Advertisement
E-Paper

ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া যেন নিয়ন আলোয় পণ্য না হয়

যা কিছু ব্যক্তিগত, তাকেই আমরা অনেকে করে তুলেছি প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তু। কে, কতটা অন্যের থেকে বেশি সুখী, বেশি ‘স্টাইলিশ’ ভাবে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ পালন করছি, এ যেন তার এক প্রতিযোগিতা। অথচ, বাঙালির কাছে প্রেম বিরাট আশ্চর্যজনক ছিল। লিখছেন মনিরুল ইসলামযা কিছু ব্যক্তিগত, তাকেই আমরা অনেকে করে তুলেছি প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তু। কে, কতটা অন্যের থেকে বেশি সুখী, বেশি ‘স্টাইলিশ’ ভাবে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ পালন করছি, এ যেন তার এক প্রতিযোগিতা। অথচ, বাঙালির কাছে প্রেম বিরাট আশ্চর্যজনক ছিল। লিখছেন মনিরুল ইসলাম

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:২২
পসরা। ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র জন্য। নিজস্ব চিত্র

পসরা। ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র জন্য। নিজস্ব চিত্র

‘আবার এসেছে সে ফিরিয়া’। পাগলা দাশু নয়। বলছি ১৪ ফেব্রুয়ারির কথা। ভালবাসার জন্য একটা দিন। ফেব্রুয়ারির প্রায় প্রথম থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে অপেক্ষা। অনেক পরিকল্পনা— দিনটাকে যতটা পারা যায় রঙিন করে তোলার।

এক দল রয়েছেন এর উল্টো দিকে—তাঁরা বলছেন, ‘‘যত সব অপসংস্কৃতি! বিদেশি কালচারের করুণ অনুকরণে দেশটা গোল্লায় যেতে বসেছে। বাঁচাতে হবে বিপথে যাওয়া আমাদের এই তরুণ প্রজন্মকে।’’ যাঁরা চরমপন্থী, তাঁরা আবার দেশের বিভিন্ন স্থানে লাঠি হাতে বেরিয়ে পড়েছেন। যে করেই হোক, এই সব ‘অপসংস্কৃতি’ বন্ধ করতেই হবে। উদারপন্থীরা আবার বলছেন, ভালবাসাহীন এই যান্ত্রিক পৃথিবীতে যদি একটা দিন ভালবাসায় পল্লবিত হয়ে ওঠে, তাতে ক্ষতি নেই। এর মাঝেই কবি-মন প্রশ্ন তোলে, একটা নির্দিষ্ট দিনে কি সবটুকু ভালবাসা যায়?

ভালবাসা চিরন্তন। অনাদিকালের হৃদয়-উৎস হতে কোটি কোটি প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। ভালবাসা মানে আসলে গোটা জীবন।

এই সব মত-মতান্তর, চিন্তা-ভাবনার তোয়াক্কা না করে আমরা ভেসে চলেছি ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’-র প্রবাহে। আর আধুনিক পৃথিবীর, বাণিজ্যিক পৃথিবীর গ্রাসে যেন বন্দি হয়ে পড়ছে আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি। যা ঘটছে, তার বেশির ভাগকেই প্রেমের ‘পণ্যায়ন’ বললে অত্যুক্তি হয় না। ভালবাসার যেন একটিই দিন সম্বল—‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’।

সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামক ধর্মযাজকের ভালবাসার জন্য আত্মবলিদানের কাহিনি আজ অতীত। পাশ্চাত্য থেকে বাণিজ্য সম্প্রসারণের কৌশলী পরিকল্পনার হাত ধরে আজ তার রমরমা বাজার। বাঙালির আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি অনেকটা বদলে গিয়েছে। তাই কেমন কাটে আজকের এই ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’? সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে নিয়ে ‘শপিং মল’-এ গিয়ে দামি উপহার দেওয়া বা ঝাঁ চকচকে ‘মাল্টিপ্লেক্স’-এ সিনেমা দেখা আর রেস্তোরাঁর আধুনিক খাবারে উদরপূর্তি না হোক তথাকথিত ‘স্টেটাস’কে উঁচুতে তুলে ধরার চেষ্টা। উপহারের তালিকাও বদলে গিয়েছে বাঙালির। বই উপহার? তেমন ভাবেন খুব কম জন। ই-কমার্সের সৌজন্যে ঘরের আরাম কেদারায় বসেই বিদেশি ‘ব্র্যান্ড’-এর জিন্স, দেশি-বিদেশি সুগন্ধি, এমনকি, কৃত্রিম গোলাপও উপহার দেওয়া যায়।

শুধু উপহার বিনিময়েই কি কাজ মিটল? নৈব নৈব চ। সঙ্গে সঙ্গে ‘অ্যান্ড্রয়েড’ বা আই ফোনের ক্যামেরায় তোলা ‘সেলফি’ এবং সে সব ছবির সাহায্যে ফেসবুকে ‘স্ট্যাটাস’ যতক্ষণ দেওয়া না যাচ্ছে, ততক্ষণ শান্তি নেই। যা কিছু ব্যক্তিগত তাকে আমরা অনেকেই করে তুলেছি প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তু। কে, কতটা অন্যের থেকে বেশি সুখী, বেশি ‘স্টাইলিশ’ ভাবে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ পালন করছি, এ যেন তার এক প্রতিযোগিতা। দেখ— আমরা পরস্পরের হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছি ! দেখ, আমরা গালে গাল ছুঁইয়ে কী সুন্দর হাসছি! দেখ, প্লেটে পিজ্জা, বার্গার, চোখে ‘ব্র্যান্ডেড’ সানগ্লাস।

সবটাই যেন বিজ্ঞাপন। রহস্যে ভরা আতরের সুগন্ধির মতো প্রেম এখন কেবল হাতেগোনা লোকের জন্য। শঙ্খ ঘোষের কলম থেকে বললে—‘একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি/ তোমার জন্য গলির কোণে/ ভাবি আমার মুখ দেখাব/ মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া যেন ‘নিয়ন আলোয় পণ্যে’ পরিণত।

অথচ, এই বাঙালির কাছে প্রেম একটা বিরাট আশ্চর্যজনক ব্যাপার ছিল। ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ উদ্‌যাপনের বাহুল্য ছিল না, ছিল সরস্বতী পুজো। বাঙালির অলিখিত ভালবাসার দিন। পছন্দের ছেলেটি হলুদ পাঞ্জাবি পরে বা মেয়েটি বাসন্তী শাড়িতে অন্য রকম হয়ে যখন স্কুলে বা মণ্ডপে আসত, তখন তাকে এক ঝলক দেখার অপেক্ষা যেন চিরন্তন। চোখে চোখে চাওয়া, একটু পাশাপাশি থাকা। নিদেনপক্ষে প্রসাদ দিতে গিয়ে দু-একটা বাক্য বিনিময় বা হাতের একটু স্পর্শ। সেই তো পরম পাওয়া। কত বাধা-নিষেধ তখন প্রেমের। কেউ দেখে ফেলল কি না, বাড়িতে খবর চলে গেল কি না। ভয়ে-লজ্জায়-সঙ্কোচে-স্বপ্নে সে কী রোমাঞ্চ!

প্রেমের জন্য ছিল বহু অপেক্ষা কঠিন প্রতিজ্ঞা, অন্য রকম পাগলামি। তখন ভালবাসার জন্য লিখে ফেলা যেত একের পরে এক কবিতা। বিশেষ কারও জন্য যাপন করা যেত কবিতা-জীবন। রবীন্দ্রনাথের মতো করে বলতে পারা যেত—‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’। বিনয় মজুমদার লিখে ফেলতে পারতেন, ‘ফিরে
এসো চাকা’।

জানি না বিজ্ঞাপনের যুগে, বাণিজ্যিক বস্তুবাদ আমাদের সেই প্রেমের স্বর্গ থেকে বিচ্যুত করতে পেরেছে কিনা। আমি আশাবাদীদের দলে। হয়তো নাগরিক ভিড়ে এখনও কারও হৃদয়ে পেলব প্রেম খেলা করে। প্রেমে ব্যর্থতায় অ্যাসিড ছোড়ার মানসিকতা নয়, হয়তো এখনও তাঁদের ভালবাসা কবিতা হয়ে ফোটে। এই ভালবাসা থাক জীবন জুড়ে। এই ভালবাসা বাঁচুক মানুষের হৃদয় জুড়ে। চিরন্তন কাল ধরে। ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ নিষিদ্ধ করতে বলছি না। ভালবাসা উদ্‌যাপনের জন্য আরও একটা দিন থাকুক। ক্ষতি নেই। শুধু আমরা যেন হৃদয়ের একান্ত সম্পদকে পণ্য না করে ফেলি। পণ্য না হয়ে যাই নিজেরা। বরং বস্তু-পৃথিবীর একেবারে উল্টো দিকে গিয়ে যেন বলতে পারি— ‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো…’

লেখক রঘুনাথপুর কলেজে
বাংলার শিক্ষক

Valentine Day Love Story
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy