কলকাতায় আসার আগে বিপ্লব সাঁতরা তাঁর খেতের পালং শাক খাইয়ে এসেছেন গরুকে। উত্তর ২৪ পরগনার আমডাঙায় তাঁর জমি-বাড়ি, গ্রাম বোদাল। মাটি ভাল, ফসল প্রচুর। কিন্তু দাম কই? দিন দশেক আগে জমির কপি কুচিয়ে দিয়েছেন জমিতেই। ফেলা গিয়েছে পাটশাক। গত শীতে টম্যাটো পচেছে খেতে।
কেমন লাগে, যখন দেখেন কষ্টের ফসল নষ্ট হচ্ছে? ‘‘মনে হয় যেন চাকরি থেকে বরখাস্ত হলাম। মনে হয়, জীবনে আর চাষ করব না।’’
উদ্যানপালন দফতরের ওয়েবসাইটের প্রথম বাক্য, ‘আমাদের পায়ের তলায় রয়েছে সোনার খনি।’ সব্জি উৎপাদনে এ রাজ্য ভারতের শীর্ষে। বছরে আড়াই লক্ষ টনেরও বেশি। সেই সোনার ফসল রাস্তায় ঢেলে দেন চাষি। গড়াগড়ি যায় ঢেঁড়স, লঙ্কা, টম্যাটো। ভারতে ফল-সব্জির অর্ধেক নষ্ট হয়।
ক্ষতি কমত, যদি রাজ্যের চাষি সব্জি পাঠাতে পারত বিদেশে। সেই দাবি জানাতেই কলকাতার প্রেস ক্লাবে নানা জেলা থেকে এসেছিলেন বিপ্লবের মতো চাষিরা। তাঁদের বক্তব্য, সব্জি রফতানি হলে স্থানীয় বাজারে তার দাম চড়ে। যেমন, কালো সিম রফতানি হচ্ছে বলে বাজারে দর যাচ্ছে পঁচিশ-ত্রিশ টাকা কিলোগ্রাম। সবুজ সিম বাইরে যায় না, তার দর মাত্র আট টাকা।
চাষিদের দাবি, রফতানি চালু থাকলে সব্জির দর প্রতি কেজিতে পাঁচ টাকা থেকে সাত টাকা বাড়েই। পানপাতাও তাই। পাঁচ কেজির প্যাকেট ৯০০ টাকা, রফতানি বন্ধ হলে তা-ই নামে চারশো টাকায়। চাষির হিসেব, রফতানি চললে রোজগার বাড়ে ত্রিশ থেকে চল্লিশ শতাংশ। বিদেশে চাহিদাও চড়া। বাংলার পুঁই-পালং-কলমি, কচুশাক, লালশাক, করলা-কাঁকরোলের জন্য মুখিয়ে রয়েছেন ইউরোপের ক্রেতারা।
সরকারও তো তাই চায়। কেন্দ্র বলেছে, আগামী চার-পাঁচ বছরে কৃষি রফতানি দ্বিগুণ করে চাষির রোজগার দ্বিগুণ করবে। তৃণমূল সরকারও রফতানিতে আগ্রহী।
কিন্তু ঘোষণা আর বাস্তবে দূরত্ব বিস্তর। পূর্ব এবং উত্তরপূর্ব ভারতের সব রাজ্যের ফল-সব্জি রফতানির জন্য ভরসা দত্তপুকুরের একটি প্যাকিং হাউস। সেটিও বেসরকারি। হিমঘর সবই আলুর দখলে। সব্জির জন্য একটিও নেই। তবু এ রাজ্য থেকে বর্তমানে দিনে দশ টন সব্জি আর ফল যাচ্ছে নানা দেশে, জোগান দিচ্ছেন হাজার দশেক চাষি। যদি ইউরোপ এবং অন্যান্য দেশের বাজার পুরোপুরি ধরা যায়, তা হলে রফতানি বাড়বে অন্তত পাঁচগুণ, দাবি করলেন ফল-সব্জি রফতানিকারী ব্যবসায়ীদের সংগঠনের সম্পাদক মৃণাল সিংহ। বাজারে তার যা প্রভাব পড়বে, তাতে অভাবী বিক্রি থেকে বাঁচবেন বহু চাষি।
কিন্তু ইউরোপে রফতানির জন্য সরকারি ছাড়পত্র পেতে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের। কী করলে স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার পরীক্ষায় পাশ হবে বাংলার শাকসব্জি, তার হদিসও পাচ্ছে না চাষিরা। ‘‘সরষের খোল, জৈব কীটনাশক দিয়েই পানচাষ করছি, যেমন বলেছেন এডিএ (কৃষি উন্নয়ন আধিকারিক)। তবু পান তো বাইরে যাচ্ছে না’’, আক্ষেপ করলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের
বিশ্বনাথ খাটুয়া।
কেন মার খাচ্ছে রফতানি? নানা দফতরে কথা বলে দেখা গেল, সমস্যা ছোট ছোট। সমাধানও দুঃসাধ্য নয়। কিন্তু ফাঁক থেকে যাচ্ছে।
প্রথম সমস্যা সার্টিফিকেট জোগাড় করা। ইউরোপে ফল-সব্জি পাঠানোর জন্য স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার যে মানপত্র লাগে, সেই ‘ফাইটো-স্যানিটারি সার্টিফিকেট’ মিলছে না বেশ কিছু শাক-সব্জিতে। দু’বছরের চেষ্টাতেও ব্যর্থ ব্যবসায়ীরা। কেন্দ্রের কৃষি মন্ত্রকের অধীনে যে বিভাগ (ডিরেক্টরেট অব প্লান্ট প্রোটেকশন, কোয়ারান্টাইন অ্যান্ড স্টোরেজ, সংক্ষেপে ডিপিপিকিউএস) ওই মানপত্র দেয়, তার এক কর্মী জানালেন, এখানে ফল-সব্জি পাশ হওয়ার পর বিদেশে গিয়ে যদি পোকা বেরোয়, তা হলে দিল্লির বড়কর্তাদের কাছে জবাবদিহি করতে হয় ইনস্পেক্টরকে। ২০১৪ সালে এক বার পাঁচ রকম ফল-সব্জি নিষিদ্ধ করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। ২০১৬ সালে নিষেধাজ্ঞা উঠলেও, সরকারি ছাড়পত্র আর মেলেনি। ব্যবসায়ীদের নালিশ, ইনস্পেক্টররা মাল পরীক্ষা না করেই বাতিল করছেন। আগের মাত্রা আর ছুঁতে পারছে না সব্জির রফতানি।
প্রশ্ন হল, চাষির মাল যাতে পরীক্ষায় পাশ করে, তার উপায় কী? সরকারি নিয়ম, চাষিরা কৃষি মন্ত্রকের রফতানি উন্নয়ন সংস্থায় (এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড প্রসেসড ফুড প্রো়ডাক্টস এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি বা সংক্ষেপে বললে, ‘অ্যাপেডা’) নাম লেখালে চাষিকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। নাম লেখাতে হবে অনলাইনে, যে চাষি যা ফলান, সেই ফসলের নামে ক্লিক করে। কিন্তু পটল, পেয়ারা, কচু, সজনে ডাঁটা, পেঁয়াজকলি, কিছুই যে নেই সেই তালিকায়! বাংলার ব্যবসায়ী ও চাষিরা ত্রিশটা পণ্য যোগ করতে আবেদন করেছেন। কর্তারা ‘দেখছেন।’
কেবল প্রশিক্ষণই তো নয়, চাই প্রযুক্তি। পানে সালমোনেলা আসে দূষিত জল থেকে। উপায়, বিশেষ রশ্মি দিয়ে জীবাণুশূন্য করা। পশ্চিমবঙ্গে সর্বাধিক পান উৎপন্ন হয়, কিন্তু ওই যন্ত্র একটাও নেই। নেই ফল-সব্জিকে কীটশূন্য করার ‘হট ভেপার ট্রিটমেন্ট’ যন্ত্র। উপরন্তু কৃষি প্রযুক্তি সহায়কের প্রচুর পদ শূন্য, চাষিকে প্রশিক্ষণ দেবে কে?
কে কী করবে, সে সম্পর্কে আধিকারিকদের বক্তব্য এই রকম।
ডিপিপিকিউএস: আমরা পরীক্ষা করে সার্টিফিকেট দিই। সব্জি কী করে রফতানির পরীক্ষায় পাশ করবে, বলবে রাজ্যের উদ্যানপালন দফতর।
উদ্যানপালন: উৎপাদন কী করে বাড়বে,
তা শেখাতে পারি। রফতানি হবে কী করে, কৃষি বিপনন দেখবে।
কৃষি বিপণন: সব্জি রফতানি হয় খুব কম। তার কোনও টার্গেট বা অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি হয়নি। রফতানি দেখে অ্যাপেডা।
অ্যাপেডা: চাষি নাম লেখালে সাহায্য করব।
গত বছর শুরু হয়েছে নাম লেখানো। কত জনের নাম উঠেছে? কর্তারা জানালেন, তেইশ জন।
নেতারা ঘোষণা করেন, আধিকারিকরা আপিস করেন। কাজটা করবে কে? খুব কঠিন তো নয়। একটি কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্রের বিজ্ঞানী জানালেন, ‘ফেরোমন’-এর ফাঁদ, জৈব সার-কীটনাশক আর পরিমিত রাসায়নিক ব্যবহারে দুই-তিন বছরের মধ্যে একটি এলাকার সব্জি কীটশূন্য, উন্নত মানের করে ফেলা যায়। চাই সমন্বয়। ‘‘চাষি, ব্যবসায়ী, কৃষিবিজ্ঞানী, উদ্যানপালন আধিকারিক, রফতানির পরীক্ষক, সকলকে নিয়মিত কর্মশিবির করতে হবে একসঙ্গে।’’ মৃণালবাবুর আক্ষেপ, এই সমন্বয়ের জন্য তাঁরা দরবার করছেন নানা দফতরে। কাজ হয়নি।
কাজ হয়েছে, তেমন একটি রাজ্য মহারাষ্ট্র। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সব্জির শীর্ষ উৎপাদক হয়েও সব্জির রফতানিতে প্রায় শেষে। মহারাষ্ট্র উৎপাদনের পরিমাণের নিরিখে অষ্টম, কিন্তু রফতানিতে প্রথম। সে রাজ্যের সরকার চুয়াল্লিশটি হিমঘর খুলেছে সব্জি আর ফলের জন্য। কীট ও জীবাণু নাশের জন্য ‘হট ভেপার ট্রিটমেন্ট’ যন্ত্র, কোবাল্ট রশ্মি যন্ত্র বসিয়েছে সরকার। রয়েছে সরকারি ল্যাবরেটরিও। তা ছাড়াও আছে বেসরকারি ব্যবস্থা। মোট দু’শো তেেরাটি প্যাকিং হাউস সে রাজ্যে।
এ রাজ্যে সরকার ধান আর আলু ডিঙিয়ে দেখতে শেখেনি। তাই পাশাপাশি চলছে অভাব আর অপচয়। এক দিকে শিশু ভোগে অপুষ্টিতে, অন্য দিকে ফল-সব্জি নষ্ট হয় খেতে। এক দিকে ক্রেতা টাকা হাতে বসেও সব্জি পান না, অন্য দিকে চাষি সব্জি ফলিয়েও টাকা পান না। প্রশ্ন তুললেই সরকারি আধিকারিকরা আঙুল তোলেন চাষির দিকে— ওঁরা প্রযুক্তি-প্রশিক্ষণ বোঝেন না। সার বিক্রেতাদের কথায় চলেন। সহজে কাজ সারতে চান।
নেতা আর আধিকারিকরা যদি সহজ কর্তব্যগুলো চটপট সেরে ফেলতেন, তা হলে চাষ করার জন্য আক্ষেপ করতে হত না চাষিকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy