Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
অন্ধ একদেশদর্শিতা যখন আত্মঘাতের প্রকরণ হয়ে দাঁড়ায়

শত্রুরূপে ভজনার ফল

আমার জীবন-অভিজ্ঞতায় দেখেছি, নিম্নবিত্ত, স্বল্পশিক্ষিত মানুষ যেমন সততা এবং নিপুণতার সঙ্গে সমাজবাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করেন, বড় বড় পণ্ডিতরা অনেক সময়েই তা পারেন না।

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৯ ০০:৫৮
Share: Save:

কয়েক মাস আগে দু’টি বেশ নামী পোর্টালের করা একটিই খবরের নীচের ‘কমেন্ট’গুলো দেখছিলাম। খবরটা অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহকে নিয়ে। দু’টি পোর্টালের হেলান দু’দিকে হলেও, দুটোতেই নানা মতের পাঠক মন্তব্য করে থাকেন। তা, প্রথমটার প্রথম একশোটি কমেন্টের মধ্যে দেখলাম, উনিশ জন নাসির সাহেবকে পাকিস্তানে চলে যেতে বলেছে। দ্বিতীয়টার প্রথম একশোটি কমেন্টের মধ্যে চব্বিশ জনের সেই একই দাবি। আবার ওই একই খবরের লিঙ্কে প্রথমটায় সতেরো জন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মা’কে অশ্রাব্য গালিগালাজ করেছে, এবং দ্বিতীয়টায় সেই একই কাজ করেছে চোদ্দো জন। এদের মধ্যে প্রথমটায় ন’জন এবং দ্বিতীয়টায় পাঁচ জন সেই নিরানব্বই বছর বয়সি ভদ্রমহিলাকে বিশ্বসংসারের জঘন্যতম হুমকিটি দিয়েছে। মোদীকে দেওয়া গালাগালগুলো ধর্তব্যের মধ্যেই আনছি না, গণতন্ত্রে মানুষ তার শাসককে গাল দিয়েই থাকে। কিন্তু কোনও মাকে গালাগাল করার এক্তিয়ার কারও নেই। তাই নাসিরুদ্দিনকে ‘পাকিস্তানে যাও’ বলা লোকগুলো যেমন নিন্দনীয়, নিরানব্বই বছরের এক জন ভদ্রমহিলাকে ‘গালাগালি’ দেওয়া লোকগুলোরও তেমনই প্রাপ্য কঠোর নিন্দা ও তিরস্কার। এ বার, আপনি যদি এক দলকে ক্রমাগত দোষারোপ করেন, অথচ দ্বিতীয় দলটিকে দেখতে না পাওয়ার ভান করেন, তা হলে বাংলায় যাকে বলে ‘পার্শিয়ালিটি’ হয়, আর তার ফল কী হয়, এ বারের লোকসভা নির্বাচনই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

একদেশদর্শিতা শুধু এখানেই নয়, সর্বত্র। কাজের সূত্রে জীবনে বহু বার মুম্বইতে গিয়েছি, থেকেছি। কলকাতার বাইরে পুরী বাদ দিলে মুম্বইটাই খানিকটা চিনি, বলা যায়। সেই মুম্বইতে এক বার মরতে মরতে বেঁচেছিলাম যখন আমি নামার পাঁচ মিনিটের মাথায় একটা ব্রিজ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছিল। কম করে ত্রিশ জন মারা গিয়েছিলেন সেই দুর্ঘটনায়। এ রকম আরও ব্রিজ, বাড়ি ভাঙার খবর মাঝেমধ্যেই মেলে মুম্বই থেকে, আর প্রশ্ন জাগে, ভারতের অনেক রাজ্যের থেকে বেশি টাকার বাজেট পেশ করে যারা, সেই বৃহন্মুম্বই কর্পোরেশনের নির্বাচনে বার বার শিবসেনা জেতে কী ভাবে? এত অবহেলা, এত অপদার্থতা, এত দুর্নীতির তাজ মাথায় নিয়েও?

মুম্বইয়ের কোলাপুরি চপ্পল বিক্রেতা জাভেদ থেকে ট্যাক্সিচালক প্রভাকর, ধাবার কর্মী মহেশ থেকে ছোট্ট বইয়ের দোকানের মালিক ইউনুস, শ’তিনেক খেটে-খাওয়া মানুষকে জিজ্ঞেস করেছি কথাটা। অন্তত শেষ দুটো ভোটের প্রেক্ষিতে কমবেশি অনেকেই যে স্লোগানের কথা বলছেন তা হল: উপর হ্যায় ছত্রি, নীচে হ্যায় ছায়া/ ভাগো রে হিন্দু, দাউদ লওট আয়া। দাউদের নামটা কেকে কিশমিশের মতো এক-দু’বার নেওয়া হয়; অন্য সময় স্লোগানটাকে অক্ষুণ্ণ রেখে, দাউদের জায়গায় আসে হায়দরাবাদের দুই ভাইয়ের নাম, যাঁদের ছোট জন পুলিশ সরিয়ে দিলেই ‘হিন্দু-মুক্ত’ ভারতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আর বড় জন সংসদে বা বাইরে নানা গোলগোল কথায় সেটাকেই ঘুরিয়ে সমর্থন করে চলেছেন। মুম্বইয়ের মতো জায়গায় এমন স্লোগান দেওয়া হয়, পুলিশ প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা করে না? নিতে গেলে দাঙ্গা বাধতে পারে। আর, না নিলেই তো লাভ— এই সব স্লোগান দেওয়া মিছিল যেখান দিয়ে যায় সেখানেই বিপুল ব্যবধানে জেতে তো! যতই ক্ষোভ থাক, শিবসেনাকে সরিয়ে লোকে দাউদকে নিয়ে আসবে নাকি? বলে ট্যাক্সিচালক, চপ্পল-বিক্রেতারা।

আমার জীবন-অভিজ্ঞতায় দেখেছি, নিম্নবিত্ত, স্বল্পশিক্ষিত মানুষ যেমন সততা এবং নিপুণতার সঙ্গে সমাজবাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করেন, বড় বড় পণ্ডিতরা অনেক সময়েই তা পারেন না। পারেন না কারণ সমাজ একটা আগুনে চাপানো জল-ভর্তি হাঁড়ির মধ্যে রাখা জিনিসগুলোর মতো ঘুরপাক খায়। তাই আমি যাঁদের প্রশ্নগুলো করতাম তাঁদের মধ্যে অন্তত তিন জন অক্লেশে জানাতে পারেন যে তাঁরা নিজেরাও কখনওসখনও এই রকম মিছিলে হাঁটেন, নইলে নিজের মহল্লায় একটু ‘প্রবলেম’ হতে পারে কিনা।

কী সেই ‘প্রবলেম’? কারা করেন? না, সেগুলো নিয়ে ‘ওঁরা’ও কিছু বলেননি, আমিও কিছু জিজ্ঞেস করিনি। কিন্তু না জিজ্ঞেস করেও বুঝতে পারি যে প্রজ্ঞা সিংহ ঠাকুরের জঘন্য কথাগুলো বৈধতা পায় ওয়াইসি ভাইদের কুৎসিত কথাগুলোর কারণে। আর সাপলুডো খেলা চলতেই থাকে।

সেই খেলা যারা ভাঙতে পারত সেই মিডিয়াও কিন্তু, না দিল্লিতে, না স্থানীয় স্তরে, কোথাওই নিরপেক্ষতার উজ্জ্বল নিদর্শন তুলে ধরতে পারেনি। উল্টে যা করেছে, তা আরও আশ্চর্যের। একই সংস্থার ইংরেজি চ্যানেল দিনের পর দিন প্রাইম টাইমে স্পষ্টভাষী সিপিআই(এম) নেতার ভিডিয়ো ফুটেজ চালিয়ে দেখিয়েছে, বসিরহাটে একটি সম্প্রদায় চরম অত্যাচারিত, তাদের বাড়িঘর, দেবস্থান পুড়ছে; আবার সেই সংস্থারই বাংলা মাধ্যম ক্রমাগত জানিয়ে গিয়েছে যে বসিরহাটে নিশ্ছিদ্র শান্তি বিরাজ করছে। এই দু’রকম খবরের সামনে দাঁড়িয়ে ‘কোনটা সত্যি’ ভেবে, মানুষের বিভ্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক। সেই বিভ্রান্তির সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন জাগে, কী ক্ষতি হত যদি কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় স্তরের মিডিয়ায় এই সত্যটা উঠে আসত যে আফরাজুলকে রাজস্থানে যতটা নৃশংসতায় খুন করা হয়েছিল, ব্যাঙ্কের রিকভারি এজেন্ট পার্থ চক্রবর্তীকেও ডোমজুড়ে খুন করা হয়েছিল ঠিক ততটাই নৃশংসতায়। খুনের ধর্ম থাকে না কোনও, খুন করার কোনও কারণই গ্রাহ্য হতে পারে না। তাই এক কিংবা একাধিক ‘হিন্দু’ নামধারী এক জন মুসলমানকে কোপালে সেটা যতটা নারকীয়, এক জন বা কয়েক জন ‘মুসলিম’ নামধারী এক জন হিন্দুকে কোপালেও সেটা ততটাই নারকীয়।

এ বার, আগে হলে এক রকম ছিল, কিন্তু এখন একটা খবর চেপে গিয়ে বা সাতের পাতার ঈশান কোণে ছেপে অন্যটা প্রথম পাতায় তিন কলম জুড়ে ছাপলে যা হয় তা হল, ওই চাপা পড়ে যাওয়া খবরটা সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে চারগুণ বেশি প্রচার পায় এবং ‘মিডিয়া তো বায়াসড’ ইত্যাদি কথা পল্লবিত হয়ে নেপোর দই খাওয়ার ব্যবস্থা পাকা হয়ে যায়।

একটা উদাহরণই যথেষ্ট। আসানসোলের সংঘর্ষে ওই ফুলের মতো মুসলিম কিশোরের মৃত্যু যতটা বেদনার, প্রতিমা রাউত কিংবা মহেশ মণ্ডলের মৃত্যুও ঠিক ততটাই। প্রথমটার জন্য যেমন এক পুত্রের পিতা প্রতিশোধ নিতে বারণ করেছিলেন, প্রতিমা কিংবা মহেশের বাড়ির কেউও কিন্তু প্রতিশোধ নিতে চাননি কখনও।

এ বার এক জন নিহতের নাম প্রকাশ করে অন্য নিহতদের নাম প্রকাশ না করলে, দ্বিতীয় গোষ্ঠীর মধ্যে ‘আমরা দুর্বল, আমরা অপাঙ্‌ক্তেয় বলে আমাদের জীবনের শুধু নয়, ক্ষমারও কোনও দাম নেই’, এই ক্ষোভটা তৈরি হয়। এবং সেই ক্ষোভের আগুনে রুটি সেঁকে শিল্পাঞ্চলের একটাও বন্ধ কারখানা খুলতে না পারা পাঁচ বছরের ব্যর্থ সাংসদ তিনগুণ বেশি ভোটে জিতে ড্যাংড্যাং করে সংসদে ফেরেন। এ যেন মিত্ররূপে ভজনা করে সাতজন্মে দর্শন পাওয়ার বদলে শত্রুরূপে ভজনা করে তিনজন্মে ঈশ্বর দর্শন!

যদি উল্টোটা হত? যদি ‘প্রেমের জন্য’ মারা যাওয়া রিজওয়ানুরের মতোই রোহিত তাঁতিও সমান এক্সপোজ়ার পেত, তা হলে হয়তো ‘ওরা’ আর ‘আমরা’ বলে ভাবার প্রক্রিয়া পালে এতটা বাতাস পেত না। লোকাল ট্রেনে পাশাপাশি বসে থাকা কাজের মাসিরা এ ওঁর থেকে বিড়ি নিয়ে খান, বুধবারের হাটে রফিকের মাথা থেকে আলুর বস্তা নামিয়ে আনেন সনাতন। সহজে সম্ভব নয় মেরুকরণ ওঁদের মধ্যে। তাই কঠিন কাজটা করেই যায় ‘টুকরে-টুকরে’দের কিছু উকিল। পাকিস্তানের সন্ত্রাসে মৃত ভারতের জওয়ানদের মধ্যেও কত জন রাজপুত, ক’জন যাদব, কে ব্রাহ্মণ, হরিজন কারা, মুসলিমও আছে না কি, সেই ময়না তদন্ত চালিয়েই যায় তারা, যদি দেশের স্পিরিট, খানিকটা হলেও, ভেঙে ফেলা যায়!

এদের প্রতিরোধ করার জন্যই ধর্মনির্বিশেষে প্রতিটা অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দরকার। তা না করে অপরাধের দু’রকম ছবি দু’জায়গায় ফিরি করা চলতে থাকলে, শেষমেশ আম আর ছালা দুটোই যায়। ২০১৯’এর ঘটনাক্রম সেটাই দেখিয়ে গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Monotony Extreme Nationalism Violence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE