পুনর্দখল: বিধাননগরের ফুটপাত থেকে বেআইনি দোকান উচ্ছেদ চলছে। ছবি: সুমন বল্লভ
সল্ট লেকের সদ্য দখলমুক্ত হওয়া ফুটপাতের ছবি দেখে কলকাতার অন্য পাড়ার বাসিন্দাদের বুক ফেটে একটা সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়তেই পারে। রাস্তা ছেড়ে ফুটপাত দিয়েও যে হাঁটা যায়, শহর কলকাতার বাসিন্দারা সে কথা ভুলতে বসেছেন— অবশ্য, জানার সুযোগ পেয়েছিলেন ক’জন, যে ভুলবেন? আর একটু দূরের পাড়ার খবর কলকাতায় তেমন পৌঁছয় না। নয়তো জানা যেত, বেজিংয়েও চলছে দখলদার দূর করার মহা-অভিযান। ফুটপাতের দখলদার নয়, শহরের— গ্রামগঞ্জ থেকে কাজের আশায় বেজিং-এ চলে আসা মানুষ, শহরের প্রশাসন যাদের এক কথায় নাম দিয়েছে ‘লো এন্ড পপুলেশন’। বাংলায় বললে, ফালতু মানুষ। ‘বিশ্ববাংলায় বিশ্বকাপ’-এর মহাধামাকার আগে যেমন পুলিশ সাফ করে দিয়েছিল যুবভারতীর আশপাশের সব ফালতু মানুষদের। চিনের চেয়ারম্যানের আর আমাদের চেয়ারম্যান হয়ে ওঠা হয়নি, কিন্তু কলকাতা আর বেজিং মিলেমিশে অভিন্ন হয়ে উঠছে বেমালুম।
একেবারে অভিন্ন, এমন দাবি করলে সব্যসাচী দত্তদের প্রতি খানিক অবিচার হবে, সন্দেহ নেই। বেজিং-এর প্রশাসন যখন ‘বহিরাগত’দের ভিড়ে ঠাসাঠাসি বহুতল খালি করে দিচ্ছে কয়েক ঘণ্টার নোটিসে, শহরে তখন হাড়কাঁপানো শীত। অন্য কোথাও আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ নেই— যে গ্রাম থেকে এসেছে, ফিরে যেতে হবে সেখানেই। সল্ট লেকের উচ্ছেদ হওয়া দোকানদাররা, ভরসা রাখি, রাজনীতির কল্যাণে আজ না হোক পরশুর পরের দিন বসার জায়গা পেয়ে যাবেন আশপাশেই কোথাও। অপারেশন সানশাইন সাক্ষী, কলকাতার ফুটপাত খালি থাকে না।
মূল গল্পটা অবশ্য এক। সে গল্প লড়াইয়ের। শহরের ভৌগোলিক পরিসরের দখল রাখার লড়াইয়ের গল্প। গ্রাম আর শহরের মধ্যে বেড়ে চলা অসাম্যের গল্প, সেই অসাম্যের দাঁড়িপাল্লায় দিক বদলাতে চাওয়ার মরিয়া চেষ্টার গল্প। যত ‘উন্নয়ন’ হয়েছে, বাজার যত গভীরে গেঁথেছে শিকড়, গ্রাম আর শহরের মধ্যে ফারাকও ততই বেড়েছে। সমৃদ্ধির ফারাক, সুযোগেরও। গ্রাম থেকে, মফস্সল থেকে— পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে ছোট শহর থেকেও— বড় শহরে চলে আসতে পারলেই খুলে যায় সুযোগের অনেকগুলো দরজা। যে প্রজন্মের মানুষ অভিবাসী হয়, তার পরের প্রজন্মের কাছে সুযোগ আরও বাড়ে। ক্রমে, তাঁরাও শহরের জনগোষ্ঠীর অংশ হয়ে যান, সমৃদ্ধির গল্পের অন্তত ছোট তরফের শরিক।
মুশকিল হল, শহরের জায়গা সীমিত। বহিরাগতরা এসে সেই সীমিত জায়গায় ভাগ বসালে সমস্যা অনেক। ফুটপাতে হাঁটার জায়গা থাকে না, বিদেশি অতিথিদের চোখে পড়ে কুৎসিত ঝুপড়ি, ভিড় বাড়ে বাসে-ট্রেনে, ভাগ বসে নাগরিক পরিষেবায়। ‘ফালতু মানুষ’-দের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করতে থাকতেও হয়তো— হয়তো কেন, নিশ্চিত ভাবেই— খারাপ লাগে। আর, এখানেই রচিত হয় যুদ্ধক্ষেত্র। শহরের ভূমিপুত্ররা, অথবা যাঁদের পূর্বপ্রজন্ম গ্রাম থেকে এসে জায়গা করে নিয়েছিলেন শহরে, ঘোর আপত্তি করতে থাকেন এই জবরদখলে; আর বাইরে থেকে আসা মানুষের দলও নাছোড় জেদে দখল করে রাখেন ফুটপাত অথবা খালপাড়ের জমি।
সুযোগের সন্ধানে কেন গ্রাম থেকে শহরে আসতেই হয়, কেন সত্তর বছরের স্বাধীনতা গ্রামেও সমৃদ্ধির পথ তৈরি করে দিতে পারল না, এই প্রশ্নগুলো করাই যায়। হকারের হাতে বেদখল হয়ে যাওয়া ফুটপাতে পা ফেলার ফাঁক না পেয়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হওয়া নাগরিকরা হামেহাল করেও থাকেন প্রশ্নগুলো। কিন্তু, আপাতত প্রশ্নের অভিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়া যাক। অসীম বিরক্তি নিয়ে ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় নামা শহরের বাসিন্দাদের— অল্প কথায় বললে, আমাদের— প্রশ্ন করা যাক, এত বিরক্তি কেন? ঠিক কী কারণে শহরের পরিসরের ওপর বহিরাগতদের তুলনায় ভূমিপুত্রদের অধিকার বেশি? বাসন্তী থেকে আসা রাখাল মণ্ডলের চেয়ে গড়িয়াহাটের ফুটপাতের ওপর বালিগঞ্জের রাহুল মুখোপাধ্যায়ের দাবি বেশি হবে কোন যুক্তিতে? প্রশ্নটা আরও একটু স্পষ্ট করে দেওয়া যাক। নিজের বাড়ির পরিসরের ওপর অধিকার বিলক্ষণ থাকবে, সেটা ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকারের প্রশ্ন। কিন্তু, শহরের পরিসরটা তো কারও ব্যক্তিগত নয়। তা হলে, সেই পরিসরের ওপর এমন অধিকার কোথা থেকে আসে, যাতে অন্যদের সেই পরিসরের ভাগ না দেওয়ার দাবিকে ন্যায্য বলে মনে হতে পারে?
যুক্তিটা এতই সোজাসাপটা যে আলাদা করে সেটা জানতে চাওয়াই অস্বাভাবিক ঠেকতে পারে। কলকাতা শহরটার ওপর সেখানকার বাসিন্দাদের দাবি অন্যদের চেয়ে বেশি হবে না? এই অধিকারবোধ এমনই স্বতঃসিদ্ধ যে পরের প্রশ্নটাই করা মুশকিল। কিন্তু, করে ফেলা যাক— লটারির পুরস্কারের ওপর কি কারও দাবি থাকতে পারে? সেটা নেহাতই ভাগ্য— বঙ্গলক্ষ্মী বাম্পারের ফার্স্ট প্রাইজ পাওয়ার পর যদি কেউ বলেন, ‘আমি যোগ্য বলেই পেয়েছি’, বা, ‘এই প্রাইজ পাওয়াটা আমার অধিকার, আমাকে ছাড়া আর কাউকে কখনও এই প্রাইজ দেওয়া যাবে না’, লোকে পাগল বলবে। কলকাতায়, বা বেজিং-এ, অথবা দুনিয়ার অন্য কোনও বড় শহরে, জন্মানোটা নেহাতই লটারি পাওয়ার মতো। মুকেশ অম্বানীর ঘরে না জন্মে হরিপদ কেরানির সন্তান হওয়ার মতোই ভাগ্যের খেল। আমার পূর্বপুরুষ কোনও এক শহরের বাসিন্দা ছিলেন বলেই অন্যদের তুলনায় সেই শহরের পরিসরের ওপর, এবং সেই পরিসর থেকে তৈরি হওয়া সমৃদ্ধি, সুযোগের ওপর আমার দাবি বেশি— বা, আমারই দাবি আছে, অন্যদের নেই— এই ধারণার শেষ অবধি গেলেও ন্যায্যতার যুক্তি খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
প্রশ্ন উঠতে পারে, শহর নামক পরিসরটা তো নিজের গুণে সমৃদ্ধ আর সুযোগের ঠিকানা হয়ে ওঠেনি, হয়েছে শহরবাসীদের পরিশ্রমে, উদ্যোগে। তা হলে সেই পরিসরে বহিরাগতদের তুলনায় শহরের আদি বাসিন্দাদের অধিকার বেশি হবে না কেন? এই প্রশ্নের একটা নয়, দুটো উত্তর রয়েছে। এক, যাঁদের উদ্যোগের ফলে শহর ক্রমে সুযোগের জায়গা হয়ে উঠেছে, তাঁরাও কিন্তু গোড়াতে শহরের সেই সুযোগটাই পেয়েছিলেন। উদ্যোগ তাঁদের ছিল ঠিকই, কিন্তু সুযোগ পাওয়ার ভাগ্যও ছিল। দ্বিতীয়ত, সত্যি যদি বাপ-ঠাকুরদার কৃতিত্ব থাকেও শহরের সমৃদ্ধিতে, পরবর্তী প্রজন্মের তো নেই। জন্মের সময় তো বাসন্তী আর গড়িয়াহাটের শিশুর মধ্যে কৃতিত্বের ফারাক নেই। শুধু শহরে জন্মেছি বলেই সুযোগের উত্তরাধিকার দাবি করব, এটা ন্যায্য ব্যবস্থা হতে পারে না। উত্তরাধিকারের মধ্যে কোনও ন্যায্যতা নেই। সম্পত্তির উত্তরাধিকারেও নয়, ভৌগোলিক উত্তরাধিকারেও নয়।
‘ন্যায্য ব্যবস্থা’ তা হলে কী? বিশ শতকের সর্বাগ্রগণ্য দার্শনিকদের কথা ভাবলে যাঁর নাম আসবেই, সেই জন রল্স তাঁর ‘আ থিয়োরি অব জাস্টিস’-এ সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। সেই তত্ত্বে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, কিন্তু তার সূত্রটা ব্যবহার করা যেতেই পারে। তার জন্য নিজের ঠিকানা ভুলতে হবে খানিকক্ষণের জন্য। প্রত্যেককে। লটারির টিকিট কাটার পর, কিন্তু খেলা আরম্ভ হওয়ার আগে, প্রত্যেকে যে অবস্থায় থাকেন, মনে মনে নিজেকে সেখানে নিয়ে যেতে হবে। প্রত্যেকের হাতে একটা লটারির টিকিট— নিছক ভাগ্যের খেলায় স্থির হবে, কে থাকার সুযোগ পাবেন কলকাতায়, আর কাকে যেতে হবে ছিটমহলে, মরিচঝাঁপিতে, দণ্ডকারণ্যে। এই অনিশ্চয়তায় নিজেকে দাঁড় করাতে পারলেই চোখে পড়বে একটা বিকল্প— লটারিই যদি হয়, তা যেন পাকাপাকি না হয়। একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর যেন ফের সুযোগ আগে ঠিকানা পালটে নেওয়ার। এক বার ছিটমহলে ঠাঁই হলেও যেন পরের দফায় সুযোগ থাকে কলকাতায় ঠিকানা পাওয়ার। এবং, কারও বিরক্তি সহ্য করে নয়, গলাধাক্কা খেয়ে নয়। সবার যেন সমান সম্ভাবনা থাকে সুযোগের ভাগিদার হওয়ার।
এই লটারি অবশ্য কল্পনা থেকে বাস্তবে নেমে আসতে পারে না। তার প্রয়োজনও নেই। কাল্পনিক লটারির শিক্ষাটাকে মেনে নিতে পারলেই যথেষ্ট। শহরের ঠিকানার সুযোগটা যে নেহাতই পড়ে পাওয়া, এবং তার ওপর অন্যদের বাদ দিয়ে ভোগদখলের অধিকার থাকতে পারে না, এই কথাটা স্বীকার করে নিলেই হবে। তা হলেই দেখবেন, শহরের মেয়র যখন ‘ফুটপাত শুধু হাঁটার জন্য’ বলে দাবি করবেন, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপ্রশ্ন করতে ইচ্ছে করবে— ‘কার হাঁটার জন্য’? হাঁটার অধিকারের চেয়ে বেঁচে থাকার অধিকার বেশি জরুরি কি না, ভাবতে সমস্যা হবে না।
ভাগ্যের কথাটা মনে রাখা অবশ্য কঠিন। যা পাওয়া হয়ে যায়, আমরা বিশ্বাস করে ফেলি, সেটা আমাদের প্রাপ্যই ছিল। অহৈতুকী প্রাপ্তিতে কৃতজ্ঞ থাকা, আর অন্য কারও জন্য সেই প্রাপ্তির দরজা খুলে দেওয়া মানুষের ধাতে নেই। তবে, নিজের সঙ্গে লড়তে শেখার নামই তো রাজনীতি। না হয় একটু রাজনীতিমনস্ক হলামই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy