Advertisement
E-Paper

অবিশ্বাসটাকে দূরে সরিয়ে রাখা

‘প্রধানমন্ত্রী হলে মোদী নিশ্চয় ২০০২-এ যা হয়েছে, তা আর হতে দেবেন না, হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী হবেন না।’ এটাই বিশ্বাস করতে চাইছেন বহু মানুষ। লিখছেন তাজুদ্দিন আহমেদ।সাধারণ নির্বাচনের কয়েকটি দফা সম্পন্ন হয়েছে, কয়েকটি বাকি। নরেন্দ্র মোদী ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হবেন কি না তা বোঝার জন্য ফল ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৪ ০০:০০

সাধারণ নির্বাচনের কয়েকটি দফা সম্পন্ন হয়েছে, কয়েকটি বাকি। নরেন্দ্র মোদী ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হবেন কি না তা বোঝার জন্য ফল ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। তত্‌সত্ত্বেও মোদীর সদর্প ভবিষ্যত্‌ পরিকল্পনা, মেঘের আড়ালে থাকা যোদ্ধার মতো আর এস এস-এর তত্‌পরতা, সংবাদমাধ্যমগুলিতে মোদীকে নিয়ে উদ্দীপনা লক্ষ করলে মনে হতেই পারে যে, নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে বুঝি সংশয় বা সন্দেহের অবকাশ নেই। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস-সহ বর্তমানে দেশের ক্ষমতায় থাকা ইউপিএ জোটের অন্যান্য দলগুলি এই ধারণার বিরোধিতা করার যথাসাধ্য চেষ্টা চালালেও তাদের স্বর অনেকটাই স্তিমিত। অন্তত সংবাদমাধ্যমগুলি থেকে সে রকম একটা চিত্র উঠে আসছে। অথচ নির্বাচনের দামামা বেজে ওঠার পর, অন্তত প্রথম দিকে, প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর সর্বজনগ্রহীতা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ও সন্দেহ ছিল। সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের সাদামাটা কথাবার্তা কান পেতে শুনলে সেই সন্দেহের আঁচ পাওয়া যেত, গণমাধ্যমগুলিতে বিতর্কের পরিসরেও ঘিরে কিছু অবিশ্বাস, কিছু সংশয় উঠে আসত।

এই সংশয় এবং অবিশ্বাসের মূলত দু’টি ভরকেন্দ্র, যা সম্পর্কে দেশের সচেতন নাগরিকের বড় অংশই ওয়াকিবহাল। প্রথমটি অবশ্যই মোদীর সাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি। গোধরা-পরবর্তী দাঙ্গার ক্ষেত্রে এস আই টি তাঁকে ছাড় দিলেও মুসলিম-বিরোধী হিসেবে মোদীর পরিচিতি সহজে মুছে যাওয়ার ছিল না। দেশের বহু মানুষ হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের আত্মিক নৈকট্যে বিশ্বাস রাখেন, তাঁদের পক্ষে মোদীকে বিশ্বাস করা সহজ নয়।

দ্বিতীয় সংশয় মোদীর উন্নয়নের মডেল নিয়ে। সত্যিই কি গুজরাত মোদীর নেওয়া পথে ব্যাপক উন্নতি করেছে, না কি নগরকেন্দ্রিক উন্নয়নের পরশ পায়নি সে রাজ্যের বৃহদংশ মানুষ? বিশ্বব্যাপী বাজার অর্থনীতির রমরমার যুগে কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের ধারণাই কিছুটা ব্যাকফুটে, তাই দ্বিতীয় সংশয়টি অর্থনীতির বিতর্কে তেমন হালে পানি পায়নি।

কিন্তু নরেন্দ্র মোদী কী ভাবে প্রথম সংশয়টির মোকাবিলা করছেন, তা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বিরোধী পক্ষের ব্যর্থতা, আরএসএস-এর নাছোড় মনোভাব, কর্পোরেট দুনিয়ার প্রচ্ছন্ন সমর্থন, প্রচারমাধ্যমের দক্ষ ব্যবহার, সর্বোপরি হিন্দুত্ব প্রসঙ্গকে সতর্ক ভাবে পরিহার করা এই সব কারণ গুরুত্বপূর্ণ হলেও মূল প্রশ্নের উত্তর এগুলিতে পাওয়া যায় না। যাঁরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধ মত পোষণ করেন, তাঁরা কি নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে আজ নিঃসংশয়? না কি সংশয়, সন্দেহ সবই রয়েছে শুধু তার প্রকাশটা পালটেছে?

সাধারণ মানুষের রোজকার সাদামাটা কথাবার্তায় মোদীর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে অবিশ্বাস এবং সংশয় এখনও স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত করা যায়, কিন্তু সঙ্গে এসেছে সেই সন্দেহকে অস্বীকার না করেও, তাকে কেন কিছুটা পাশে সরিয়ে রেখে মোদীর সমর্থনে কথা বলার প্রবণতা। অবিশ্বাসকে স্ব-ইচ্ছায় পাশে সরিয়ে রাখার এই অনুষঙ্গ আমাদের মনে করাতে পারে সাহিত্যতত্ত্বের পুরনো কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারণা। রোম্যান্টিক যুগের ইংরেজ কবি কোলরিজ তাঁর বহু কবিতাতে যে আদ্যন্ত ফ্যান্টাস্টিক জগত্‌ তৈরি করেন, তার রস আস্বাদনের জন্য পাঠককে, কোলরিজের মতে, নিজের অবিশ্বাসকে স্ব-ইচ্ছায় পরিহার (willing suspension of disbelief) করতে হবে, এবং এ কাজে পাঠককে সহায়তা করবে কবিতার মানবীয় আকর্ষণ এবং বাস্তবের কিছু ছোঁয়া। নরেন্দ্র মোদীর রাজনীতি নিয়ে এত দিনের অবিশ্বাসকে ঝেড়ে ফেলার এই প্রক্রিয়া বোঝার জন্য ফেসবুক সমেত অন্যান্য সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটও গুরুত্বপূর্ণ। মোদীর ভোটনীতির অঙ্কে ফেসবুক প্রজন্মের এই সব ভোটার অত্যন্ত জরুরি। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলিতে তরুণ প্রজন্মের যে কথোপকথন, সেখানে মোদীর আর্থিক সংস্কারের প্রশংসার পাশে তাঁর হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গ উঠলে সবাই আশা প্রকাশ করেন যে, প্রধানমন্ত্রী হলে মোদী নিশ্চয় ২০০২-এ গুজরাতে যা হয়েছে, তা আর হতে দেবেন না অর্থনীতির ব্যাপারে যিনি এত যত্নবান, তিনি নিশ্চয় আর হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী হবেন না। পাড়ার চায়ের দোকানেও এখন প্রায় একই যুক্তি শোনা যায়।

এই যুক্তিতে কোথাও নরেন্দ্র মোদীর প্রতি বিশ্বাস প্রকাশ পায় না। কেবল তাঁর প্রতি অবিশ্বাসকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রাখা হয়, অন্তত এই নির্বাচনের জন্য। এই যুক্তিই দেশের বড় একটি অংশের মানুষকে আকর্ষণ করেছে। অর্থনৈতিক বিকাশের গুজরাত-মডেল নিয়ে ক্রমাগত প্রচার যেন কোলরিজ কথিত সেই ‘মানবীয় আকর্ষণ’ এবং ‘বাস্তবের ছোঁয়া’, যার আসল লক্ষ্য হল অবিশ্বাস ঝেড়ে ফেলতে জনগণকে সাহায্য করা। নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর আসল লড়াই এই অবিশ্বাসটুকুর সঙ্গেই।

ভারতীয় রাজনীতিতে, অন্তত বিগত অনেকগুলি দশকে, মানুষ ভোট দিতে এসেছেন রাজনৈতিক দল এবং ব্যক্তির প্রতি অবিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়েই। রাজনৈতিক দলের ইস্তাহার ও প্রতিশ্রুতি যে পালিত হয় না, সেটা জেনেও স্ব-ইচ্ছায় ভোট দেওয়া। মোদীর প্রতি অবিশ্বাস পাশে সরিয়ে রেখে কত মানুষ তাঁকে ও তাঁর দলকে ভোট দেন, তার ওপর নির্ভর করছে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যত্‌। এই দেশের ভবিষ্যত্‌ও। প্রতিশ্রুতি না পালন করাই এ দেশের রাজনীতির রীতি কিনা!

post editorial tajuddin ahmed
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy