Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Budget 2020

কর্পোরেট জগতে বাজেট একটা ইমেজ ম্যানেজমেন্ট ইভেন্ট

আজ বলব— আমরা জনসংযোগ পেশাদাররা কী করি বাজেটের আগে! জানলে অবাক হবেন যে— আমাদের পেশার ক্যালেন্ডারে এটাই বোধহয় ব্যস্ততম সময়।

ছবি: পিটিআই

ছবি: পিটিআই

দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২০ ১৯:১৭
Share: Save:

‘বাজেট’। ছোট্ট একটা তিন অক্ষরের শব্দ। কিন্তু বিত্তশালী উদ্যোগপতি থেকে সাধারণ মানুষ, এর অভিঘাত ছুঁয়ে যায় সবাইকেই। আমার আপনার মতো সাধারণ মানুষ ব্যাগ্র থাকেন কী সুবিধা মিলল তা নিয়ে। আগে ছিল ভর্তুকি আরও পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন। আর আয়করের ছাড়। দ্বিতীয়টা এখনও আছে, প্রথমটা বদলে গিয়েছে। এখন আমরা জানতে চাই কী কী সুবিধা হারালাম।

কিন্তু আজকে আমার লেখার বিষয় বাজেট নিয়ে নয়। আজ বলব— আমরা জনসংযোগ পেশাদাররা কী করি বাজেটের আগে! জানলে অবাক হবেন যে— আমাদের পেশার ক্যালেন্ডারে এটাই বোধহয় ব্যস্ততম সময়।

যদি বলেন, ‘কী?’ আমি বলব, বাজেটের সময় আমি গোলের খোঁজে ব্যস্ত, ফুটবলের সুযোগ সন্ধানী সেন্টার ফরোয়ার্ড বা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের মারকুটে ব্যাটসম্যান। প্রতি বলে চার, ছয় মারার স্বপ্ন, অবশ্যই আমার ক্লায়েন্টকে বাড়তি সুবিধা আদায় করে দেওয়ার জন্য।

বাজেটের কিছু সময় আগে থেকেই দেশের ছোট, বড় কর্পোরেট সংস্থা ও বিত্তশালী উদ্যোগপতিরা আমার মতো ‘জনসংযোগ’ বা ‘ইমেজ কনসালট্যান্ট’দের নিয়োগ করেন, বাজেটের সময়ে তাঁদেরকে ‘ইমেজ ম্যানেজমেন্ট’-এর পরামর্শ দেওয়ার জন্য। আজ্ঞে হ্যাঁ, কারণ কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের কাছে বাজেট একটি ইমেজ ম্যানেজমেন্ট ইভেন্ট। খুব জরুরি ইভেন্ট।

যখন আনুষ্ঠানিক ‘হালুয়া’ খেয়ে, বাজেটের এক সপ্তাহ আগে, নর্থ ব্লকের আমলারা বাজেটের কাগজপত্র ছাপানোর কাজ শুরু করেন, ঠিক একই সময়ে, আমি ও আমার সহকর্মীরা, মানে অন্য সব জনসংযোগ বিশেষজ্ঞরা আদা-জল খেয়ে ক্লায়েন্টের ইমেজ-চর্চায় নেমে পড়ি।

ঠিক এই সময়ে আমি আমার যাবতীয় ক্লায়েন্টদের বলে থাকি যে— বাজেটের আগে ও পরের সাত দিন সংস্থার অন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান বা ঘোষণা না রাখার জন্য। কারণ এই সপ্তাহ দুয়েক যাবতীয় সংবাদমাধ্যম বাজেটের চর্চায় ব্যস্ত এবং অন্য কোনও সংবাদ, একেবারে মারকাটারি না হলে বিশেষ পাত্তা পায় না।

এর পরের ধাপ হল পিচিং— মানে সংবাদমাধ্যম যাতে আমার ক্লায়েন্টের কাজ সংক্রান্ত বক্তব্য তাদের সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিয়ো ও অনলাইনের মাধ্যমে প্রকাশ করে— এর জন্য তদ্বির। মিডিয়াতে সময়, সুযোগ ও স্থান খুবই কম বা সীমিত, অথচ বক্তব্য রাখায় আগ্রহী সবাই।

অতএব আমার ক্লায়েন্টের বক্তব্য কেন সময় উপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ তা পিচিংয়ের মাধ্যমে মিডিয়াকে বোঝাতে হয়।

তার পরের উপদেশ— বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করার। ফিকি, সিআইআই, অ্যাসোচেম ইত্যাদি। এই সব ফোরামের সঙ্গে যুক্ত থাকলে মিডিয়া কভারেজ পাওয়া যায়। তাই ক্লায়েন্টদের কাছে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, টিভি থেকে সংবাদপত্রে তাঁদের নাম ও ছবি ছাপা হয়ে পরিচিতির পরিধি বিস্তৃত হতে থাকে। ব্র্যান্ড তৈরি হয়।

তাঁরা যখন হাততালি কুড়োতে ব্যস্ত, তখন কিন্তু আমাদের চাপ তুঙ্গে। সব সময় সতর্ক থাকতে হয়, যাতে ক্লায়েন্ট কিছু বেফাঁস কথা না বলেন বা বেমক্কা মন্তব্য— রাহুল বাজাজ গোছের। কারণ সবাই তো রাহুল বাজাজ নন। বিতর্কিত মন্তব্য করে সেটা সামলে নিতে সবাই পারেন না। আমার ক্লায়েন্ট কিছু বেমক্কা বলে ফেললে আমায় তা ‘ম্যানেজ’ করতে হয়। বাজেটের সময় শুধুই পলিসি বিরোধী কথা বলে পলিসি মেকিং খুব একটা পরিবর্তন হয় না। এর জন্য আছে অন্য প্রক্রিয়া। অন্য সময়।

দেখতে দেখতে বাজেটের দিন চলে আসে। বাজেট পেশ হয় সকাল ১১টা থেকে। চলে ১টা অবধি। কিন্তু সংবাদমাধ্যম তো সকাল থেকেই তৎপর এবং এই তৎপরতা চলে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা অবধি। লেগে থাকে বাজেট বিশ্লেষণ। এই ৪৮ ঘণ্টা আমার ক্লায়েন্টের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি।

সকালে টিভিতে বাজেট থেকে তিনি কী চান, বাজেট চলাকালীন তার উপরে কিছু টুকটাক মন্তব্যও বাজেট শেষ হলে পরে এই বাজেট কতটা ‘ডেভলপমেন্টাল’ পরিসংখ্যান ও মন্তব্যের মাধ্যমে ক্লায়েন্ট তা প্রকাশ করেন এবং চলচ্চিত্রের মহানায়কদের মত টিভিতে ফুটেজ খেতে থাকেন। বলা বাহুল্য যে— এর জন্যও আমরা ট্রেনিং দিয়ে থাকি। এই সব ‘সাউন্ড বাইট’ ঘুরতে থাকে টিভি চ্যানেলগুলিতে।

ইতিমধ্যে আমার টিম ও ক্লায়েন্ট সংস্থার বড় অফিসাররা বাজেট বিশ্লেষণ করে চটজলদি ৫০-১৫০ শব্দের একটি ছোট এবং ৩০০-৪০০ শব্দের একটা বড় মন্তব্য, ক্লায়েন্টের ছবি-সহ সমস্ত সংবাদ মাধ্যমে, খবরের কাগজগুলিতে, পাঠাতে শুরু করে। পরের দিন সকালে প্রকাশ হয় এই মন্তব্যগুলি। আমার কাজ প্রায় শেষ।

শুধু পরের দিন সকালে সব কাগজের কাটিং এবং টিভি বাইটের একটা সংকলন করে, একটা অ্যানালিসিস-সহ পাঠিয়ে দেওয়া হয় ক্লায়েন্ট অফিসে।

আর এর পর শুরু হয় পর্যালোচনা পর্ব। কোথায় কী ভুল হল। কোন সংবাদ মাধ্যম ক্লায়েন্টের নাম ছাপল। না ছাপলে কেন ছাপল না। সে এক অন্য গল্প।

(লেখক জনসংযোগ কর্তা)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE