Advertisement
E-Paper

কে আমায় খণ্ডাসুর বানাল

পুলওয়ামায় যে সব আধা সেনা যুবা তরুণরা বেঘোরে প্রাণ দিলেন, তাঁদের অঙ্কও এমনটাই। নিজেদেরই অজান্তে তাঁরা এক বিরাট শত্রুমণ্ডল বানিয়ে ফেলেছেন। অচেনা অদেখা শত্রুদল, যাদের সঙ্গে শত্রুতার কারণটাও তেমন পরিষ্কার নয়।  

বিমল লামা

শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৯ ০১:৫০
উদ্বুদ্ধ: পুলওয়ামায় সন্ত্রাসী হানার প্রতিবাদে পাকিস্তানের পতাকা পোড়ানো। বিকানের, রাজস্থান, ফেব্রুয়ারি ২০১৯। পিটিআই

উদ্বুদ্ধ: পুলওয়ামায় সন্ত্রাসী হানার প্রতিবাদে পাকিস্তানের পতাকা পোড়ানো। বিকানের, রাজস্থান, ফেব্রুয়ারি ২০১৯। পিটিআই

সেনা জওয়ান দেশের রক্ষক। জান দিয়ে তাঁরা দেশ ও দেশবাসীকে রক্ষা করেন। সেই জন্যই আবার তাঁরা লক্ষ্য হয়ে পড়েন শত্রু পক্ষের। অর্থাৎ দেশ ও দেশবাসীকে সুরক্ষা প্রদান করতে গিয়ে তাঁরা নিজেরাই

বিরাট শত্রুদল তৈরি করে ফেলেন। সে শত্রু হতে পারে কোনও বিরোধী ভাবনার ব্যক্তি। হতে পারে কোনও সংগঠন। সংস্থা। হতে পারে সমগ্র একটি রাষ্ট্র, অথবা রাষ্ট্রগোষ্ঠী।

পুলওয়ামায় যে সব আধা সেনা যুবা তরুণরা বেঘোরে প্রাণ দিলেন, তাঁদের অঙ্কও এমনটাই। নিজেদেরই অজান্তে তাঁরা এক বিরাট শত্রুমণ্ডল বানিয়ে ফেলেছেন। অচেনা অদেখা শত্রুদল, যাদের সঙ্গে শত্রুতার কারণটাও তেমন পরিষ্কার নয়।

সে যা-ই হোক, বাস্তবে আঘাত অতীব মর্মান্তিক। বিশেষত এই বারের আঘাতটা যেন একটু বেশিই বেজেছে দেশবাসীর বুকে। যে চল্লিশ জন নিহত হলেন, শোক শুধু তাঁদের পরিবারের গণ্ডিতে আটকে নেই। ছড়িয়ে পড়েছে দেশ জুড়ে। সকলে শোকার্ত। আর সেই সঙ্গে ‘বদলা’ নেওয়ার তাড়নায় আশ্চর্য এক অস্থিরতা চেপে বসেছে মগজে মেজাজে।

আঘাত পেলে প্রত্যাঘাতে উদ্যোগী হওয়াই জৈবিক প্রবৃত্তি। আমরাও তাই হয়েছি। মাথাটাও এতটা ঠান্ডা হচ্ছে না যে বিচার করতে বসব প্রবৃত্তির পথে যাব, না কি যুক্তির পথে? সে আমার মাথার দোষও হতে পারে। হতে পারে মনের দোষও। মন মাথা ঠিক রেখে কিছু করা এই সময়ে সত্যিই অতিমানবিক কাণ্ড।

আমি না পারি, অন্য কেউ তো পারেন। যেমন পেরেছেন সেই শহিদ হওয়া সেনা জওয়ানদেরই এক জনের কাছের মানুষটি। জওয়ান বাবলু সাঁতরার স্ত্রী। তিনি তাঁর জৈবিক প্রবৃত্তির ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার চোখে দেখেছেন বিষয়টাকে, আর পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন জগতের শাশ্বত সত্যকে— যুদ্ধ কোনও সমাধান নয়। সে নিজেই একটা সমস্যা। সমস্যা দিয়ে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা মূঢ়তা ছাড়া আর কিছু না।

সুস্থ বুদ্ধির সব মানুষই বোঝেন সে কথা। কিন্তু পরিস্থিতির পাকেচক্রে বুদ্ধির সুস্থতা ধরেও রাখা যায় না কখনওসখনও। তখন মনে হয় ঝাঁপিয়ে পড়ি শত্রুর ওপর, সেই আত্মঘাতী জঙ্গিটার মতোই। বাস্তবে তারও তো বুদ্ধির সুস্থতা নষ্ট হয়েছিল। নষ্ট করে দিয়েছিল কেউ বা কারা। নষ্ট করেছিল ঠিক ভুল ন্যায় অন্যায় বোধ।। বিশ্বাস।

এক কথায়, এক ধরনের মগজধোলাই হয়েছিল ওই যুবকের, যার ফলে সাধারণ এক নাগরিক থেকে সে হয়ে উঠেছিল এক জঙ্গি। আমরা কি ঘরে বসে অনুমান করতে পারব ঠিক কতটা মগজধোলাই হলে এক জন আত্মঘাতী জঙ্গি হতে চায়?

নিজেকে দিয়ে বিচার করার চেষ্টা করি। ভাবি, আমাকে কি কেউ কোনও ব্যাপারে এতটা উদ্বুদ্ধ করতে পারবে, যার কথাতে আমি নিজের প্রাণ দিয়ে অন্যের অনিষ্ট সাধন করব! এই যে আমার মধ্যে ‘বদলা’ নেওয়ার এক অদম্য অস্থিরতা জেগেছে, বাস্তবে এ-ও কি সেই ধরনেরই কোনও বস্তু নয়, যা আমার অজান্তে আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে? আমি কি আগাগোড়াই এতটা যুদ্ধবাজ ছিলাম, যতটা আজ নিজেকে মনে মনে অনুভব করছি? আর যুদ্ধ যদি সত্যিই লাগে, আর আমাকে ডাকা হয় যুদ্ধে শামিল হওয়ার জন্য, আমি কি যাব যোগ দিতে?

হয়তো যাব। কারণ আমি গায়েগতরে যা-ই হই, মনে-মগজে ততটাই উদ্বুদ্ধ হয়ে আছি, যতটা উদ্বুদ্ধ ছিল সেই আত্মঘাতী জঙ্গি। সে প্রাণ দিয়ে প্রাণ নিয়েছে তার ‘আদর্শ’-এর জন্য, আমি প্রাণ দিয়ে প্রাণ নেব আমার আদর্শের জন্য।

অথবা এক্ষুনি আমি অতটা পারব না। আমার প্রক্রিয়াকরণে এখনও কিছুটা অসম্পূর্ণতা থেকে গিয়েছে। কিন্তু মনে হয় অন্যদের অনেকেই প্রস্তুত হয়ে আছে। কারণ তারা এ ব্যাপারে আমার চেয়ে অনেক এগিয়ে। আমার মতো চিন্তার পাহাড় মাথায় করে তারা ঘরে বসে নেই। তাদের মতো করে তাদের পরিসরে তারা সম্ভাব্য সব রকম সক্রিয়তাই দেখিয়েছে। ইউটিউবের খোপে খোপে দেখা যাচ্ছে তাদের মুখ মাথা কব্জি পাঞ্জা।

কেউ কি তবে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে ভেতরে ভেতরে। আড়ালে গোপনে! না কি তাদের মাথা খাচ্ছে এই সমকাল? কালের ভাবগতিক, হাওয়ামুখ...। সে সব থেকে সে নিজেই উদ্বুদ্ধ করছে নিজেকে। নিজের দৃষ্টি বেঁধে নিচ্ছে নির্দিষ্ট পাখির চোখের দিকে। পাখির চোখ ছাড়া সে আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। পাখির বহুবর্ণ পালকের একটা বর্ণও সে দেখতে পাচ্ছে না। এমনকি সে দেখতে পাছে না নিজের অস্ত্রের দোষত্রুটি। দেখতে পাচ্ছে না তার পরিণাম।

একে আমরা কী বলব? একাগ্রতা? না কি অন্ধত্ব? অথবা একাগ্র অন্ধত্ব? কিংবা অন্ধ একাগ্রতা?

যা-ই বলি, বিষয়টা যে আসলে খণ্ডিত, তা সহজেই বোঝা যায়। এই খণ্ডিত দৃষ্টি নিয়ে যে দিকেই তাকাব, খণ্ডিতই দেখব সব কিছু। সামগ্রিকতায় কোনও দিনই ধরতে পারব না কোনও কিছুকে। না আমার এই দেশকে, না দেশের প্রতি প্রেমকে। সর্বোপরি অখণ্ড আকারে ধরতে পারব না বিশ্বব্যাপী এই মানবতাকে। কখনও আর দেখতে পাব না একটা গোটা মানুষকে। খণ্ড খণ্ড করে দেখব তার টুপি জামা তসবি মালা বেশবাস কেশ কড়া চন্দন মুণ্ডন প্রহরণ... আসলে তো আমি নিজেই খণ্ডিত করেছি নিজেকে সর্বাগ্রে। এখন আমি এক খণ্ডাসুর। খণ্ডিত করার নেশায় বুঁদ হয়ে কানামাছির মতো ঘুরে মরছি সর্বনাশের আগুন ঘিরে।

কে বানাল আমাকে এমন খণ্ডাসুর! বিগত ক’টা বছরে কী ঘটে গেল, যাতে আমার এমন রূপান্তরণ ঘটল অন্তর্জগতে! হীরকরাজার মগজধোলাই যন্ত্রে তো কেউ আমায় ঢুকিয়ে দেয়নি। তবে?

আসলে বোধ হয় আমি যন্ত্রে ঢোকাটা বুঝতে পারিনি। কারণ অন্য কৌশল নেওয়া হয়েছে। আমাকে যন্ত্রে না ঢুকিয়ে যন্ত্রটাকেই ধীরে ধীরে নির্মাণ করা হয়েছে আমার চার পাশ ঘিরে। এই সমাজটাকেই রূপান্তরিত করা হয়েছে এক মগজধোলাই যন্ত্রে। যাতে এই সমাজের বাসিন্দামাত্রেরই মগজধোলাই হয়ে যায়।

হচ্ছেও। হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। না হলে এ সব হচ্ছে কেন, যা এত দিন হয়নি। কেন আমি ভেতরে ভেতরে হয়ে উঠছি এক বিকারগ্রস্ত যুদ্ধবাজ? সওয়াল করছি হিংসার পক্ষে, হত্যার পক্ষে, ধ্বংসের পক্ষে। উদয়ন মাস্টারের মতো হয়তো কেউ পালিয়ে বেঁচেছে। লুকিয়ে আছে কোনও গুহাকন্দরে। এক দিন বেরিয়ে আসবে মুক্তির দূতের মতো। হাঁক দিয়ে বলবে, দড়িটা ধরো কষে। স্লোগান তুলবে বজ্রস্বরে: দড়ি ধরে মারো টান...

Violence Kashmiri Pulwama Terror Attack
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy