Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

লিন্ডা ব্রাউন চলে গেলেন

ব্রাউন পরিবারের বাস ছিল আমেরিকার কানসাস-এর টোপেকা অঞ্চলে। লিন্ডা ছিলেন লেওলা আর অলিভার ব্রাউনের তিন কন্যার অন্যতম।

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৮ ০৬:১০
Share: Save:

ছোট্ট মেয়েটা দুই বোনের সঙ্গে প্রাথমিক স্কুলে পড়তে যেত। যাওয়ার পথ সহজ নয়। লাইন ধরে হাঁটতে হত অনেকখানি। তার পর বাস। অথচ বাড়ির কাছেই স্কুল আছে। সেখানে পড়া হবে না। কারণ সে কৃষ্ণাঙ্গী। সাদাদের শিক্ষাব্যবস্থায় তার স্থান নেই। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাবার হাত ধরে শুরু হয়েছিল মেয়েটার লড়াই। সেই লড়াই শেষ হল গত ২৫ মার্চ। ছিয়াত্তর বছর বয়সে যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়লেন লিন্ডা ব্রাউন। তবে বিজয়ী হয়ে।

ব্রাউন পরিবারের বাস ছিল আমেরিকার কানসাস-এর টোপেকা অঞ্চলে। লিন্ডা ছিলেন লেওলা আর অলিভার ব্রাউনের তিন কন্যার অন্যতম। মেয়েদের এই কষ্টকর স্কুলযাত্রা বাবা অলিভারের পছন্দ ছিল না একেবারেই। ইতিমধ্যে প্রতিবাদের সুযোগ এসে গেল। ১৯৫০ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য গঠিত ফোরাম ‘ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অব কালার্ড পিপল’-এর সদস্যদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হল। তাঁদের পরামর্শ মতো অলিভার গেলেন সাদাদের স্কুলে লিন্ডাকে ভর্তি করতে। কর্তৃপক্ষ যথারীতি ফিরিয়ে দিলেন। ব্যর্থমনোরথ এমন তেরো জন অভিভাবক একত্র হয়ে ফোরামের সহযোগী হিসাবে কোর্টে গেলেন। এঁদের মধ্যে কাজে এবং নামে ‘ব্রাউন’ সবচেয়ে আগে (‘বি’ দিয়ে শুরু)। মামলা গড়াল সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। সমগ্র আমেরিকা জানল ‘ব্রাউন ভার্সাস বোর্ড অব এডুকেশন’ মামলার কথা।

কালো চামড়া, বাদামি চামড়ার মানুষ সাদা মানুষের দেশে কোনও দিন সুখী ছিলেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও নয়। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের সামাজিক স্বাধীনতার কথা যতই বলা হোক, তাঁদের জীবনে যন্ত্রণাদায়ক নিয়মকানুনের অভাব ছিল না। ১৮৯৬ সালে তাঁদের শিক্ষাব্যবস্থায় ‘আলাদা কিন্তু একরকম’ শীর্ষক এক বিধি প্রযুক্ত হয়েছিল। এর ফলে রাষ্ট্রই পাবলিক স্কুলগুলির মধ্যে সাদা এবং কালোদের জন্য আলাদা ব্যবস্থায় উদ্যোগী হয়েছিল। যতই ‘সেপারেট বাট ইকোয়াল’ বলা হোক, কৃষ্ণাঙ্গদের পৃথক করে দিয়ে কখনও তাঁদের শিক্ষার অধিকারে সমতা আনা যেত না। অলিভার আর তাঁর ছোট্ট মেয়ে লিন্ডা এই অন্যায় ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই সেদিন দীর্ঘ লড়াই করেছিলেন। শেষে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, শিক্ষাব্যবস্থায় এই ‘পৃথগীকরণ’ কৃষ্ণাঙ্গ শিশুর সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, “পৃথক করে দিয়ে পড়ার সুযোগ দেওয়ার পরিকল্পনার মধ্যে মজ্জাগত ভাবেই বিভেদের বিষ রয়ে গেছে।... কাজেই গণশিক্ষার ক্ষেত্রে ‘পৃথক কিন্তু একরকম’ ব্যবস্থার কোনও জায়গা নেই।”

লিন্ডা নিজের শিক্ষার ক্ষেত্রে সমতা ও সম্মান প্রতিষ্ঠার কাজে নিজেই শরিক হয়েছিলেন। বাবার অপূর্ণ কাজ তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে। একটি লড়াই বিভেদের ওই সামগ্রিক চিত্র বদলে দিতে পারেনি। লিন্ডা বড় হয়েছেন। একবার পারিবারিক ভাবে স্থানান্তরিতও হয়েছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর ১৯৬১ সালে ফেরত আসেন সেই টোপেকাতেই। সেখানে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা, সংসার, এবং বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই। ১৯৭০ সাল থেকে তিনি এই লড়াই তীব্র করেন। কারণ আমেরিকার দক্ষিণে বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘিরে তখনও শিক্ষায় সেই ‘পৃথক ব্যবস্থা’ বিদ্যমান। ১৯৭৯ সালে আবার শুরু করেন ‘টোপেকা মামলা’, ‘আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন’কে পাশে নিয়ে। ১৯৯৩ সালে কোর্ট পাকাপাকিভাবে মেনে নিল, ‘পাবলিক স্কুল ব্যবস্থায় বৈষম্য হয়েছে।’

লিন্ডা ব্রাউনকে আমরা তেমন করে চিনি না বটে, তবে আমেরিকার নাগরিক অধিকারপ্রেমী অসংখ্য সাদাকালো মানুষের কাছে তিনি স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামে এক অসাধারণ যোদ্ধা হিসাবে পরিচিত। তাঁর কৃতিত্ব বিশ্বের সর্বত্র বঞ্চিত জনগণের মুক্তির স্বপ্নের সামনে দৃষ্টান্তের মতো দাঁড়াতে পারে। কারণ যখন আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে ধর্মীয় বা সামাজিক বিভাজনের বিরুদ্ধে লড়ি, দলিতদের অধিকারের জন্য লড়ি, আমরা তো আসলে লিন্ডার লড়াইটাই চালিয়ে যাই। ১৯৮৮ সালে লিন্ডা তাঁর বোনের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্রাউন ফাউন্ডেশন ফর এডুকেশন, ইকোয়ালিটি, এক্সেলেন্স অ্যান্ড রিসার্চ’। এই ফাউন্ডেশন এখনও যথেষ্ট সক্রিয়।

লিন্ডা ব্রাউন তাঁর শিক্ষা আন্দোলনকে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকাবাসীর অস্তিত্ব ও আত্মসম্মানের লড়াইতে পরিণত করেন। এই তো সেদিন আমেরিকার স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ‘অস্ত্র আইন’ কড়া করার দাবিতে ‘জীবনের জন্য হাঁটা’য় যোগ দিল। তার ঠিক আগে বিভিন্ন স্কুলে নেওয়া হয়েছিল ‘ওয়াক আউট’ প্রোগ্রাম। ষাট জন বন্ধুকে নিয়ে তেমনই হাঁটতে বেরিয়েছিল এগারো বছরের নেওমি ওয়াডলার। কিন্তু নির্ধারিত সতেরো মিনিটের বদলে তারা হাঁটল আঠারো মিনিট। অতিরিক্ত এক মিনিটের হাঁটা ফ্লরিডা স্কুল হামলায় নিহত কোর্টলিন-এর (সতেরো বছরের শিক্ষার্থী) মতো সেই সব কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রছাত্রীর জন্য ‘যারা জাতীয় সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় জায়গা পায় না।... যাদের শুধু একটা সংখ্যা হিসাবে দেখা হয়।’ লিন্ডা কালো চামড়ার মানুষদের ‘সংখ্যা’ থেকে ‘মানুষ’-এর মর্যাদায় আনতে চেয়েছিলেন। তাঁর প্রয়াণের পর তাই কানসাসের গভর্নর জেফ কলিয়ের বলেছেন, ‘চৌষট্টি বছর আগে টোপেকার এক বালিকা একটি মামলা নিয়ে হাজির হয়েছিল, যা পরে সমগ্র আমেরিকার পাবলিক স্কুল ব্যবস্থায় বৈষম্যের রীতিকে মুছে দিল।’ লিন্ডা ব্রাউন তাই বিভেদহীন সমাজের এক মুক্ত মানুষের নাম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Linda Brown US civil rights Passes Away
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE