ছবি- আনন্দবাজার আর্কাইভ।
প্রধান বিচারপতি জানাইয়াছেন, সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব অগ্রাধিকার আছে। রাম জন্মভূমি মামলার শুনানি যথাক্রমেই হইবে। মামলাটি তো নিছক দেওয়ানি, জমি সংক্রান্ত বিবাদ— বস্তুত বিজেপিই বারংবার কথাটি বলিয়াছে— অতএব উত্তরপ্রদেশ সরকারের আর্জি মানিয়া সেই মামলাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা আদালত বিবেচনা করে নাই। অগ্রাধিকার কাহাকে বলে? অভিধান বলিবে, তাহা সর্বপ্রথম বিবেচিত হইবার অধিকার। অন্য সব প্রশ্নের তুলনায় যাহার গুরুত্ব অধিক, তাহাই অগ্রাধিকার পাইবার যোগ্য। প্রধান বিচারপতির মন্তব্যে স্পষ্ট, সরকার অথবা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সহিত আদালতের বিবেচনায় পার্থক্য বর্তমান— আদালত বোধ করে যে অযোধ্যার জমির মালিকানা কাহার, তাহার অধিক গুরুত্বপূর্ণ (বহু) বিষয় আদালতের নিকট আছে। সাধারণ বুদ্ধিও সেই কথাই বলিবে। দেশ ও দুনিয়া জুড়িয়া এত বিচিত্র সমস্যার পাহাড় থাকিতে অযোধ্যায় রামলালার মন্দির নির্মাণ লইয়া মাথা ঘামাইতে হইবে কেন, তাহা সাধারণ বুদ্ধির বাহিরে।
কিন্তু সঙ্ঘ পরিবারের বুদ্ধি অ-সাধারণ, মগনলাল মেঘরাজ বলিতেন— একস্ট্রাআর্ডিনারি। সেই বুদ্ধি বলে, রাম মন্দির বানানো এখন ভারতের শাসক দল ও তাহার সর্বশক্তিমান সর্বাধিনায়কের সর্বাপেক্ষা আবশ্যক কর্তব্য। বস্তুত রাম মন্দিরই এখন তাঁহাদের প্রথম ও প্রধান অগ্রাধিকার। তাহার কারণ, বাকি সব কাজই সারা হইয়া গিয়াছে। যেমন, ধরা যাউক, বিদেশ নীতির প্রশ্ন। সিয়াচেনে সৈনিকরা লড়িতেছে, অতএব প্রতিবেশী হউক বা দূরবর্তী, সব দেশের সহিতই ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক চূড়ান্ত ইতিবাচক স্তরে। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন মুখঝামটা দিক, অথবা শ্রীলঙ্কায় চিন আরও বেশি ক্ষমতাবান হইয়া উঠুক, প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের প্রায় সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সহিত আলিঙ্গন সারিয়া ফেলিয়াছেন। আর কী চাই? তাহার উপর, ইমরান খানের আলোচনার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করিয়া পাকিস্তানকে সবক্ও শেখানো হইয়া গিয়াছে। অর্থনীতির সংবাদ আরও ভাল। ডিমনিটাইজ়েশন এবং জিএসটি-র জোড়া সাফল্যের পর ভারতীয় অর্থনীতি টগবগাইয়া ছুটিতেছে, ডলারের দাম তলানিতে, পেট্রোলিয়াম জল অপেক্ষা সস্তা। শিল্পে বিনিয়োগের বান ডাকিয়াছে, শেয়ার বাজার আকাশ ফুঁড়িয়া ফেলিতেছে। কৃষকরা অভাবনীয় সহায়ক মূল্য পাইয়া আহ্লাদে আটখানা, এনআরইজিএ-তে এত টাকা আসিতেছে যে কাজ করিবার লোক খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না। কাশ্মীর শান্ত, আরও শান্ত গৈরিকবাহিনী। এমন অবস্থায়, সরকারের বা প্রধানমন্ত্রীর আর কী-ই বা করিবার থাকে? ফলে, অগ্রাধিকারের দাবিদার হিসাবে পড়িয়া আছে কয়টি মাত্র প্রশ্ন। যেমন, দেশবাসীকে যোগব্যায়ামের পাঠ দেওয়া, এবং অতি অবশ্যই, মন্দির নির্মাণ।
কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট? অমিত শাহ বলিয়াই দিয়াছেন, যে রায় পালন করা সম্ভব, আদালতের তেমন রায়ই দেওয়া উচিত। আজ না হউক পরশুর পরের দিন তিনি বলিতেই পারেন, যে সিদ্ধান্তের ফলে রামলালা রাস্তায় পড়িয়া থাকিবেন, তেমন সিদ্ধান্ত করা সুপ্রিম কোর্টের উচিত হয় নাই। একে তাঁহাদের হাতে বাহুবলীর সংখ্যা অজস্র, তায় সংসদে তাঁহারা সংখ্যাগুরু। কাজেই, কোর্ট যাহাই বলুক, সরকারকে নিজের অগ্রাধিকার বুঝিয়াই চলিতে হইবে। আইন পাশ করাইয়াই হউক বা অধ্যাদেশ জারি করিয়া, অযোধ্যার জমির দখল লওয়া চাই। একটি প্রশ্ন থাকিয়া যাইবে: গত সাড়ে চার বৎসরে এই আইন পাশ করাইবার কথা স্মরণে আসে নাই কেন? ভোট দূরে ছিল বলিয়া? বিরোধীরা তেমনই বলিতেছেন। মনে করাইয়া দিতেছেন, ভোট আসিলেই বিজেপি অযোধ্যা প্রশ্নে মেরুকরণের চেষ্টা করিয়া থাকে। কিন্তু সেই কথায় কান দিতে নাই। দুই কান কাটা হইলে কান দিবার প্রশ্নও নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy