কার্টুন সাহিত্য টিনটিনের পর আর হয়নি। সিরিয়াস অনুবাদ সাহিত্য তো মূল রচনার প্রতি বিরাগ উদ্রেককারী অতি দুর্বল সৃষ্টি বিশেষ।

যে ভাষায় শিশুপাঠ্য সময়োপযোগী উন্নত সাহিত্য রচনা হয়না, তার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ তো বন্ধ্যা হবেই। এই প্রজন্ম না চিনছে শ্রীকান্তকে, না বুঝছে ম্যাকবেথকে। এরা বহুলাংশে ফেসবুক মিমকে ঘিরেই আবর্তিত হয়।

ভীতিজনক এটাই যে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকারাও আজকের ইন্টারনেট দুনিয়ায় নিজেদের বর্তমানের উপযুক্ত করে তুলতে বাংলাকে অবহেলা করে নির্দ্বিধায় ভুল ইংরিজিকে আশ্রয় করেন। সে ক্ষেত্রে প্রার্থনা করতেই হয় এঁদের ‘চৈতন্য হোক’— সবার আত্মোপলব্ধি হোক, সবাই মাইকেলত্বপ্রাপ্ত হোন! হে শিক্ষক-শিক্ষার্থী তথা অভিভাবককুল, ইংরেজি, বাংলা দুটোই সঠিক জানুন। নিজের বাঙালি পরিচয়ে শ্লাঘা বোধ করুন। বাংলা বাঁচুক।

Bengali Language Bengali Language Linguistics
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy