উত্পল দত্তের টিনের তলোয়ার নাটকের সেই লোকটির কথা মনে আছে? ভাঙা ভাঙা গলায় কথা বলে। উচ্চারণের কোনও ঠিকঠিকানা নেই। সে কলকাতার তলায় থাকে। লোকটির সঙ্গে এক দিন হঠাত্ নাটকের দলের কাপ্তেনবাবু, বেণীমাধব চাটুজ্যের রাতের বেলায় দেখা বিশেষ মানুষজনের সংস্কৃতির রসদদার বেণীমাধব, অভিনয়ের দাপটে বাংলার গ্যারিক। কাপ্তেনবাবু সুযোগ পেয়েই এই পড়াশোনা না জানা নিচু জাতের মানুষটিকে খানিক মধুসূদন শুনিয়ে দিলেন। এক নিঃশ্বাসে অমিত্রাক্ষরে লেখা মেঘনাদবধ কাব্য, কী গলা কাঁপানো উচ্চারণ! তার পরেই জিজ্ঞাসা, ‘কী, কেমন লাগলো?’ কলকাতার তলার লোকটির সপাট জবাব, ‘জঘন্য’, এর থেকে আমাদের বস্তির ‘রামলীলে’ ভালো।’
উত্পল দত্তের নাটক বোঝাতে চেয়েছিল, কলকাতা এক নয়, অনেক, এ শহর বাবুদের যেমন, না-বাবুদেরও তেমন। উনিশ শতকে নানা ভাবে আধুনিক হতে শুরু করা কলকাতায় এই নানা তলার মানুষ নানা রকম বিনোদনে মজেছিল। কারও পছন্দ রামলীলে, কারও মধুসূদনের কাব্য, কারও দীনবন্ধুর নাট্য। কিন্তু তার আগে? কিনে পড়ার জন্য ছাপা বই, টিকিট কেটে দেখার জন্য নাটক, শোনার জন্য গান, এই সব আধুনিক সাংস্কৃতিক পড়া-দেখা-শোনার উপসর্গ যখন এ ভূমিতে গড়ে ওঠেনি, তখন ছিল অনাধুনিক কবি আর কথকের দল। সেই কবি-কথকেরা পৃষ্ঠপোষণা পেতেন রাজাগজার, আসর বসত মাঝে মাঝে। নানা বৃত্তির মানুষ সবাই সেই কথকতা জমিয়ে শুনতেন, এ শুনবে ও শুনবে না তা হওয়ার জো ছিল না। তার পর ইউরোপের হাত-ফেরতা হয়ে আধুনিক সভ্যতা এই ভূমিতে ঢুকে পড়ল, সাংস্কৃতিক পণ্য তৈরির কল-কব্জা ক্রমে হাতে এল। কথকতা আর আসর সাহিত্যের দিন গেল। নানা শ্রেণির ও নানা রুচির মানুষের জন্য নানা বিনোদন বানানো হল। কে কোন বিনোদনের জন্য পয়সা খরচ করবেন সে তো তাঁর সিদ্ধান্ত। ভদ্রলোকেরা নীচের তলার গরিবগুর্বোদের বিনোদনকে দু’চক্ষে দেখতে পারতেন না। বঙ্কিম চাইতেন না কবিগান আর যাত্রার বাজারের রমরমা হোক। কিন্তু বঙ্কিমের উপন্যাস যেমন অনেকে কিনতেন, বটতলার বই কেনার লোকেরও তেমন অভাব ছিল না। আধুনিক কেনাকাটার খাপখোপ সেই যে গড়ে উঠল, এখনও সেই বালাই বজায় আছে। বাজার বিশ্বায়িত হয়েছে, রুচি মাফিক সাংস্কৃতিক পণ্য উপভোগের অধিকার এখন ‘সাংঘাতিক’ অধিকার। মাল্টিপ্লেক্সে ‘কুইন’ দেখবেন, না লোকনাটক দেখবেন অ্যাকাডেমি উঠোনে, তা ব্যক্তির মর্জি, শ্রেণিগত বোধ কাজ করে তার পেছনে।
তবে এই দেখা শোনা চাখার ব্যক্তিগত ও শ্রেণিগত খাপখোপের খাঁচাটা এখনও আধুনিক কালেও একটা দুটো বিনোদন-বস্তুর সামনে একেবারে ভেঙে পড়ে। কিছু দিন আগে ক্রিকেট সেটা করত। যেই ‘খেলছে সচিন খেলছে সচিন মারছে সচিন চার’, অমনি সব শ্রেণির সব্বাই উত্তাল। কিন্তু ক্রিকেট এখন সারা বছর ও নানা রকম, মাত্রাতিরিক্ত ক্রিকেট হওয়ার ফলে আগ্রহ কমেছে, এক রকম উদাসীনতাও তৈরি হয়েছে ক্রিকেটের প্রতি। আর বলিউড? এখন সারা বছর সে অজস্র ছবি বানায়। ফলে শোলের মতো মাস্টার-ব্লাস্টার, যা পানওয়ালা থেকে ভদ্রলোক সবার পছন্দ, ইদানীং আর তৈরি হয় না। তা ছাড়া বলিউডের লাভ-লোকসানের ছক এখন আলাদা, পয়সা উসুল করার গপ্পোটা শুধু দেশের ‘সব’ আদমির ওপর নির্ভর করে না। কিন্তু এই বাজারে একটা বিনোদন সামগ্রী আছে, যা কম-বেশি মাসখানেক সারা ভারতের সব শ্রেণির মানুষকে লাগাতার মজিয়ে রাখে। তার নাম লোকসভা নির্বাচন।
কে হবেন আগামী প্রধানমন্ত্রী, কোন জোট দখল করবে দিল্লি, এই মসলাদার জীবন্ত চিত্রনাট্যটি এ দেশের সব কিসিমের মানুষ জাতি, ধর্ম, শিক্ষা, অর্থ নির্বিশেষে উপভোগ করেন। সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমের চালকরা তা জানেন। ফলে পাবলিকের সকালসাঁঝ ভরিয়ে তোলার জন্য তাঁরা পড়ার ও দেখার রকমারি টেক্সট তৈরি করেন। তার কোনওটাই অখণ্ড নয়। টুকরো টুকরো। তাত্ক্ষণিক। কেউ আগে থেকে জানে না এর পর কী? এমনকী যাঁরা কুশীলব, নির্মাতা, তাঁরাও জানেন না। রামলীলার শেষ জানতেন সবাই, কিন্তু নির্বাচনী নাট্য যতক্ষণ না শেষ হচ্ছে, জানার উপায় নেই। সেই জন্যেই তার এমন টান।
এ নাটক সর্বজনীন। কাপ্তানবাবুর নাটকে বস্তির কথা নেই, মধুসূদনের মেঘনাদবধে রামলীলার ভক্তি নেই, রবীন্দ্রনাথের নভেলে বটতলার দুই সতিনের লড়াই নেই, পাগলুতে সতরঞ্চ কি খিলাড়ির গাম্ভীর্য নেই, কিন্তু ভোটনাট্যে একই পাঠ্যে একসঙ্গে সবাই আছেন। দেহাতি হিন্দি বলা নেতা, চোস্ত ইংরেজি বলা ইন্টেলেকচুয়াল, ক্লাস টেন ডিঙোতে না পারা মানুষ, আই আই টির প্রাক্তনী, সবাই লোকসভা নির্বাচনে ক্যান্ডিডেট। কেউ রামের নামে আওয়াজ তুলছেন, কেউ ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য ইস্তাহার লিখছেন। আপনি কাকে পছন্দ করবেন তা আপনার ইচ্ছে, কিন্তু চলমান জ্যান্ত চিত্রনাট্য থেকে কাউকে বাদ দিতে পারবেন না। শিক্ষিত ভদ্রলোকের গুমোর নিয়ে বলতে পারবেন না, টিভিতে গুছিয়ে দুটো ইংরেজিতে কথা বলতে পারে না এমন নেতাকে খারিজ করা হোক। বরং ইংরেজি চ্যানেলেও এই সময় ‘অনপঢ়’রাও ওয়েলকাম। নানা ভাষার নানা চেহারার নানা বর্ণের চিত্রনাট্য হইহই করে সুপারহিট।
গণতন্ত্রের দস্তুর এটাই। চাইলেই লেপেপঁুছে সবাইকে এক করে দেওয়া যাবে না। ভারত অনেক রকম। তার অনেক তল উপতল। আর সেটাই ভারতীয় গণতন্ত্রে এখনও প্রতিফলিত হয়, লোকসভা নির্বাচনের যে চিত্রনাট্য প্রচারিত ও প্রসারিত তাতেও সেটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। এই গণতন্ত্রের ধারণা আমরা পাশ্চাত্য সভ্যতার হাত থেকেই পেয়েছিলাম। পাশ্চাত্য সভ্যতার হাত থেকে পাওয়া জিনিসগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ দেশের ওপরের তলার মানুষরা তাঁদের নিজস্ব বিনোদনের সামগ্রী করে তুলেছেন। এমনকী, যে শেক্সপিয়রের নাটক হল্লাগুল্লা করতে করতে একদা উপভোগ করত ইংল্যান্ডের আমজনতা, সেই শেক্সপিয়রকেও এ দেশে উনিশ শতকে বাঙালি ভদ্রলোকেরা নিজের করে নিয়েছিল। এ কাণ্ড অবশ্য বিলেতেও হয়েছিল। ভদ্রলোকেরাই বিশেষ ইংরেজি জানেন, তাঁরাই বিশেষ উচ্চারণে হ্যামলেটের টু বি অর নট টু বি উচ্চারণ করেন। সাম্প্রতিক কালে শেক্সপিয়রে আবার গণসংযোগ ঘটানো হয়েছে। ইংল্যান্ডে সে চেষ্টা চলছে। বলিউডও শেক্সপিয়র ভেঙে ওম্কারা বানায়। বাঙালি ভদ্রলোকেরা অবশ্য শেক্সপিয়রকে সকলের করে তোলায় এখনও হাত তেমন করে লাগান না।
ব্যতিক্রম ভারতীয় গণতন্ত্র। তাকে এখনও ভদ্রলোকেরা ‘এটা আমার’ বলে দখল করতে পারেননি। গোটা দেশের নানা মানুষ তার ওপরে নাচে লাফায়, হাসে গায়। একেবারেই নিজের নিজের মতো করে। ইয়ে লোকতন্ত্র হ্যায় বাবুয়া। ডেমোক্রেসি মেরি জান।