Advertisement
E-Paper

একে ধরব তাকে ছাড়ব

এই যুগটার দুটো প্রধান লব্জ। এক হল, মাল্টি। এই মালটিতে দড় হয়ে উঠতে গেলে, আর একটা দর্শন অপনাতে হবে, তা হল: পাল্টি।ডিগবাজি খাওয়া সোজা নয় ভাই। হেব্বি ফিটনেস লাগে। আর জীবন মানে যে সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট, সে তো জানা। আমরা পটাপট ডিগ্গু খাচ্ছি বলে টিটকিরি চলছে প্রচুর, কিন্তু সে হল কুসংস্কারবাজের চিল্লামিল্লি। যার সল্ট খেলাম তাকেই লাথ-মারা সমারসল্টে যখন সাফল্যের পাটাতনে নিখুঁত ল্যান্ড করব, আর গবেটের দল যখন টাইটানিকের সঙ্গে ঠ্যঁাটার মতো লেপটে পোঁওও চুবে যাবে, তখন বোঝা যাবে, কে বুদ্ধিমান, কে দিগ্গজ হনুমান।

শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০

ডিগবাজি খাওয়া সোজা নয় ভাই। হেব্বি ফিটনেস লাগে। আর জীবন মানে যে সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট, সে তো জানা। আমরা পটাপট ডিগ্গু খাচ্ছি বলে টিটকিরি চলছে প্রচুর, কিন্তু সে হল কুসংস্কারবাজের চিল্লামিল্লি। যার সল্ট খেলাম তাকেই লাথ-মারা সমারসল্টে যখন সাফল্যের পাটাতনে নিখুঁত ল্যান্ড করব, আর গবেটের দল যখন টাইটানিকের সঙ্গে ঠ্যঁাটার মতো লেপটে পোঁওও চুবে যাবে, তখন বোঝা যাবে, কে বুদ্ধিমান, কে দিগ্গজ হনুমান। মানছি তো, আগে ছিলাম ‘টিম আন্না’-র ভিআইপি ক্যান্ডিডেট, এখন হয়েছি বিজেপি। লাজপত রায়ের মাথায় গেরুয়া উত্তরীয় জড়ালাম, পারলে ইন্দিরা গাঁধীকেও গেরুয়া শাড়ি পেঁচিয়ে দেব। নয় কেন? গেরুয়া হল জাতীয় পতাকার ফার্স্ট রং। কারণ কী? কারণ ভারত প্রথমত বিজেপি। আগে এগুলো বুঝতে পারিনি, আন্নাবাবু ফ্যাশন থেকে খসে পড়ায়, তার পর আন্নার ছান্নাপোন্নারা মিলে ‘আপ’ তৈরি করে সহসা রণে ভঙ্গ দেওয়ায় যে ফাঁকা সময়টা পেলাম, ভেবেচিন্তে দেখি, বিজেপি ভাল, আরএসএস আরও ভাল। হ্যঁা, আগে বলেছিলাম, কক্ষনও রাজনীতিতে ঢুকব না। তা, সব কথা ধরলে হয়? কোটি কোটি ছেলে ‘বিয়ে করব না’ বলে শেষে চার-ছ’টা বউ নিয়ে খেলা করছে, তার বেলা?

সাধারণ মানুষের গোঁড়ামি: যাকে যে ছাঁচে দেখেছি, সেই ছাঁচেই অনন্ত কাল দেখতে চাই। কী রিগ্রেসিভ! এক বার সিপিএম হলে অনন্ত কাল সিপিএম-ই থাকতে হবে? এ তো মানুষটার মৌলিক অধিকারে ঘা মারছ! মগনলাল যখন ফেলুদাকে বলেছিল, ছুটি কাটাতে এসে তদন্ত শুরু করছেন, মাইন্ড চেঞ্জ করলেন কেন? ফেলুদা জবাব দিয়েছিল, আমারই তো মাইন্ড! চেঞ্জ করতে তো বাধা নেই! যে প্রকৃত ভাবুক, মানে, মাইন্ডটাকে রেগুলার জগিং করায়, ভাবনার গতিপথ চেঞ্জ করে গেলে সেই জিপিএস মেনে নিজ কাজকম্মের ভোল পালটে ফেলবে না? তা হলে তো এক বার বিয়ে হয়ে গেলে ডিভোর্স অসম্ভব, বারুইপুরের বাসিন্দার রাসবিহারীর ফ্ল্যাটে উঠে যাওয়া ক্যানসেল, এঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র স্ট্রিম বদলে ইংরিজি অনার্সে ঢুকতে চাইলে ঠাটিয়ে থাবড়া! তার চেয়ে বড় কথা, নাছোড় নাস্তিক হয়তো ষাট বছর বয়সে পৌঁছে বুঝতে পারল, ঈশ্বর আছেন। তখন কি সে নিজের ইমেজ অটুট রাখতে ভণ্ড নাস্তিকই সেজে থাকবে, না দু’হাত তুলে উদ্বেল হয়ে জানাবে, নাক মুলছি, এ বার আসল আলোর চৌকাঠে এলুম! কোনটা সত্‌ ও আলট্রা-সাহসী আচরণ?

এই যুগটার দুটো প্রধান লব্জ। এক হল, মাল্টি। একটা সিনেমা হলের ভেতর দশটা সিনেমা হল। মাল্টিপ্লেক্স। একটা মেয়ের হাতে চল্লিশ রকমের কাজ। মাল্টি টাস্কিং। এই মালটিতে দড় হয়ে উঠতে গেলে, আর একটা দর্শন অপনাতে হবে, তা হল: পাল্টি। একই রকম মুখ একই কাটের প্যান্ট একই থিয়োরির ঘ্যানর নিয়ে এই বনবনায়মান জমানায় বাদশা বনা যায় না। সকালে হয়তো তুমি বললে, ঘুষ খাওয়া খারাপ। তার পর দুপুর নাগাদ একটা ভাল ঘুষের অফার এসে গেল। কখন থুতুর মতো মুখ থেকে কী ছিটকে গেছে, সেই হিস্ট্রি আঁকড়ে এমন দাঁও ছেড়ে দেবে? পাগলা? নতুন অডি-র ইএমআই-টা দিয়ে যাবে কে? তোমার ক্রিটিক-জনতার বাবা? তার চেয়ে পাল্টি খেয়ে বলো, ঘুষ খুব ভাল। কিংবা, ঘুষের প্রকৃত প্রেক্ষিত বিশ্লেষণ করতে হবে, তাতে বছর ছয়েক লাগবে। বা কিচ্ছুই বোলো না, খিস্তি মেরে প্রশ্নটা এড়িয়ে যাও। একে দুর্নীতি বা অনীতি বলে না, একে বলে স্টেপ মেলাতে জানা। ওরে বাপ, এখন চ্যানেল-সার্ফিং’এর মতো পৃথিবী বদলাচ্ছে। এই ছিল চিল, হয়ে গেল আঁচিল। এ চিত্রনাট্যে ঠাকুদ্দার ভোঁদাইমার্কা থপথপ কপি-পেস্ট করেছ কি গেছ। মেসির মতো ফ্ল্যাশ-ডজাও। পুরী বলে পেরু চলে যাও। পোস্ত বলে পাস্তায় কামড়াও। অই শোনো, যুগাড়ু মানুষের কোরাস: তিল দেব, পেড়ে খাব তালটি/ ছুঁচ ঢুকে বের হব ফাল-টি/ জয় বাবা পাল-পাল-পাল্টি!

আসলে, মূল্যবোধ, এথিক্স, ন্যায্যতা, এই সব আবছা-কাটিং শব্দ অনেকের গাল থলথল চর্বির মতো ফুলিয়ে রেখেছে। মূল্যবোধ কাকে বলে ভাই? মূল্য সম্পর্কে বোধ। যদি দেখি এখন বিজেপিতে গেলে বেশি মূল্য পাব, তবে আমার তন্দুরস্ত বোধ কী বলবে? এই যে তৃণমূলের দীনেশ ত্রিবেদী কী সুন্দর মোদী-ঘেঁষা কথাবাত্তা বলছেন, তিনি এখন ঠিক পড়তে পারছেন, কোন পার্টির মূল্য কমছে, আর কার গ্রাফ রাইজিং। তা হলে তুল্যমূল্য তিনি বেশি বুঝলেন, না এখনও বান্ডিল পাকিয়ে ওই পার্টির তেরপলের ভেতরে ধুকপুকোতে থাকা পেঁচোরা বেশি বুঝল? সিপিএম-ঘেঁষা অভিনেত্রী এক সুন্দর সকালে টুক করে বিজেপি হয়ে যাচ্ছেন, চির-সিপিএম-বান্ধব ক্রিকেটার এখন বিজেপির দিকে কার্নিক খাচ্ছেন, অন্তত টুইটারে সেই জল্পনায় বালি ঢালার কোনও আগ্রহই দেখাচ্ছেন না, এঁরা কি সমাজের সুপ্রিম বুদ্ধি ও কীর্তির বিগ্রহ নন? আলবাত। মানুষের ধর্ম হল, যেখানে লাভ, সেখানে লাফ। মাইনে বেশি পেলে চাকরি বদলাই, ছাড় বেশি পেলে মল, আর লাভের গুড় বেশি পেলে বদলাব না দল?

বেহুলা-সিনড্রোমে ভুগো না ভাই। মৃতদেহ আঁকড়ে ভেলা ভাসালে ভেউভেউ যাত্রাপালা হয়, বাস্তব হয় না। তা ছাড়া, ভারতীয় দর্শন বলে, কে তোমার পুত্র, কে তোমার কান্তা, কে তোমার পার্টি, অ্যাকচুয়ালি জানতা? কেউ কারও নয়, শুধু তুমি তোমার। তোমাকে জিততে হবে, মার্কেটে থাকতে হবে। নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যাও, সব দল তোমায় চাইবে, তুমি টিআরপি মেপে, একটা আদর্শে টিক দিয়ে দেবে। পেনসিলে দেবে, কারণ আদর্শও— জগত্‌, গিরগিটি ও নারী-মুডের ন্যায়— চকিতচেঞ্জুয়া। গাধারা বেইমান বলুক, পাল্টিবাবারা আসলে স্মার্টেশ্বর, বাঁচন-দড়। তারা বরাবর প্রেজেন্ট টেন্সে ভাসে, সেল্ফি তুললেই হাসে, নির্জন বাথরুম যায় না। আর, পোষা কুত্তার নাম রেখে দেয় বিবেক, সে ব্যাটা কামড়ায় না।

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

post editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy