Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus

সরাসরি আক্রমণ ফুসফুসে

‘এন’-এর অর্থ ‘নভেল’ আর ‘সিওভি’-র অর্থ হল ‘করোনাভাইরাস’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগের নাম দেওয়া হয়েছে ‘কোভিড-১৯’। ২০১৯ সালে এটি প্রথম শনাক্ত করা হয়। লিখছেন ধ্রুবজ্যোতি চট্টোপাধ্যায় করোনা ভাইরাস সরাসরি মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায়। তাই শ্বাসকষ্ট, জ্বর ও কাশিই সংক্রমণের প্রধান লক্ষণ। এখনও পর্যন্ত যা পর্যবেক্ষণ, ভাইরাসের জীবনকাল ০-১২ দিন।

চিন থেকে দেশে ফিরছেন ইন্দোনেশিয়ার অধিবাসীরা। ফাইল চিত্র

চিন থেকে দেশে ফিরছেন ইন্দোনেশিয়ার অধিবাসীরা। ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

নভেল করোনাভাইরাসের আতঙ্ক এখন বিশ্বজুড়ে। উৎসস্থল চিনের প্রতিবেশী ও বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশ হওয়ায় ভারতও করোনা-আতঙ্কে ভুগছে। চিনের সঙ্গে বিমান পরিষেবা বন্ধ, বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যপরীক্ষার পাশাপাশি সংক্রমণ ঠেকাতে করা হচ্ছে নানা পদক্ষেপ।

‘সার্স’ ও ‘মার্স’ ভাইরাসের স্মৃতি এখনও টাটকা। ২০০২ সালে চিনে প্রায় মহামারির আকার নেয় ‘সার্স’-এর সংক্রমণ। পরে আসে ‘মার্স’। সার্সে আক্রান্তদের প্রায় ৯ শতাংশ ও মার্সে আক্রান্তদের প্রায় ৩৫% প্রাণ হারিয়েছিলেন। বর্তমানে আতঙ্ক ছড়ানো করোনা ভাইরাসও একই গোত্রীয়। এই ভাইরাসের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে ছ’টি প্রজাতি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। আর বর্তমানের নতুন ধরনের ভাইরাসটি ধরলে সংখ্যাটি হবে সাত। ভাইরাসটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘২০১৯-এনসিওভি’। ২০১৯ সালে এটি প্রথম শনাক্ত করা হয়। ‘এন’-এর অর্থ ‘নভেল’ আর ‘সিওভি’-র অর্থ হল ‘করোনাভাইরাস’। চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগের নাম দেওয়া হয়েছে ‘কোভিড-১৯’ (COVID-19)। আন্তর্জাতিক ভাইরাস নামকরণ কমিটি (The International Committee on Taxonomy of Viruses বা ICTV) সার্সের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ‘সার্স কোভি-২’ (SARS-CoV-2) নামে ভাইরাসটিকে চিহ্নিত করেছে।

সরকারি মতে, মধ্য চিনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহর করোনাভাইরাসের সংক্রমণের প্রাথমিক উত্‍সস্থল। চিনের কর্তৃপক্ষ গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর প্রথম এই শহরে নিউমোনিয়ার মতো লক্ষণযুক্ত একটি রোগ ছড়াতে দেখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্কবার্তা পাঠায়। চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি প্রথম সরকারি ভাবে এই রোগে মৃত্যুর কথা ঘোষিত হয়। তবে ঠিক কী ভাবে সংক্রমণ শুরু হয়, তা এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা, সম্ভবত কোনও প্রাণীই এর উৎস। কারণ, এই ধরনের প্রায় প্রতিটি ভাইরাসই প্রাথমিক ভাবে কোনও না কোনও প্রাণী থেকেই মানবদেহে সংক্রামিত হয়েছে। ‘সার্স’-এর ক্ষেত্রে যেমন প্রথমে বাদুড় ও পরে গন্ধগোকুল থেকে সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। ‘মার্স’-ও ছড়ায় উট থেকে।

চিনের উহান শহরে একটি বাজার আছে, যেখানে অবৈধ ভাবে খাদ্য হিসেবে নানা বন্যপ্রাণীর বেচাকেনা চলে। সংবাদপত্রে প্রকাশ, যে সব ব্যক্তিদের মধ্যে প্রথম এই রোগের সংক্রমণ ঘটেছে বলে প্রমাণ মিলেছে, তাঁরা ওই বাজারে যেতেন। বিজ্ঞানী মহলের ধারণা, কিছু সামুদ্রিক প্রাণী, যেমন—‘বেলুগা’ জাতীয় তিমি করোনাভাইরাস বহন করতে পারে। সাধারণ ভাবে উহানের ওই বাজারে এমন প্রাণীর কেনাবেচার নজির নেই। তবে অবৈধভাবে তা হলেও হতে পারে বলে অনেকের অনুমান। অন্য দিকে, এই উহান শহরেই রয়েছে চিনের অন্যতম ভাইরাস গবেষণাগার। খবরে প্রকাশ, ইজ়রায়েলের মতো অনেক দেশের গোয়েন্দা সংস্থার অনুমান, এই গবেষণাগার চিনের জৈব অস্ত্রভাণ্ডার হিসেবে কাজ করে আর এখান থেকেই ভাইরাসটি ছড়িয়েছে। ২০১৫ সালে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থাও চিনের জৈব অস্ত্র নিয়ে গবেষণার কথা বলেছিল। তবে এই সব বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি। আর বিজ্ঞানীদেরও মত, কৃত্রিম পরিবেশে ভাইরাস ‘মিউটেশন’ করলে তা নিজেকে কখনই মানবদেহে বসবাসের উপযোগী করে তুলতে পারে না।

করোনা ভাইরাস সরাসরি মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায়। তাই শ্বাসকষ্ট, জ্বর ও কাশিই সংক্রমণের প্রধান লক্ষণ। এখনও পর্যন্ত যা পর্যবেক্ষণ, ভাইরাসের জীবনকাল ০-১২ দিন। তাই বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশের পরে সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিতে প্রায় পাঁচ-ছ’দিন সময় লাগে। তবে ‘সার্স’ বা ‘মার্স’-এর সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজলে এর জীবনকাল হওয়া উচিত ০-১৪ দিন। যাই হোক, সংক্রমণের প্রাথমিক লক্ষণ জ্বর। তার পরে দেখা দেয় শুকনো কাশি। সপ্তাহখানেকের মধ্যে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় এবং রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর প্রয়োজন হতে পারে।

চিন জুড়ে ছড়িয়ে পড়া রহস্যময় করোনা ভাইরাস নিয়ে সারা বিশ্বেই উদ্বেগ বাড়ছে। কারণ, ভাইরাসটি চিনের সীমানা অতিক্রম করে ইতিমধ্যেই আরও প্রায় ২৬টি দেশে ছড়িয়েছে। ভাইরাসটি কতটা প্রাণঘাতী, তা এখনও স্পষ্ট করা যাচ্ছে না। প্রাথমিক ভাবে একে ‘মার্স’ ভাইরাসের মতো প্রাণঘাতী মনে না হলেও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না এলে ভবিষ্যতে কী হবে, বলা মুশকিল। যাঁদের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা দুর্বল বা ডায়াবেটিস, হৃদরোগ বা কিডনির রোগে ভুগছেন, তাঁরা যদি করোনা-য় আক্রান্ত হন, তবে তা প্রাণঘাতী হতে পারেই বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। আর সংক্রমণ যে গতিতে ছড়াচ্ছে, ভীতিপ্রদ। আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ তো বটেই, হাঁচি-কাশি থেকে বাতাসের মাধ্যমেও ভাইরাস ছড়াচ্ছে। অনেক সময়ে রোগীর শরীরে রোগের লক্ষণ প্রকাশ না পেলেও সংক্রমণের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তাই সবাইকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও।

কী ভাবে সতর্ক হবেন? ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া রুখতে তা কী ভাবে ছড়াচ্ছে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালাচ্ছেন। সাধারণ ভাবে হাঁচি-কাশির মাধ্যমে করোনা সংক্রমণের কথা বলা হলেও ভাইরাসটি কী ভাবে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে স্থানান্তরিত হচ্ছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। উহানে সব রকম সতর্কতা নেওয়া সত্ত্বেও রোগীদের দেখভালে যুক্ত অনেক স্বাস্থ্যকর্মীও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। যদি শুধু হাঁচি-কাশির মাধ্যমেই তা ছড়িয়ে থাকত, তবে স্বাস্থ্যকর্মীদের মুখের মাস্ক ও অন্য সতর্কতা অবশ্যই কিছুটা সুরক্ষা দিত। এ ক্ষেত্রে কী ধরনের মাস্ক সংক্রমণ রুখতে কার্যকরী, তা-ও বিচার্য। শ্বাসকষ্টের জন্য ব্যবহৃত ভাইলযুক্ত ফেসমাস্কগুলো হয়ত কাগজের সার্জিক্যাল মাস্কের চেয়ে বেশি কার্যকরী হতে পারে। দেখা গিয়েছে, মৃদু জীবাণুনাশক রোগের ভাইরাস নষ্ট করতে সক্ষম। তাই সাবান বা জীবাণুনাশক দিয়ে ঘনঘন হাত ধোয়াও কার্যকরী হতে পারে। সংক্রমণের খবর পাওয়া গিয়েছে, এমন কোনও দেশ থেকে ফিরলে অবশ্যই কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে পরীক্ষা করিয়ে নিন। আগেই যেমন বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের উপসর্গগুলি অনেকটা নিউমোনিয়ার মতো। তাই এমন লক্ষণ বেশি দিন চলতে থাকলে সাবধানী হোন।

এখনও পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের নির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা যেহেতু অধরা, তাই সতর্ক থাকা ও সাবধানতা অবলম্বনের বিকল্প নেই। চিনের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা একটি ‘ভ্যাকসিন’ তৈরির চেষ্টা করছেন। যে ভাবে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতিতে করোনাভাইরাস রুখতে প্রতিষেধক তৈরির চেষ্টা চলছে, তাতে আশা করা যায়, দ্রুত কোনও সুখবর মিলবে। পরীক্ষার নানান ধাপ পেরিয়ে তা সকলের ব্যবহারের অনুমোদন পেতে যদিও আরও কিছু সময় লাগবে। তত দিন আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে রোগের ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো যায়। সরকারও যথেষ্ট সর্তক ভাবেই পদক্ষেপ করছে। আমাদেরও সহযোগিতা করতে হবে।

আধিকারিক, জেলা বিজ্ঞান কেন্দ্র, পুরুলিয়া

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus COVID 19 China
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE