Advertisement
E-Paper

আমাদের একটা বাড়ি ছিল

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এই প্রথম বিশ্ব জুড়ে রিফিউজির সংখ্যা পাঁচ কোটি ছাড়িয়ে গেল। যারা নিজের সঙ্গে বয়ে বেড়াচ্ছে এক টুকরো দেশ। সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়।লোক লোক লোক, পিলপিল করছে লোক, উপচে পড়ছে, পিছলে যাচ্ছে, কনুই মেরে ঠেলে ঢুকছে এক চিলতে চট লাগানো পায়খানায়, প্লাস্টিকের আস্তানায় কিংবা নোংরা স্তূপের আড়ালে সেরে নিচ্ছে সঙ্গম বা ধর্ষণ, কিলবিলে থোকা থোকা বাচ্চারা চিপটে যাচ্ছে, ককিয়ে কাঁদছে, ঝুলে থাকছে নাছোড় মা-বাবা-অচেনা জোব্বার খুঁটে; মজবুত জোর, টুটেগা নহি এই আশায়।

শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৪ ০০:০০

লোক লোক লোক, পিলপিল করছে লোক, উপচে পড়ছে, পিছলে যাচ্ছে, কনুই মেরে ঠেলে ঢুকছে এক চিলতে চট লাগানো পায়খানায়, প্লাস্টিকের আস্তানায় কিংবা নোংরা স্তূপের আড়ালে সেরে নিচ্ছে সঙ্গম বা ধর্ষণ, কিলবিলে থোকা থোকা বাচ্চারা চিপটে যাচ্ছে, ককিয়ে কাঁদছে, ঝুলে থাকছে নাছোড় মা-বাবা-অচেনা জোব্বার খুঁটে; মজবুত জোর, টুটেগা নহি এই আশায়। জীবনটা যদি টিকে যায় তো, বহুত। বাটি হাতে লম্বা লাইনে দুর্বল শরীর ধূর্ত ব্রেনে ছকে ফেলছে লঙ্গরখানার বিলোনো অন্যের খাবার ছোঁ মারার মাস্টার প্ল্যান। এদের বলে রিফিউজি।

এরা আদিতেও ছিল, মনে হয় অন্তেও থাকবে। নোয়ার নাওয়ে জোড়ায় জোড়ায় উঠেছিল টিকে থাকার জন্য আর এখন সিরিয়া থেকে সুদান থেকে আফগানিস্তান থেকে সোমালিয়া থেকে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক থেকে ইরাক থেকে পালাচ্ছে অন্যত্র, টিকে থাকার জন্য। রাষ্ট্রপুঞ্জ বলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত মানুষ রিফিউজি হয়নি। ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশন ফর রিফিউজিস-এর হিসেব মতো গোটা পৃথিবীতে প্রায় ছয় কোটি মানুষ এখন শরণার্থী। তারা বাধ্য হয়েছে নিজের আস্তানা ছেড়ে অন্য জায়গায় ঠাঁই নিতে। কেউ ঠাঁই পায়নি, এখনও খুঁজে চলেছে আশ্রয়। আবার কেউ পাঁচ বছর-দশ বছর ধরে শরণার্থী হয়ে রয়ে গিয়েছে অন্য দেশের দয়ায়। সব মানুষ অবশ্য বাস্তুহারা হয়ে অন্য দেশে পালিয়ে যেতে পারেনি বা পালায়নি। দেশের মধ্যেই রিফিউজি হয়ে রয়েছে। তাদের সংখ্যাই বেশি। সাড়ে তিন কোটির কাছাকাছি। আর বাকিটা অন্য দেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এই বিশাল জনসংখ্যার অর্ধেকের বয়স আবার আঠারোর নীচে।

কেবল গত বছরেই, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণে নব্বই লাখ লোক ঘরছাড়া, তার মধ্যে পঁচিশ লাখ দেশ ছেড়েছে। এর পর সবচেয়ে বেশি মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে দক্ষিণ সুদান আর সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক থেকে। অন্য দেশের শরণার্থী সবচেয়ে বেশি আছে পাকিস্তানে, তাদের প্রায় সবাই এসেছে আফগানিস্তান থেকে। তা ছাড়া সোমালিয়া, কঙ্গো, মায়ানমার ইত্যাদিরা তো আছেই, এখন আবার ইরাক থেকেও প্রাণ হাতে পালানো শুরু হল। শরণার্থী পাঠানোর প্রতিযোগিতায় ইরাক সিরিয়াকে হারিয়েও দিতে পারে, পরের বছর রাষ্ট্রপুঞ্জ হয়তো সেই ফলাফল ঘোষণা করবে। রিফিউজির ফিগারটা বেশ নধর হবে বলেই মনে হয়। ইউ এন এইচ সি আর বলছে প্রতি মিনিটে গড়ে আট জন মানুষ গৃহযুদ্ধ, সন্ত্রাস বা মৃত্যুভয়ে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে পালাচ্ছে।

হে ভারত ভুলিয়ো না, তোমার এখানেও লক্ষ লক্ষ রিফিউজি। কেউ মুজফফরনগরের দাঙ্গায়, কেউ গুজরাতের। কেউ ৮৪’র শিখবিরোধী দাঙ্গায় হারিয়ে বসেছে সর্বস্ব, কেউ কাশ্মীর উপত্যকা থেকে পালিয়ে এসেছে আশি-নব্বইয়ের দশকে। আর তাই রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসেব খাতার অংশীদার আমরাও। মিনিটে আট না হলেও বছরে বছরে আমাদের অ্যাকাউন্টও আমরা যত্ন করে ভরিয়ে তুলছি বইকী।

২০ জুন ছিল বিশ্ব রিফিউজি দিবস। ২০০১ সাল থেকে বিশ্ব জুড়ে দিনটি এই হিসেবে পালিত হয়। তার আগে অবশ্য বিভিন্ন দেশ যে যার নিজের মতো করে শরণার্থী দিবস উদ্যাপন করত। আফ্রিকায় এই চলটা ছিল সবচেয়ে বেশি। সেখানেই ২০ জুন তারিখটা এই উপলক্ষে নির্ধারিত ছিল। ২০০০ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদের সভায় স্থির হয় যে, আফ্রিকার সঙ্গেই ওই দিনটিতে সমস্ত বিশ্ব জুড়ে পালিত হবে রিফিউজি দিবস। প্রতি বছর এই দিন অনেক হিসেবনিকেশ হয়, অনেক অঙ্গীকার হয়, কিন্তু রিফিউজিদের সত্যিকারের কতটা লাভ হবে, সে খবর রাষ্ট্রপুঞ্জও দিতে পারবে না।

রিফিউজিরা আসলে কারা? অনেকগুলো মানুষ যারা এক একটা জায়গার কিংবা দেশের ছিল, সেখান থেকে উত্‌খাত হয়েছে।

কিন্তু দেশ তো কেবল একটা বড় ভূখণ্ড নয়। দেশ তো আসলে তৈরি হয় মানুষ দিয়ে। তাই যারা চলে যায় তারা সঙ্গে করে নিয়ে যায় দেশের অনেকটা। মাটি নয়, জল নয়, পাহাড়পর্বত নয়, নিয়ে যায় অনেকটা দেশজ বেঁচে-থাকা। সেই বেঁচে-থাকা শরণার্থী হয়ে অন্য দেশে চলে যায় আর ফেলে রেখে যায় কেবল অনেক শূন্যতা, অনেক অসামঞ্জস্য, অনেক অসম্পূর্ণতা। এই শূন্যতা আর অসামঞ্জস্য আর অসম্পূর্ণতা বয়ে এক দিন সে হয়ে যায় জেল্লাহীন, খসটে মারা ভেজাল ভর্তি সেই দেশটার মুখোশ মাত্র। ভরভরন্ত কয়লাখনি যে সমৃদ্ধি বুকে করে রাখে, কয়লা তোলার পর সে হয়ে যায় দরিদ্র। তার গহ্বর ভরিয়ে চলতে হয় বালি দিয়ে আর একটা সময় তাকে পরিত্যাগ করে চলে যেতে হয় অন্যত্র। সে পড়ে থাকে অতীতের ঐশ্বর্য আর বর্তমানের গ্লানি নিয়ে, একলা। শ্রীহীন পরিত্যক্ত এই ধ্বংসাবশেষকে দেখতে যাওয়া যায়, ইতিহাস রচনা করা যায় কিন্তু তার ঐতিহ্য, তার সমৃদ্ধি আর ফিরিয়ে আনা যায় না। দেশের অবস্থাও সে রকমই। তার মানুষগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ালে কী আর পড়ে থাকে? একটা বড় ভূখণ্ড, আর অবশিষ্ট কিছু মানুষ? যার প্রাণকেন্দ্র অমৃতের বদলে ভর্তি থাকবে বালি দিয়ে, যার প্রাণশক্তি চুষে ছিবড়ে করে ফেলা হয়েছে আর সেই ছিবড়েটুকু বহন করছে তার টিকে-থাকার বেদনা।

এই ক্ষত, এই ক্ষতিকেই কি শাসন করবে সন্ত্রাস-শক্তি কিংবা শিয়ারা বা সুন্নিরা কিংবা আল-শবাব কিংবা বাশার আল আসাদ-এর ব্যারেল বোমা? তাতে পাওনা কী হবে? রিক্ত একটা জমিন, তার চেয়েও রিক্ত তার মানুষ তাকে শাসন করে, তার ওপর আধিপত্য দেখিয়ে কত ক্ষমতা দু’পকেট ভরে রাখা যাবে? কী বার্তা পাঠানো যাবে বিশ্বের তাবড় শক্তিশালী দেশগুলোকে, যে, দ্যাখো ভাই এমন বোমা ফেলেছি, এমন শাসন করেছি যে দেশ ছেড়ে পালানোর পথ পায়নি।

আসলে আমি বিদায় দিয়েছি সম্পূর্ণতার। ভেঙে দিয়েছি নিটোল ছাঁদ। বঞ্চিত করেছি পূর্ণতার ভাগীদারদের। মানচিত্র টায়ে টায়ে ঠিক, কিন্তু দেশ ফোঁপরা। খণ্ডখণ্ড, ছুটকোছাটকা, খাবলাখাবলা দেশ চলে গিয়েছে রিফিউজিদের কোলেকাঁখে, বুকের খাঁচার মধ্যে। যাদের উপস্থিতি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, দৈনন্দিন বেঁচে-থাকাই তো তৈরি করেছিল আমার সর্ম্পূণতা। পাত্র থেকে দুধ খানিকটা কমিয়ে দিলে পরমান্ন কি স্বাদু হয়, বা আদৌ কি তা পরমান্ন হয়?

১৯৮৪ সালে শিখ-বিরোধী দাঙ্গার সময় আমার শিখ বন্ধুরা যখন কলকাতাকে অবিশ্বাস করে পঞ্জাবের দিকে রওনা দিল, সে দিন আমার অন্য বন্ধুরা থাকলেও আমি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলাম। কারণ আমার ছোটবেলার, আমার বন্ধুত্বের, আমার বিশ্বাসের, আমার দৈনন্দিনতার অনেকটা অংশ আমার শিখ বন্ধুরা ওদের সঙ্গে নিয়ে চলে গিয়েছিল। যা আর ফেরেনি, যা আর ভরাট হয়নি। কান্নায়, স্মৃতিতে আর নিঃসঙ্গ খেলার বিকেলগুলোয় যা এখনও লেপ্টে আছে। যে খেলার বিকেলগুলোর রং অন্য রকম হতে পারত, যে সব আঘাত আমার না-ও হতে পারত, যে শংকা আমার মনে বাসা না-ও বাঁধতে পারত। বছর কয়েক বাদে আমার বন্ধুরা ফিরে এলেও সেই টগবগে বন্ধুত্ব আর ফিরে আসেনি, সেই খেলার বিকেল ফেরেনি, সেই কানে কানে কথা বলার বিশ্বাস ফেরেনি, সেই শূন্যতা আর পূর্ণ হয়নি। আমার বন্ধুত্ব রিফিউজি হয়েছিল।

post editorial sanchari mukhopadhay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy