ভয়ঙ্কর সেই হামলার পর পুলওয়ামা। —ফাইল চিত্র।
পুলওয়ামা কাণ্ড, অতঃপর ভারতের সার্জিক্যাল স্ট্রাইককে ঘিরে আম ভারতীয়ের মনে যে আবেগ তৈরি হয়েছে, তা যে নিখাদ সেটা বলাই বাহুল্য। বিশেষত পুলওয়ামায় অত জন বীর জওয়ানের মৃত্যু দেশকে যে কাঁপিয়ে দিয়েছে, সেটাও বলার অপেক্ষা রাখে না। অপ্রত্যাশিত নয় এই আবেগ, অপ্রত্যাশিত নয় এই ক্রোধ এবং ক্ষোভও। মুশকিলটা বাধে তখনই যখন তা নিয়ে ব্যবসার প্রবণতা শুরু হয়ে যায়। আম আদমির ক্রোধ যখন পণ্য হয়ে দাঁড়ায় ব্যবসায়ীদের কাছে। সেই কারবার রাজনীতিরও হতে পারে অথবা অন্যতর কিছুও।
সোশ্যাল মিডিয়া জু়ডে তীব্র যুদ্ধোন্মাদনা, পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ঘোষণা করে উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রদর্শন এবং যুদ্ধবিরোধীদের দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে যারপরনাই অপমান করা— এই সামগ্রিক ‘কারবার’-এরই অঙ্গ। শাসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে পুলওয়ামা নিয়ে ‘রাজনীতি করার’, বিরোধীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ‘পাল্টা রাজনীতির’। উরি দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের বিপুল সাফল্যের পর পুলওয়ামা ও তৎপরবর্তী সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ২ নিয়ে ফিল্ম করার জন্য বলিউডে লম্বা লাইন পড়ে গিয়েছে। অন্য দিকে, তত ক্ষণে তৈরি হচ্ছে ডিজাইনার শাড়ি, যার থিম আবার সেই একই— সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। ১৩৬ কোটি মানুষের আবেগ যেখানে জড়িত সেখানে খুল্লামখুল্লা কারবার শুরু না হয়ে যায়?
এই আবহেই ভারতের দুই প্রান্ত থেকে দু’টি কাহিনি এই সামগ্রিক চালচিত্রের অন্তর্লীন করুণ সুরকে তুলে আনে। পুলওয়ামায় নিহত পশ্চিমবঙ্গের জওয়ান বাবলু সাঁতরার স্ত্রী মিতা সাঁতরা যখন যুদ্ধ বিরোধিতার কথা বলেন, তখন সোশ্যাল মিডিয়ার ওয়ালে মুছে যায় শহিদ বাবলু সাঁতরার মুখ, ফুটে ওঠে হিংস্র রণোন্মাদ অসংখ্য রক্তপিপাসু মুখ, যারা কোনও দিন বাবলু সাঁতরা ছিল না, থাকবেও না কোনও দিনই। অতএব রণাঙ্গন থেকে সহস্র যোজন দূরে বসে, একান্ত স্বজন হারানো মিতা সাঁতরার উদ্দেশে নিপুণ গোলাবর্ষণ করতে দ্বিধা হয় না তাদের। এ যেন আর এক সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, নিশানা যেখানে যুদ্ধবিরোধী ‘দেশদ্রোহী’ মিতা সাঁতরার মুখ নাক চোখ কান মস্তিষ্ক ও হৃদয়।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
এই ক্ষেপণাস্ত্র কিন্তু ধেয়ে গেল না কর্নাটকের মান্ড্যতে যেখানে পুলওয়ামার আর এক নিহত জওয়ান এইচ গুরুর স্ত্রী কলাবতীকে তাঁর এই বিপুল শোকের সময়ে চাপ দেওয়া হচ্ছে তাঁর দেবরকে বিয়ে করে নিতে। কারণ সেই একই, আর্থিক কারবার। নিহত জওয়ানের জন্য ঘোষিত ক্ষতিপূরণের টাকা যাতে ‘পরিবারের’ মধ্যেই থেকে যেতে পারে। সদ্য স্বামীহারা নারীর শোক-সন্তাপকে তুচ্ছ করে স্বজনের মৃত্যুর দাম নিয়ে যখন মেতে ওঠে পরিবার, যখন পুরুষতান্ত্রিক ঘোষণায় দেবরের সঙ্গে বিয়ের নির্দেশ আসে, তখন অন্যায় দেখে না সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো ওই যুদ্ধোন্মাদের দল। কারণ মান্ড্যর ঘটনায় গোঁড়া বোধবুদ্ধির পরিপন্থী কিছু নেই।
আরও পড়ুন: ক্ষতিপূরণ যেন ‘ঘরে’ থাকে, পুলওয়ামায় নিহতের স্ত্রীকে দেওরকে বিয়ের জন্য চাপ
আরও পড়ুন: পুলওয়ামা হামলা নিয়ে ডিজাইনার শাড়ি!
মিতা সাঁতরা যুদ্ধ চান না। যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় যাঁদের, তাঁদের পরিবার-পরিজনেরাও চান না যুদ্ধ। তবু যুদ্ধের জিগির এখন সোশ্যাল মিডিয়ায়, জিগির ছড়ানোর চেষ্টা ভারতের বাতাস জুড়ে। ওই জিগিরে ব্যবসা আছে, ওই জিগিরে কারবার আছে। ডিজাইনার শাড়ি হোক বা বলিউডি ফিল্ম, অথবা হোক নির্বাচনী তাল ঠোকাঠুকি— সবেরই কেন্দ্রে আমার আপনার আবেগ।
অন্য শপথ নেওয়ার সময় এসেছে এখন। আমার আবেগ আমারই। নট ফর সেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy