দেখতে দেখতে এক মাস পার হয়ে গেল। গত ৭ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসের কাছে, গুটা প্রদেশের দুমা শহরে একটি রাসায়নিক আক্রমণের অভিযোগ নিয়ে কিছু দিন দুনিয়া তোলপাড় হয়েছে। অভিযোগ ছিল, ওই আক্রমণে অন্তত ৭০ জন মারা গিয়েছেন। ওই অঞ্চল থেকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিয়োয় দেখা যায় যে, আক্রান্ত পুরুষ, নারী শিশুদের মুখ থেকে ফেনা বার হচ্ছে। চিকিৎসকদের একটি সংগঠন জানায়, অন্তত ৫০০ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এই হানায়। ওই সংস্থা আরও জানায়, যে অসুস্থদের স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল তাঁদের শরীরে রাসায়নিক বিষে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ দেখা গিয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরাও বলেছেন যে, ওই এলাকায় তীব্র ক্লোরিন গ্যাসের গন্ধ পাওয়া গিয়েছিল। স্থানীয় আরও একটি ভিডিয়ো থেকে দেখা গিয়েছে হলুদ রঙের গ্যাস সিলিন্ডার পড়ে রয়েছে, যা রাসায়নিক হানায় ব্যবহার করা হয়েছিল বলে সন্দেহ। অন্য এক সংস্থার অভিযোগ, সিরিয়ার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে দুমা শহরে ব্যারেল বোমাও ফেলা হয়েছে। সন্দেহ করা হচ্ছে এই বোমাগুলির মধ্যে ক্লোরিন ও সারিন গ্যাস ছিল।
সিরিয়ার নানা অ-সরকারি সংস্থা এবং আমেরিকা-সহ পশ্চিম দুনিয়া এই আক্রমণের জন্য সিরিয়ার সরকার তথা প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকেই দোষী করেছে। যদিও আসাদ সরকার এই আক্রমণের কথা অস্বীকার করেছে। আসাদের পৃষ্ঠপোষক রাশিয়াও বলেছে যে দুমা শহরে কোনও রকম রাসায়নিক আক্রমণ হয়নি। সিরিয়া ও রাশিয়ার পাল্টা অভিযোগ, ওই রাসায়নিক হানার খবর মিথ্যে, ভিডিয়ো ছবিগুলি বানানো। রাশিয়ার পর্যবেক্ষকদের দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে একাধিক বার বলেছে যে, ঘটনাস্থল থেকে কোনও রকম রাসায়নিক ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইট করেছিলেন, এই জঘন্য হানার বড় মূল্য চোকাতে হবে আসাদকে। সেই কথার সূত্র ধরেই ৯ এপ্রিল, আমেরিকা, ফ্রান্স ও ব্রিটেন সম্মিলিত ভাবে সিরিয়ায় বিমান হানা দেয়। তিনটি দেশের তরফে জানানো হয়, মূলত সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রসম্ভার নষ্ট করার জন্যই দামাস্কাস এবং হোমস এলাকায় এই বিমান হানা। রাশিয়া এই যৌথ হানাকে নিন্দা করে। উল্টো দিকে, রাষ্ট্রপুঞ্জে ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত বলেন, সিরিয়ায় মানুষের উপর রাসায়নিক আক্রমণের বিপদ লাঘব করার জন্য এর প্রয়োজন ছিল।
রাসায়নিক হানা সিরিয়ায় নতুন নয়। রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার নিবারণে কর্মরত দি অর্গানাইজ়েশন ফর দ্য প্রহিবিশন অব কেমিক্যাল ওয়েপনস (ওপিসিডব্লিউ)-এর তদন্ত অনুযায়ী আসাদের বিরুদ্ধে তেমন হানার প্রমাণ রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর হিসেবে, ২০১৩ থেকে সিরিয়ায় অন্তত ৮৫ বার রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। গত জানুয়ারিতে দুমা শহরেই রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা জানান স্থানীয় মানুষ। দি আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশন মার্চ মাসের ৭ ও ১১ তারিখে দুমা’য় ছোট দু’টি ক্লোরিন গ্যাস আক্রমণের খবর দিয়েছে।
দুমা শহরটি পূর্ব গুটা অঞ্চলে। এপ্রিল ২০১৩ থেকে এই অঞ্চল আসাদ-বিরোধী জঙ্গিরা দখল করে নেয়। গত ফেব্রুয়ারিতে সিরিয়ার স্থলসেনা (সিরিয়ান অ্যারব আর্মি) আক্রমণ চালিয়ে মার্চ মাসের মধ্যে গুটা অঞ্চলের তিনটি জায়গায় জঙ্গিদের কোণঠাসা করে। এর মধ্যে দু’টি থেকে মার্চের শেষে জঙ্গিদের সরে যেতে বাধ্য করে আসাদের সেনা। কিন্তু দুমা জঙ্গিদের দখলেই থাকে। জয়েশ-আল-ইসলাম জঙ্গিগোষ্ঠী দুমা অঞ্চলের কর্তৃত্ব করছিল। ৩১ মার্চের মধ্যে তাদের দুমা শহর ছেড়ে দিতে বলা হয়। তাতে ফল হয়নি। এর পরেই ৭ এপ্রিল রাসায়নিক হানার অভিযোগ। অভিযোগ সত্য হোক বা না হোক, এর পরেই জঙ্গি কবলিত দুমা অঞ্চল থেকে জঙ্গিরা সরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
১০ এপ্রিল সিরিয়া ও রাশিয়ার সরকার ওপিসিডব্লিউকে ঘটনাটি তদন্তের জন্য অনুরোধ জানায়। তদন্তকারী দল ১৪ এপ্রিল দুমা পৌঁছয়। কিন্তু সিরিয়া ও রাশিয়া সরকার ওই দলকে দুমা শহরে ঢুকতে নিষেধ করে। কারণ দেখায়— ওই দলের নিরাপত্তার দায়িত্ব তারা নিতে পারবে না। ১৭ এপ্রিল তদন্তকারী দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে গেলে তাঁদের ওপর গুলি চালানো হয়। তদন্তকারীরা দামাস্কাস ফিরে যান। শেষ পর্যন্ত ২১ ও ২৫ এপ্রিল দলটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং সেখান থেকে নমুনাও সংগ্রহ করে আনেন। তবে ইতিমধ্যে অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে। আসাদ-বিরোধীদের অভিযোগ, রুশ আধিকারিকরা সিরিয়ার সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাসায়নিক হানার এই ঘটনাটিকে অস্বীকার করছেন, তদন্তকারী দলকে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে না দিয়ে তদন্তে দেরি করাচ্ছেন— ঘটনাস্থল থেকে রাসায়নিক হানায় ব্যবহৃত উপাদানগুলিকে সাফ করে দেওয়া হচ্ছে, যাতে রাসায়নিক ব্যবহারের কোনও প্রমাণ পাওয়া না যায়।
এই ‘রাসায়নিক হানা’ এবং তার জবাবে প্রতি-আক্রমণ আসলে ওই অঞ্চলের জটিল কূটনৈতিক দাবাখেলার একটি চাল, তীব্র উদ্বেগের এক বহিঃপ্রকাশ। কী সেই পরিস্থিতি?
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy