Advertisement
E-Paper

অপর

জীবনের অধিকার বলিতে ঠিক কী বুঝায়? তাহা কি শুধু বাঁচিয়া থাকিবার অধিকার? অলওয়রের পেহলু খানের ন্যায় গণপ্রহারে নিহত না হইলেই কি সেই অধিকার রক্ষিত হয়?

শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০

জীবনের অধিকার বলিতে ঠিক কী বুঝায়? তাহা কি শুধু বাঁচিয়া থাকিবার অধিকার? অলওয়রের পেহলু খানের ন্যায় গণপ্রহারে নিহত না হইলেই কি সেই অধিকার রক্ষিত হয়? ইলাহাবাদ হাইকোর্টের লখনউ বেঞ্চ সঙ্গত ভাবেই এই সংবিধানস্বীকৃত অধিকারটিকে এমন সংকীর্ণ গণ্ডিতে বাঁধিতে চাহে নাই। জানাইয়া দিয়াছে, পছন্দসই খাদ্যের অধিকার জীবনের অধিকারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ভারতের সাংস্কৃতিক বহুত্বকে মাথায় রাখিয়া আদালত জানাইয়াছে, রাষ্ট্র এমন কোনও সিদ্ধান্ত করিতে পারে না, যাহাতে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মাংস খাওয়া কাহারও পক্ষে অসম্ভব বা কার্যত অসম্ভব হইয়া দাঁড়ায়। রায়টিকে দুই দিক হইতে দেখা বিধেয়। প্রথমটি ব্যবহারিক দিক। আদালত নির্দেশ দিয়াছে, সরকার যদি বেআইনি কসাইখানা বন্ধ করিতে উদ্যোগ করে, তবে আইনি কসাইখানাগুলির যেন তাহার কোনও প্রভাব না পড়ে, তাহা নিশ্চিত করাও সরকারেরই কর্তব্য। অর্থাৎ, আইনের দোহাই দিয়া নিজেদের অসাংবিধানিক ইচ্ছাকে জনগণের উপর যে চাপাইয়া দেওয়া চলিবে না, আদালত তাহা স্পষ্ট করিয়া দিয়াছে। এই কথাটি যে কোনও গণতান্ত্রিক সরকারকে বলিয়া দিতে হয়, তাহাই যথেষ্ট লজ্জার, কিন্তু নাগপুরের হিন্দুত্ববাদী আবেগে স্পষ্টতই সেই লজ্জা ভাসিয়া গিয়াছে। আদালতের নির্দেশে আদিত্যনাথদের চৈতন্য হয় কি না, তাহাই প্রশ্ন।

রায়ের অন্য দিকটি দার্শনিক। আদিত্যনাথ এবং তাঁহার পারিষদবর্গ মাংসভক্ষণের উপর খড়্গহস্ত, কারণ তাঁহাদের ধর্মীয় চেতনার সহিত এই রসনাবিলাস খাপ খায় না। কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজে যাহা নহে, তাহার সমস্তটাকেই অন্যায্য এবং অবৈধ বলিয়া ভাবিতে শেখানো অশিক্ষার অন্যতম দোষ। কেবল আদিত্যনাথরাই নহেন, গৈরিক হিন্দুত্ববাদীদের সিংহভাগই সেই দোষে দুষ্ট। ‘অপর’কে অ-বৈধ ভাবিবার অভ্যাসটি সাংস্কৃতিক বহুত্বের বৃহত্তম শত্রু। এই ব্যাধিটি নির্মূল না হইলে ভাবাবেগে আঘাত লাগাও বন্ধ হইবে না। যাহা আমার নিকট সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য, ‘অপর’ তাহাই করিয়া চলিতেছে— ইহাই ভাবাবেগে আঘাত লাগিবার মূল কারণ। কোনও অভ্যাস একটি গোষ্ঠীর নিকট অগ্রহণযোগ্য হইলেই যে তাহা অ-বৈধ হইয়া যায় না, আদালতের রায়ে এই কথাটি স্পষ্ট। ভারতের সাংস্কৃতিক বহুত্ব এমনই বিপুল যে এই দেশটি এক অর্থে ‘অপর’-এর দেশ— প্রতিটি জনগোষ্ঠীর নিকট অন্য জনগোষ্ঠীগুলি ‘অপর’। রাষ্ট্র কোনও একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর সহিত একাত্ম হইয়া বাকি জনগোষ্ঠীগুলির ‘অ-বৈধ’ আচরণ নিয়ন্ত্রণ করিতে চাহিলে তাহা যে সংবিধানের মৌলিক চরিত্রটিকেই লঙ্ঘন করে, এই কথাটি ভুলিলে সংশোধনের অযোগ্য ভুল হইবে।

আদালত বলিয়াছে, মানুষের খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করিবার উদ্দেশ্যে কোনও প্রকট বা প্রচ্ছন্ন সিদ্ধান্ত সরকার একতরফা ভাবে করিতে পারে না। তাহার জন্য আলোচনা প্রয়োজন, সংলাপ প্রয়োজন। এক্ষণে স্মরণ করাইয়া দেওয়া বিধেয়, সামাজিক পরিসরই সেই আলোচনার একমাত্র স্থান হইতে পারে। সরকারের সহিত ক্ষমতার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। ফলে, সরকারও যদি আলোচনায় অংশী হয়, তাহার ক্ষমতাই সেই আলোচনাকে একটি বিশেষ অভিমুখে লইয়া যাইতে পারে। অতএব, সরকারকে বাহিরে রাখিয়াই আলোচনাটি চালাইতে হইবে। গণতান্ত্রিক পরিসরে এই গোত্রের আলোচনার গুরুত্ব অসীম। রাজনৈতিক দলগুলি বিলক্ষণ সেই আলোচনার শরিক হইতে পারে, কিন্তু সংখ্যার আধিপত্য যাহাতে আলোচনার গতিকে প্রতিহত না করে, তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে। এবং, এই সংলাপে যোগ দেওয়ার পূর্বে ভারতের বহুত্বকে স্বীকার করিতে হইবে। যে ভাবাবেগে ঘনঘন আঘাত লাগে, তাহাকেও পিছনে ফেলিয়া আসিতে হইবে।

Right to life
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy