আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে এই অকৃত্রিম চাওয়ার কোনও পরিবর্তন হবে না। কিন্তু এই দুধেভাতে রাখার মানেটা আমরা ঠিক কী ভাবে বুঝতে চাই? আমরা বাচ্চাদের ওদের মতো করে ভাল থাকতে দিতে চাই, না কি আমাদের মতো করে? বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা যা ভাল বুঝি, সেটাকেই ওদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ভাবি, ওদের ভাল রাখলাম। প্রকারান্তরে নিজেদের অস্তিত্ব দিয়ে জাপটে-জড়িয়ে নিজের একটা প্রায় জেরক্স কপি বার করতে চাই, হয়তো সচেতন ভাবে না জেনেই। খুব কম মানুষ সন্তানের স্বতন্ত্রতা মেনে নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
সদ্যোজাত শিশুরও নিজের মন আছে। আমরা ভাবি, সে একটা মাটির ডেলা, যেমন গড়বে তেমনি হবে। মোটেও নয়। চার মাসের বাচ্চা দুধ খেতে না চাইলে যেই জোর করে তাকে খাইয়ে দিলাম, সেই মুহূর্ত থেকে তার মনের ওপর জোর করা শুরু হল। তার পর গোটা লেখাপড়ার জীবন, সহবত শেখার জীবনে যে সে কত বার তার মনের বিরুদ্ধে গিয়ে অনিচ্ছায় বড় হয়ে ওঠে, সে কথা আমরা ভাবিও না। আর, শিশু প্রথমে এক জন সামাজিক জীব। তাকে যদি সেই ভাবে মানুষ করে তুলতে হয়, তা হলে তার ওপর স্বত্বাধিকার একটু কম প্রয়োগ করা ভাল। সন্তান যেমন মা-বাবার, তেমনই সমাজের। সন্তানের উপর আধিপত্যবোধটাই কিন্তু তার বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
আবার, আমরা সচেতন বা অবচেতন ভাবে সব সময় চেষ্টা করে যাই যাতে আমার সন্তান সবচেয়ে ভাল জিনিসটা পায়, তার যাতে কোনও কষ্ট না হয়, সে যেন কোনও বাধার সম্মুখীন না হয়। এর পেছনে খুব একটা সুস্পষ্ট কারণ আছে। ওই ওই দুঃখগুলো, ওই ওই কষ্টগুলো আমরা নিজেরা পেয়েছি বা খুব কাছের কাউকে পেতে দেখেছি। নিজের কষ্টের অভিজ্ঞতা যেন সন্তানের কখনও না হয়, এই ভয় থেকে আমরা তাকে সব সময় কষ্ট, দুঃখ থেকে বেশি আড়াল করে রাখার চেষ্টা করি। আর তার ফলে বাস্তব থেকে তাদের দূরে ঠেলে দিই।
আমাদের মা-বাবারাও চেয়েছিলেন, তাঁদের সন্তানরা যেন কোনও রকম কষ্ট, দুঃখ না পায়, ভাল থাকে। তার জন্য তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু আমরা কি জীবনের সব কষ্ট-দুঃখ থেকে দূরে থাকতে পেরেছি? আমাদের সন্তানরাও পারবে না। এটা অপ্রিয় কথা। কিন্তু সত্যিও বটে। তাই আমরা কেবল একটা পর্যায় পর্যন্ত চেষ্টা করতে পারি যেন আমার সন্তান ভাল থাকে। এই সমাজ, এই পৃথিবীতেই সে বেড়ে উঠবে, সে যাতে বাস্তবের সঙ্গে নিজেকে বুনে নিতে পারে, আমাদের সেই চেষ্টাই করতে হবে। আমাদের বরং বোঝানো উচিত যে পৃথিবীটা এ রকমই, কখনও ভাল হয়, কখনও খারাপ। এই শিক্ষাটা থাকলে মানুষ জীবনটাকে অনেক দিক থেকে দেখার চেষ্টা করতে পারে, জীবন যে কেবল কিছু প্রাপ্তির জন্য নয়, তা বুঝতে পারে।
আমাদের মাথায় কতকগুলো জিনিস ঢুকে গেছে। এক, এটা কম্পিটিশনের যুগ, তাই সব কিছুর আগে নিজেকে কম্পিটিশন-যোগ্য করে তুলতে হবে। আর সে জন্য প্রয়োজন শুধু নিজের প্রতি মনোনিবেশ। পড়াশোনাই হোক, বা সাঁতার বা ছবি আঁকা, সব কিছুতেই যেন নিজেরটা আগে হয়। তুমি কিন্তু তোমার নোটস কারও সঙ্গে শেয়ার করবে না, তুমি কিন্তু নিজের টিফিনটা খাবে এই ছোট্ট ছোট্ট ব্যাপার ক্রমশ ছেলেমেয়েকে স্বার্থপর করে তোলে। তখন সে নিজেরটা ছাড়া কিছু বোঝে না, এমনকী মা-বাবার প্রয়োজনও নয়। আমরাই তো চেয়েছিলাম যে সন্তান যেন সব ভালটা পায়, তার নিজেরটা ভাল করে বুঝে নেয়।
এর মধ্যে আরও বড় একটা ঝুঁকি লুকিয়ে থাকে। যখন আমরা সন্তানকে সবচেয়ে ভাল জিনিসটা দিয়ে বড় করি, সবচেয়ে বড় কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার মধ্যে রোপণ করি, তখন ভাবি না যে, ওই ভালটা না পেলে তার কী হতে পারে। ছোটবেলায় একটা খেলনা না পেলে বাড়ি মাথায় করে, আর বড় বেলায় জয়েন্ট পরীক্ষায় চান্স না পেলে কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং থার্ড ইয়ারে গিয়ে বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানির চাকরি না পেলে আত্মহত্যার কথা ভাবে। আসলে আমরাই তো তাকে শিখিয়েছি যে বেস্টটা পেতে হবে। তার একটু তলায় যেটা, সেটাও যে বেশ ভাল, তা বোঝাইনি। ভাবতে শেখাইনি, সমাজে সব রকমের একটা মিশেল থাকে, তাই ভারসাম্য থাকে। বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখানো, উচ্চাকাঙ্ক্ষা তৈরি করা ভাল, কিন্তু কেবল সেটাই ভাল আর অন্য কোনও মান গ্রহণযোগ্য নয়, সেটা ভাবানো অন্যায়, অপরাধও। আমি তো এটাও বলি যে, সন্তানকে ছোটবেলা থেকে একটু ‘না’ শুনতে শেখান। বড় হয়ে সে অনেক ‘না’ শুনবে, তখন সেই রিজেকশন মেনে নিতে তত কষ্ট হবে না।
তবে এই বারণ করার মধ্যেও একটা ভারসাম্য চাই। আমরা অনেকে ভাবি, খুব কড়া শাসনে বড় করলে সন্তান ভাল মানুষ হবে। হয়তো হবে, কিন্তু সে তার মতো আর থাকবে না। কারণ সে নিজের সত্তাকে মেরে ফেলে শুধু বারণ শুনেছে। সে কোনও কিছু চাইবে না এই কারণে নয় যে, সে ভাল সহবতের অধিকারী, এই কারণে যে, সে মনে করে সে কোনও কিছু পাওয়ার যোগ্য নয়। এত বারণের মধ্যে মানুষ হয়ে সে নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে কেবল অন্যের কথা শুনতে শিখেছে। এটাও কিন্তু ভাল নয়।
আসলে জীবনটাকে ধীরেসুস্থে কাটাতে শেখানো ভাল। আমরা সন্তানকে বলি, পড়াশোনা মানেই কম্পিটিশন। এতে যেটা হয়, ছোটবেলা থেকে বেশি নম্বর পাওয়ার জন্য যে পরিশ্রম তাকে করতে হয়, তাতে সে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তাই উচ্চশিক্ষার দিকে আর যেতে চায় না। কোনও মতে একটা চাকরি জোগাড় করে ফেলাটাই তার জীবনের মোক্ষ হয়ে যায়। পড়াশোনা ব্যাপারটা যে আসলে মস্ত আনন্দের, এটা আমরা বোঝাই না। পড়াশোনার জীবনটা একটা লম্বা জীবন। এটা কোনও ১০০ মিটার দৌড় নয় যে এক বার সর্বশক্তি জুটিয়ে দৌড়লাম আর মোক্ষ পেয়ে গেলাম। পড়াশোনার জীবনটা আসলে একটা ম্যারাথন। সেই দৌড়ে জিততে গেলে নিজের শক্তি সঞ্চয় ও তার বণ্টন বুদ্ধি করে করতে হয়, না হলে কিছু দূর খুব ভাল এগিয়ে তার পর পিছনে পড়ে থাকবে। আর কষ্টটা অনেক গুণ বেড়ে যাবে। পড়াশোনার জীবনটাকে তাই সানন্দে গ্রহণ করতে শেখান। সন্তানের জীবনটা আনন্দময় হবে, সাফল্যও আসবে।
শেষে বলব, আমরা বরং নিজেদের একটু অভিভাবকত্ব করি। নিজেদের জীবন ও ভাবনার মধ্যে একটা ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করি। আমরা যদি বিশ্বাস করতে পারি যে সন্তান ফার্স্ট না হলেও সফল হতে পারবে, পাওয়া না পাওয়ার একটা মোটামুটি খসড়া থাকলেই হল, অন্যকে সাহায্য করলেও তার কিছু কম পড়বে না, তা হলে এই বিশ্বাস সন্তানদের মধ্যে চারিয়ে যাবে। আর আত্মবিশ্বাস যে এক জন মানুষকে কত দূর নিয়ে যেতে পারে, এক জন মানুষকে কত প্রতিকূলতা পেরিয়ে যেতে শেখায়!
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ-এর অধিকর্তা। মতামত ব্যক্তিগত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy