রাজনীতি জীবনেরই অঙ্গ। সুতরাং জীবনের মতোই রাজনীতিতেও প্রত্যাবর্তন ঘটে না, পুনরাবর্তন ঘটিতে পারে। ইংরাজি ভাষার আঁচল ধরিয়া বলা চলে: রিটার্ন নহে, রি-টার্ন। ইউপিএ-৩ নামক ধারণাটিও সেই গোত্রেরই। ইউপিএ-র প্রথম দুই সংস্করণের গঠনে ও কার্যকলাপে যে পার্থক্য ছিল, তাহার কথা বহুচর্চিত। ইউপিএ-৩ আপাতত ধারণামাত্র। সেই ধারণা বাস্তব হইয়া উঠিবে কি না, সেই বিষয়ে এখনই ভবিষ্যদ্বাণী করা বাতুলতার নামান্তর। কিন্তু একটি অনুমান অযৌক্তিক হইবে না। যদি তৃতীয় ইউপিএ বাস্তব রূপ ধারণ করে, তবে তাহা পূর্ববর্তী দুই সংস্করণ হইতে স্বতন্ত্র হইবে, আবার সেই স্বাতন্ত্র্যেই নিহিত থাকিবে তাহার ধারাবাহিকতা। এবং এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়া সৃষ্টি হইতে পারে এক সম্ভাবনার। প্রত্যাবর্তন নহে, পুনরাবর্তন— কথাটির এক নূতন অর্থ উন্মোচনের সম্ভাবনা। ভারতীয় রাজনীতি তথা গণতন্ত্রের চলমান বিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সেই সম্ভাবনার গুরুত্ব বিস্তর।
ধারাবাহিকতার অনুঘটক, স্পষ্টতই কংগ্রেস। কংগ্রেসকে কেন্দ্র করিয়াই প্রথম দুই ইউপিএ গড়িয়া উঠিয়াছিল এবং কাজ করিয়াছিল। আগামী লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতিপর্বেও কংগ্রেসকে সঙ্গে রাখিয়াই তৃতীয় ইউপিএ-র ভাবনা দানা বাঁধিতেছে। অঙ্কের বিচারে এ যাত্রায় কংগ্রেসের নিজস্ব গুরুত্ব অতীতের তুলনায় অনেক কম। লোকসভায় দলের আসনসংখ্যা যৎসামান্য, শাসনাধীন রাজ্যের সংখ্যা অকিঞ্চিৎকর— শাসক এনডিএ তথা বিজেপির প্রতিস্পর্ধী জোটের কেন্দ্রে থাকিবার অধিকার আপাতদৃষ্টিতে কংগ্রেসের হাতছাড়া হইয়াছে। কিন্তু আপাতদৃষ্টি প্রায়শই ভ্রান্তির জনক। রাজনীতি নামক সম্ভাব্যতার শিল্পে সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ হইলেও, সর্বশক্তিমান নহে। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে সংখ্যার জোর কম হইলেও একটি দল জোট চালনায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা লইতে পারে, যদি দেশ জুড়িয়া তাহার স্বাভাবিক উপস্থিতি থাকে এবং বিভিন্ন শরিকের নিকট তাহার গ্রহণযোগ্যতা থাকে। অভূতপূর্ব শক্তিক্ষয়ের পরেও কংগ্রেস যে এখনও দেশ জুড়িয়া উপস্থিত, সেই সত্য বোধ করি অমিত শাহও অস্বীকার করিবেন না। কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা? বিজেপি-বিরোধী দলগুলির নিকট শরিক হিসাবে কংগ্রেস কতটা গ্রহণযোগ্য হইবে?
উত্তর ক্রমশ প্রকাশ্য। ভারতে নির্বাচনী জোট বা বোঝাপড়ার প্রক্রিয়াটি, মহাভারতের উদ্যোগপর্বের মতোই, সতত সঞ্চরমাণ। আগামী নির্বাচনের উদ্যোগপর্ব শুরু হইয়াছে। তাহার সূচনায় তৎপরতা ও নমনীয়তার এক বিরল নিদর্শন দেখাইয়া কংগ্রেস সভাপতি যে ভাবে কর্নাটকের নির্বাচন-উত্তর কঠিন লড়াই জিতিয়াছেন এবং যে মসৃণতায় সেই রাজ্যে সরকার গঠিত হইয়াছে, তাহা দেখিয়া বিজেপির মহারথীরা নিশ্চয়ই স্তম্ভিত। ইতিমধ্যেই পরবর্তী পর্বের উদ্যোগ শুরু হইয়াছে— মধ্যপ্রদেশে আসন ভাগাভাগির সূত্র সন্ধানে মায়াবতীর সহিত বোঝাপড়ার উদ্যোগ। মায়াবতী কী করিবেন, দেবা ন জানন্তি। কিন্তু প্রাথমিক আভাস: রাহুল গাঁধী মধ্যপ্রদেশেও লোকসভা ভোটে ঐক্যের স্বার্থে বিধানসভায় বাড়তি কিছু ছাড়িতে প্রস্তুত। অর্থাৎ, তিনি বিজেপি-বিরোধী সংহতির প্রশ্নটিকে দেখিতেছেন একটি সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতে। এবং, দেখিতেছেন কংগ্রেসের নিজস্ব শক্তিক্ষয়ের বাস্তবকে স্বীকার করিয়াই। এই বিচক্ষণতা যদি বজায় থাকে, স্বভাবতই বিভিন্ন দলের নিকট কংগ্রেসের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িবে। অতীতে জোটের শরিক হিসাবে কংগ্রেসের আচরণ অনেক সময়েই ইতিবাচক ছিল না, ফলে বিভিন্ন দলের মনে তাহার প্রতি আস্থার অভাব ছিল, হয়তো এখনও আছে। রাহুল গাঁধীর কাজটি কঠিন। এই কঠিন কাজটি তিনি সুষ্ঠু ভাবে শুরু করিয়াছেন, সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করিতে পারিলে ইউপিএ-৩ ধারণা হইতে বাস্তবে উত্তীর্ণ হইতে পারে। বাকি ইতিহাস ভবিষ্যতের গর্ভে।