আবার মহাভারতে রয়েছে অন্য ব্যাখ্যা। মৃত্যুর পর কর্ণের আত্মা পরলোকগমন করার পর তাঁকে খাবার হিসেবে সোনা ও রত্ন দেওয়া হয়। কর্ণ দেবরাজ ইন্দ্রকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করায় ইন্দ্র জানান যে, দানবীর কর্ণ জীবনভর সোনা ও রত্ন দান করেছেন, কিন্তু পুর্বপুরুষের উদ্দেশে কখনও খাবার বা জল দান করেননি। তাই স্বর্গে খাদ্য হিসেবে তাঁকে সোনাই দেওয়া হয়েছে। তখন কর্ণ জানান, যেহেতু নিজের পিতৃপুরুষ সম্পর্কে তিনি বেশি কিছু জানতেন না, তাই ইচ্ছাকৃত ভাবেই তাঁদের উদ্দেশে খাদ্যবস্তু দান করেননি। এই কারণে ইন্দ্র কর্ণকে ১৬ দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জলদানের অনুমতি দেন। তার পর থেকেই নাকি এই পক্ষ ‘পিতৃপক্ষ’ নামে পরিচিত হয়। তাি মহালয়ার ভোরে গঙ্গা বা নদীর ধারে তর্পণে ব্যস্ত পুরুষের ভিড় দেখা যায়।
এ সবই পুরনো দিনের ব্যাখ্যা। এখন তর্পণে দেখা যায় মহিলাদেরও। ঘটনাটি বিরল হলেও গত কয়েক বছর ধরে তর্পণে শামিল হতে দেখা গিয়েছে বহু মেয়েকেও। কিন্তু কেন মেয়েদের সঙ্গে তর্পণের সম্পর্ক প্রচলিত নয়? এই প্রশ্নে বারবার ফিরে আসে কয়েকটি ঘটনা। যে দেশে বহু মেয়ের জন্মানোর অধিকারই জোটে না, জন্মালেও গরম দুধে ডুবিয়ে মেরে ফেলা হয়, যাতে দেবতা তুষ্ট হয় সংসারে ছেলে পাঠান, সেই সমাজে নাকি আবার তর্পণ করবেন মহিলারা!
ছোট থেকে বাবাকে দেখেছি তর্পণ করতে। না, মা কোনও দিন করেননি। তবে মা-ই শিখিয়েছিলেন, তর্পণ হল পূর্বসূরিদের শ্রদ্ধা জানানোর একটা রীতি। তবে, শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও যে লিঙ্গের ভেদাভেদ থাকে, সেটা সময় শিখিয়েছে। মহালয়ার সকালে পূর্বপুরুষের উদ্দেশে পরিবারের ছেলেরা জল দান করেন। তাতে বিশেষ স্থান নেই বাড়ির মা, মেয়ে ও বউয়ের। এবং এই তর্পণে তাঁদের জায়গা থাকা বা না থাকা যে নিতান্তই পারিবারিক রাজনীতির কারণে, তা বুঝতে হয়তো আরও সময় লাগবে এই সমাজের!
শাস্ত্রে কোথাও মেয়েদের একা তর্পণ করার অধিকারই দেওয়া নেই, এমন জানিয়েছেন পুরাণ-গবেষকদের একটি অংশ। তাঁদের কথায়, কারও যদি পুত্রসন্তান না থাকে, তাঁরা মুক্তি পাবেন না। তবে মেয়েরা তর্পণের আধিকারী নয়। পুরাণ-গবেষকদের কথায়, কোনও বিবাহিতা মহিলা স্বামীর তর্পণের সঙ্গী হতে পারেন মাত্র। এর বাইরে মেয়েদের তর্পণের অধিকার নেই। তবে সমাজ চাইলে সব পরিবর্তনই সম্ভব, ধারণা অনেকের। বদলাতে পারে শাস্ত্রও, দাবি পুরাণ-গবেষকদের একটি অংশের।
কিন্তু আমাদের ধর্মশাস্ত্র তো সংখ্যায় অনেক। সব শাস্ত্রেই কি একই নিয়ম? এখন কি তবে শাস্ত্রের বিধি ভেঙেই মেয়েরা তর্পণে যোগ দেন?
গত তিন বছর ধরে তর্পণ করছেন এমন এক বিবাহিত কন্যাসন্তানের মন্তব্য, ‘‘শাস্ত্র তৈরি হয়েছে কাল ও স্থানের প্রয়োজনের নিরিখে। আমার গোত্রান্তর হয়েছে ঠিকই, মনান্তর তো হয়নি। বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক আত্মার সঙ্গে, মনের সঙ্গে। গোত্র বদলে গেলে কি সব বদলে যায়!’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘বাবা-মায়ের আমি এক মাত্র সন্তান। আমি তর্পণ করার অধিকার কেন পাব না! কোন নিয়মে পাব না?’’
এ বিষয়ে এক প্রবীণ গবেষক বলছেন, ‘‘বৈদিক যুগে মেয়েদের উপরে এত কড়াকড়ি ছিল না। মহাভারতেও মেয়েদের তর্পণের নিদর্শন রয়েছে। স্মৃতিযুগ থেকেই ধীরে ধীরে বদলেছে মেয়েদের প্রতি সামাজিক আচরণ।’’ মহাভারতে স্ত্রী-পর্বে কৌরব রমণীদের তর্পণ করার বিশেষ উল্লেখ রয়েছে। পরে শাস্ত্র যত কড়া হয়েছে, সেই সঙ্গে মেয়েরা একে একে সামাজিক অধিকার হারিয়েছে বলেও ওই গবেষকের অভিমত।
মোদ্দা কথা, প্রিয়জনেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর ইচ্ছেটুকুও বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক পুরাণ-গবেষকের বক্তব্য, কোথাও লেখা নেই যে, মেয়েরা তর্পণ করতে পারবেন না। শ্রাদ্ধে যেমন শ্রদ্ধা জানানো হয়, তর্পণও তা-ই। মেয়েরা শ্রাদ্ধ করতে পারলে তর্পণ করবেন না কেন? সমাজ গবেষকদের অনেকে আবার মনে করেন, মেয়েরা যাতে বাবার সম্পতির উপর কোনও দাবি না করতে পারে, সেই কারণেও নতুন নতুন নিয়ম তৈরি করা হয়েছে।
অধিকার-অনধিকারের মধ্যে যেটা প্রাসঙ্গিক, তা হল, বিষয়টা মেয়েদের সম্মানের কথা। যেখানে এখনও কন্যাভ্রূণ হত্যা রোখা যায়নি, যেখানে ধর্ষণের নামে চলে রাজনীতি, সেখানে মেয়েরা প্রিয়জনকে স্মরণ করতে গেলে যে সামাজিক রোষের মুখে পড়বেন, তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে! নারীশক্তির আরাধনা ঘিরেও চলে রাজনীতি আর সমাজনীতির নিত্যনতুন খেলা! তবু, ঘটনা হল, মহালয়ার তর্পণ পেরিয়ে আসে দেবীপক্ষই।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)