এখন যে কোনও আলোচনাতে উঠে আসে পরিবেশের অবনয়নের কথা। গ্রাম বা শহর, যা-ই হোক না কেন, ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ হয় অপরিকল্পিত নগরায়ণ, সে গ্রামে ধানজমি নষ্ট করে ইটভাটাই হোক বা জলাজমি বুজিয়ে আকাশচুম্বী বাড়িই হোক।
পরিকল্পনার কথায় যাওয়ার আগে একটু বোঝা যাক, গ্রাম আর শহরের ফারাকটা ঠিক কোথায়? শহর মানেই সেখানে জনঘনত্ব বেশি— ভারতের নগরায়ণের সংজ্ঞা বলে, প্রতি বর্গ কিলোমিটারে অন্তত ৪০০ লোকের বাস হতে হবে। দ্বিতীয় তফাত হল জীবিকা সংক্রান্ত— শহরের বেশির ভাগ মানুষের জীবিকা অ-কৃষিভিত্তিক— এ দেশে পুরুষ কর্মীদের অন্তত ৭৫ শতাংশকে কৃষির বাইরের জীবিকাতে থাকতে হবে। এবং তৃতীয়টি হল পরিকাঠামো— শহরে নাগরিক সুবিধা ও স্বাচ্ছন্দ্য প্রদানের জন্য কিছু পরিকাঠামো থাকা আবশ্যিক, যেমন পরিস্রুত জল সরবরাহ, বর্জিত জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা, কঠিন বর্জ্যের অপসারণ ইত্যাদি। আরও একটা বড় পার্থক্য হয় প্রতিবেশে— নগরায়ণ মানেই প্রকৃতি থেকে সরে আসা, মানুষের তৈরি প্রতিবেশে বসবাস, সেটা শুধু পাকা বাড়ি বা কলের জল নয়, মাটি ঢেকে পিচের রাস্তা বা কংক্রিটের আস্তরণও মানুষকে প্রকৃতি থেকে দূরে নিয়ে যায়। আর দৈনন্দিন জীবনযাপনে প্রকৃতির ভূমিকা যত কমে, ততই মানুষ বিস্মৃত হন প্রকৃতি থেকে তাঁর প্রাপ্তির কথা। তাই নেহাত সাপের লেজে পা না পড়লে মানুষ পরিবেশ দূষণ বা অবনয়ন নিয়ে মোটেই মাথা ঘামান না। তাঁর বাসস্থান দরকার, তিনি ‘হোম লোন’ নিয়ে ফ্ল্যাট খুঁজবেন, সে ফ্ল্যাট শক্ত মাটির উপরে না জলাজমি বুজিয়ে, তাতে তাঁর ভারী বয়ে গেল, পরিবেশের ভালমন্দ দেখার দায় তিনি নেন না, নেওয়ার কথা সচরাচর ভাবেনও না।
এই দেখার কাজটা কিন্তু প্রতিষ্ঠানের। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের ভারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের। দুর্ভাগ্যবশত, স্বাধীন ভারতে এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে একেবারেই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। হ্যাঁ, আপনি শহরে বাড়ি করতে গেলে আপনাকে বাড়ির প্ল্যানের একটা অনুমোদন নিতে হয় বটে, কিন্তু ওই বাঁধা গতে ওইটুকুই, জমির চরিত্র দেখা এদের দায়িত্ব নয়। ১৯৯২ সাল অবধি এদের কোনও সাংবিধানিক স্বীকৃতিও ছিল না। মোটামুটি ষাটের দশক থেকে পরিকল্পনা ও উন্নয়নের দায়িত্ব চলে যায় উন্নয়ন সংস্থাগুলির হাতে। ১৯৯২ সালে ৭৩ ও ৭৪তম সংবিধান সংশোধন এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে স্বীকৃতি দেয়। এই সংশোধনীর তিনটি ভাগ ছিল। পুরসভা বা পঞ্চায়েতের নিয়মিত নির্বাচন ও জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে পরিচালন তার একটি। সারা ভারতেই সব রাজনৈতিক দল তৃণমূল স্তরে ক্ষমতা দখলের জন্য এটিকে মেনে নিয়েছে। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর রক্ত-ঝরা এক একটি নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গবাসীকে স্মরণ করায়, ১৯৭৮ সাল থেকে তারাই এই ব্যবস্থার পথিকৃৎ। সংশোধনীর দ্বিতীয় ভাগটি ছিল আর্থিক। প্রতিটি রাজ্যকে একটি অর্থ কমিশন গঠন করতে হবে, যারা গাণিতিক হিসেব করে জানিয়ে দেবে আগামী পাঁচ বছরে কোন পঞ্চায়েত বা পুরসভা কী খাতে কত টাকা পাবে। এটাও হয়েছে— ছোট থেকে বড় সব রাজ্যই এই পঁচিশ বছরে তিন-চারটি অর্থ কমিশন গঠন করেছে। তবে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলির হাতে কত টাকা গিয়েছে বলা শক্ত, বিপত্তি তো একটা নয়, কোনও সময়ে হয়তো রাজ্যেরই ভাঁড়ে মা ভবানী, কোনও সময়ে আবার রাজনৈতিক মতবিরোধ— রাজ্যে এক দলের সরকার, পঞ্চায়েত বা পুরসভাতে ক্ষমতায় এসেছে অন্য দল।
কিন্তু এই সিকি শতাব্দীতে সবচেয়ে অবহেলিত হয়েছে সংশোধনীর তৃতীয় ভাগটি, যেখানে ছিল পরিকল্পনার কথা। সংবিধানের দ্বাদশ তফসিলে শহর এবং গ্রামে সরকারের কাজের যে তালিকা আছে, তার আঠারোটি বিষয়ের প্রথমটি হল পরিকল্পনা। আর এই পরিকল্পনার দায়িত্ব ছিল জেলা পরিকল্পনা সমিতি এবং মহানগর পরিকল্পনা কমিটির ওপরে, যেখানে কিনা সংশ্লিষ্ট সব স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি থাকবে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ভারতের দশ শতাংশ অঞ্চলেও এই কমিটি গঠন হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে বাম আমলে সব ক’টি কমিটি তৈরি হয়েছিল, কিন্তু তারা উল্লেখযোগ্য কোনও কাজ করেছিল বলে জানা নেই। তাই জওহরলাল নেহরুর নামাঙ্কিত মিশনটির সময়ে দেখা গেল, আবার সেই নগর উন্নয়ন সংস্থাগুলিই ছড়ি ঘোরাচ্ছে, সে পরিকল্পনা বা আর্থিক দায়িত্ব, যে বিষয়েই হোক, আর তার সঙ্গে যোগ হল ‘কনসালট্যান্ট’ নামের আর এক প্রজাতির। হারিয়ে গেল স্থানীয় সংস্থা, হারিয়ে গেল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে যাওয়া সাধারণ মানুষের চাহিদার কথা।
(চলবে)
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষিকা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy