Advertisement
E-Paper

জনশ্রুতি ও সমন্বয়ের প্রতীক জঙ্গলমহলের পিরথান

অবিভক্ত মেদিনীপুরে রয়েছে বহু পিরের থান। সেখানে সব ধর্মের ভক্তদের আগমন ঘটে। ঝাড়গ্রামের বেলিয়াবাড়ায় রয়েছে এক পিরের থান। লিখলেন লক্ষীন্দর পালোইঅবিভক্ত মেদিনীপুরে রয়েছে বহু পিরের থান। সেখানে সব ধর্মের ভক্তদের আগমন ঘটে। ঝাড়গ্রামের বেলিয়াবাড়ায় রয়েছে এক পিরের থান। লিখলেন লক্ষীন্দর পালোই

শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৩৩
জাহানপুরে পিরের মাজার। নিজস্ব চিত্র

জাহানপুরে পিরের মাজার। নিজস্ব চিত্র

অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন এলাকার পিরের থানগুলো সর্বধর্ম সমন্বয়ের অন্যতম নিদর্শন। ঝাড়গ্রামের বেলিয়াবাড়া এলাকার জাহানপুরে রয়েছে এই রকমই এক পির থান। সৈয়দ কাশিম শাহ রহমতউল্লা আলেইহের ‘মাজার শরিফ’। যা জঙ্গলমহলে পির থান নামে পরিচিত। তাঁর থানে মঙ্গল কামনায় পুজো চড়ান হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ। ইতিহাস, লোককাহিনি এবং সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের সাক্ষ্য বহন করছে জঙ্গলমহলের এই পির থান।

কী ভাবে জাহানপুরে গড়ে উঠল পির থান? সেই কাহিনি শোনা যায় পির থানের বর্তমান খাদেম মনসুর আলিশা কুদ্দুসির কথায়। মনসুরেরা ১১ প্রজন্ম ধরে পির বাবার খাদেম। মনসুর সাহেব জানালেন, সৈয়দ কাশিম ছিলেন বাগদাদের আব্বাস খলিফার সেনাপতি ও সুফি দরবেশ। তিনি সুবর্ণরেখা নদী বরাবর ভঞ্জভূমে পৌঁছন। জানতে পারেন দাহির রাজার দুই লড়াকু কন্যার বীরত্বের কথা। তাঁরা সুন্দরী এবং যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী। কাশিম তাঁদের যুদ্ধে আহ্বান করেন। এরপর দুই কন্যাকে তিনি বন্দি করে বাগদাদে বিচারের জন্য পাঠান। কিন্তু বাগদাদে গিয়ে বন্দি দুই কন্যা খলিফাকে জানান, তাঁর সেনাপতি কাশিম তাঁদের সম্মান নষ্ট করেছেন। খলিফা কাশিমকে বন্দি করে বাগদাদে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বন্দি কাশিম সুবর্ণরেখা নদীর তীরে জাহানপুর গ্রামে মারা যান।

পরে তিনি ঘটনার সত্যতা জানতে পেরে অনুতপ্ত হন। কাশিম পান পিরের মর্যাদা। সেই থেকে তাঁর মাজার পিরথান নামে পরিচিত। ভক্তদের বিশ্বাস, তিনি ছিলেন অলৌকিক শক্তির অধিকারী। তিনি জাহানপুর পরগনার বাসিন্দাদের রক্ষা করেন। ধর্মমত নির্বিশেষে মনোবাসনা পূর্ণ করেন। তাই মাজারের থানে গিয়ে মানত করলে, তিনি তা পূর্ণ করেন।

জঙ্গলমহলের পিরের আগমনের ইতিহাস রয়েছে। ১৪৯৪ সালে হোসেন শাহের আমলেই চৈতন্যদেবের জাতি বর্ণ ও ভিন্নধর্মাবলম্বীদের প্রতি সম মনোভাবের প্রকাশ। তবে চৈতন্যদেবের ভাবশিষ্য ওড়িশার রাজা প্রতাপ রুদ্রদেবের প্রবল প্রতাপ ছিল। তাঁর কারণেই হোসেন শাহ ওড়িশা আক্রমণ করতে সাহস করেননি। যদিও গৌড়ের শাসক সুলেমান করনানির সেনাপতি ‘কালাপাহাড়’ ওড়িশা আক্রমণ করে ছিলেন। ওড়িশায় ১৫৬৭ সালের পর থেকে মুসলিম শাসন শুরু হয়। কুতলু খাঁ পুরীর শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। ১৫৯২ সালে বাংলা ও ওড়িশা মুঘলদের অধিকারে আসে। ১৬৫৭ সালে শাহজাহানের দুর্বলতার সুযোগে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ভঞ্জ মেদিনীপুর-সহ ওড়িশার ভদ্রক পর্যন্ত জয় করেন। ঔরঙ্গজেবের সময় খান-ই-দুরান সুবর্ণরেখা নদীর তীরে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ভঞ্জের সঙ্গে দেখা করার নাম করে ওড়িশা আক্রমণ করেন। কৃষ্ণচন্দ্র ভঞ্জের পুত্র ত্রিবিক্রম ও কৃষ্ণচন্দ্র ভঞ্জের ভাই জয় ভঞ্জ মুঘলদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেন। ১৭৪০ সালে এই অঞ্চল আলিবর্দির শাসনে আসে। তখন থেকেই মধ্য সুবর্ণরেখা অববাহিকা অঞ্চল মরাঠা আক্রমণের কবলে পড়ে।

১৮০৩ সাল পর্যন্ত বর্গিরা এই অঞ্চলে বার বার আক্রমণ করে। তবে চৈতন্যদেবের জাতি, বর্ণ ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সমভাবের ভাবনায় ভাবিত তাঁর ভাবশিষ্য শ্যামানন্দ চেয়েছিলেন বিভিন্ন জাতির সমন্ময়ে গড়ে উঠুক বৈষ্ণবতীর্থ শ্রীপাঠ গোপীবল্লভপুর। ‘শ্রীচৈতন্যচন্দ্র মহাপ্রভুর নিদান/পুণ্য নবদ্বীপ বন্দো আর তাম্রলিপ্ত’। নবদ্বীপ থেকে তাম্রলিপ্ত পর্যন্ত বৈষ্ণব ধর্মের প্লাবন বয়ে যাক। ভক্তি ও সুফি ভাবের সমন্বয়ী ভাবনায় উভয় সম্প্রদায় প্রভাবিত হোক। যে সমন্বয়ী ভাবনায় প্রহরাজ এস্টেটের জাহানপুর পরগনায় গড়ে ওঠে সৈয়দ কাশিম শা রহমতউল্লা আলেইহের ‘মাজার শরিফ’।

ধীরে ধীরে লোকমুখে প্রচারিত হতে থাকে পির থানের মহিমা। লোক কাহিনিতে আছে, তখন সুবর্ণরেখা নদীতে জাহাজ চলাচল করত। বণিকেরা এই পিরথানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মানত করতেন। মানত পূরণ হলে তাঁরা বিভিন্ন জিনিস দান করতেন। কোনও এক বণিকই পিরথানের তিনটি গম্বুজ ও দু’টি মিনার নির্মাণ করেন। জালাল শাহ বাবা মস্তান নামে এক সুফি সাধক একটি পুকুর খনন করেন। যার নাম অনুসারে পুকুরটি ‘মস্তানপুকুর’ নামে পরিচিত। জালাল শাহের সময়ে বেলিয়াবাড়ার প্রহরাজ বৈষ্ণব অনুরাগী কৃষ্ণচন্দ্র প্রহরাজ পিরথানের নামে ১১ বিঘা জমি জাহানপুর মৌজায় পিরের খাদেমকে দান করেন। কৃষ্ণচন্দ্র প্রহরাজ ছিলেন প্রগতিশীল। আর্থ-সামাজিক নানা বিষয়ে তাঁর চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি সর্বধর্ম সমন্বয় চেয়েছিলেন।

পিরেরা বঙ্গদেশে এলেন কী ভাবে? অনেকে সুফি দরবেশদের হাত ধরে পির সংস্কৃতি বঙ্গে আসে বলে মনে করেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘হিস্ট্রি অফ মেডিয়াভ্যাল’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘মেচ জনজাতির হাত ধরে বকতিয়ার খিলজি বঙ্গদেশে পাড়ি দেন এবং আলি মেচ ছিলেন প্রথম ধর্মান্তরিত মুসলিম’। সুশীলা মণ্ডল তাঁর ‘বঙ্গদেশের ইতিহাসে’ লিখেছেন, মুসলমান বঙ্গ বিজয়ের সঙ্গে উত্তর ভারত থেকে ফকিরদের বাংলাদেশে আসার কথা বলেছেন। ১২০০ থেকে ১৭৫৭ পর্যন্ত বঙ্গদেশ মুসলিম শাসনে থাকায় শাসক শ্রেণির সংস্কৃতি হিন্দু সংস্কৃতির উপর প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া পির ও দরবেশদের গানগুলিও হিন্দু সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছিল। আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর ‘বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাসে’ দেখিয়েছেন, মুসলিম আখ্যায়িকা ও গীতিকাব্যের প্রচলন এবং বিভিন্ন পাঁচালিগুলোকে কেন্দ্র করে মুসলিম ধর্মবিষয়ক কাহিনি লৌকিক প্রণয়াখ্যান বাংলাদেশের জাতি-জনজাতির উপর প্রভাব বিস্তার করে। দীনেশচন্দ্র সেনের মতে, হুসেন শাহ হিন্দুর সত্য ও মুসলিমদের পির শব্দ নিয়ে একটি সমন্বিত ধর্ম প্রচার করেন। অন্যদিকে সনাতনী রক্ষণশীল হিন্দু সমাজে বর্ণাশ্রম প্রথা সাধারণ মানুষের উপর প্রভাব ফেলেছিল। তাই ব্রাত্য, পতিত সমাজ কখনও বৌদ্ধরা এই উদারপন্থী সাধকদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন।

মুসলমান ধর্মপ্রচারকেরা পর্যটক রূপে এসে অনেক সময় দরবেশ, পির ও ফকির নামে পরিচিতি লাভ করেছেন। পিরের আস্তানাগুলি হল গাছের তলা, নদী ও পুকুরপাড়, গ্রামদেবদেবীর থান। বাংলাদেশে প্রচুর পিরের নাম আমরা পাই। মানিকপির, তাজ-বাজপির, নিরগিন শাহপীর, কুরমান সাহেব, বুড়া পির, তাজ খাঁ পির, পির লোহনি, হজরত সৈয়দ শাহ মোরশেদ আলি আল কাদেরি মেদিনীপুরে বিখ্যাত। পিরকে কেন্দ্র করে কাব্য, সাহিত্য, নাটক, পীর লোককথা, প্রবাদ, লোকোগান প্রভৃতি ও রচিত হয়েছে।

জঙ্গলমহলের পিরের থানে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের ভক্তরা পুজো দেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের ভক্তরা শুক্রবার বা অন্যদিন পুজো দেন। হিন্দুরা প্রতি বৃহস্পতিবার ও রবিবার পিরথানে পুজো দেন। পুজোর উপাচার ২৫টি পান, ২৫টি হলুদ, ২৫টি সুপারি, ২৫টি কলা, ৫ পোয়া গুড়, ৫ পোয়া আটা, ৫ পোয়া দু্‌ধ ও পঞ্চ অমৃত, মিষ্টি, পায়েস, চাদর, আতর, গোলাপ জল। সন্তান কামনা, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, ভাল ফল লাভ, মামলা মকদ্দমায় জয়লাভের প্রত্যাশায় পিরথানে আসেন। থানে হাতি ঘোড়া দান করেন ও মাজারে চাদর চড়ান। তবে পিরথানে নিজে সিন্নি বানিয়ে ফুল দিয়ে পিরের উদ্দেশে প্রার্থনা করতে হয়। খাদেম পুজোর উপকরণে হাত দেন না। তিনি মাজারের পাশে দাঁড়িয়ে ভক্তের হয়ে পিরের কাছে তাঁর মনস্কামনা জানান।

অধ্যাপক ও লোকসংস্কৃতির গবেষক

Pirthan Jangal Mahal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy